পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
পলাশ মাহমুদ : মাত্র পাঁচ বছর আগে ঢাকায় আসেন রাসেল বিন শহিদ। প্রতারণার অভিযোগে জনরোষে পড়ে নিজ এলাকা বগুড়া ছাড়েন তিনি। আশ্রয় নেন একটি ভাড়া মেসে। কিন্তু এখন তিনি কোটিপতি। প্রায় ১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড তার ঝুলিতে। বসবাস করছেন সংরক্ষিত (মিরপুর ডিওএইচএস) এলাকায়। ক্ষমতা-প্রতিপত্তি এখন তার কাছে হাতের মোয়া। ডিওএইচএসে বসেই প্রতারণার ফাঁদ পেতে যাচ্ছেন একের পর এক। তার প্রতারণা থেকে নিকটাত্মীয় ও বাল্যকালের বন্ধুরাও বাদ যায়নি।
রাসেলের এই উত্থানের পেছনে রয়েছে আদম ব্যবসা নামে প্রতারণার ফাঁদ। এ পর্যন্ত প্রায় ৩শ’ মানুষ তার ফাঁদে সর্বস্বান্ত হয়েছে। প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে ২২ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। টাকা ফেরত চাওয়ায় অনেক ভুক্তভোগী এখন প্রাণ শঙ্কায় রয়েছেন। অনেককে মিথ্যা চেক দিয়ে, কারো কারো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। উচ্চপদস্থ এক মৃত সামরিক কর্মকর্তার স্ত্রী ও কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও তাকে সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানাযায়, বগুড়া শহরের জহুরুলনগর এলাকার বাসিন্দা শহীদুল ইসলামের ছেলে এএসএম রাসেল। ২০০০ সালে বগুড়ার সাত মাথার মোড়ে সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি নামে ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বসে। ছাত্র-ছাত্রীও ভর্তি করানো হয়। একই সাথে সাউথ এশিয়ান হাউজিং লি: নামে ডেভেলপারের ব্যবসা ও পাওয়ার সোর্স নামে আদম ব্যবসার সাইনবোর্ড লাগিয়ে প্রতারণা শুরু হয়। কয়েকশ’ ছাত্রের কাছ থেকে ভর্তি বাবদ টাকা নেয়া হয়। বিদেশ পাঠানোর জন্য অনেকের থেকে টাকা জমা নেয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই প্রতারণা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে ভুক্তভোগীরা। এলাকা ছেড়ে পালিয়ে আসে রাসেল।
রাসেলের বাল্যকালের বন্ধু বগুড়ার শাহজানপুরের আহসান কবির এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি তার খুব ক্লোজ বন্ধু। সে আমার থেকে ডেভেলপার ব্যবসা ও আমার ছোট ভাইকে কানাডা পাঠানোর জন্য ২২ লাখ টাকা নেয় চার বছর আগে। টাকা ফেরত চাইলে পাওয়ার সোর্সের নামে ইস্টার্ণ ব্যাংকের (জীবন বিমা ভবন শাখা) হিসাব নং- ৩৩১১০৭০০৩৯৩৭০ এর তিনটি চেক দেয়। ২ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে ১২ লাখ টাকার, ৩ মে ২০১৩ সালে ১০ লাখ টাকার ও ২ লাখ ২৮ হাজার টাকার। কিন্তু তিনটি চেকই ডিজওনার হয়। মামলা করতে চাইলে সে কয়েক দিনের মধ্যে টাকা দেবে বলে মামলা ঠেকায়। কিন্তু পরবর্তীতে আমাকে র্যাব আর ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ফোন দিয়ে ক্রস ফায়ারের হুমকি দিচ্ছে। এখন আমার টাকা গেছে গেছে। আমি বাঁচতে পারলে ভাল।’ একথা বলতে বলতে কবির এ প্রতিবেদকের সাথে কেঁদে ফেলেন।
ঢাকায় এসে কিছু দিন পালিয়ে থাকার পর গত বছর থেকে আবারও শুরু হয় নতুন ফাঁদ। অক্টোবর মাসে ২/৪, দক্ষিণ কল্যাণপুর অফিস নেন নিজের নামে। অফিসে লাগানো হয় ‘সাউথ এশিয়ান টুরস এন্ড ইমিগ্রেশন লিঃ’ নামের আদম ব্যবসার সাইনবোর্ড। রাসেল ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। উচ্চ বেতনে কর্মকর্তা-কর্মচারীও নিয়োগ দেয়া হয়। সেখানে বসে শুরু হয় বিদেশ গমনেচ্ছুদের সন্ধান। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কাতার, আমেরিকা, কানাডা, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর প্রচার করা হয়। মাত্র ২ মাসেই ১৯৯ জন বিদেশ গমনেচ্ছুকে পেয়ে যায় সাউথ এশিয়ান ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস। প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা নেয়া হয়। টাকার সাথে জমা নেয়া হয় পাসপোর্টও। প্রত্যেককে টাকার বিনিময়ে কোম্পানির নামে রসিদও দেয়া হয়। এমন একজন হচ্ছেন হেলাল হোসাইন। কাতার যাওয়ার জন্য গত নভেম্বর মাসের ১১ তারিখে তিনি এক লাখ ৩০ হাজার টাকা দেন। তাকে দেয়া রসিদের নম্বর ০১৮। কিন্তু হেলাল এখন রাসেলের অফিসের সন্ধানই জানেন না। এমন অন্তত ২০ রসিদের কপি এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, মাত্র দুই মাসে কল্যাণপুর অফিসের মাধ্যমে প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে হঠাৎ করে অফিস বন্ধ করে দেয় রাসেল। উধাও হয়ে যায় সাউথ এশিয়ান ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস। ডিসেম্বরের প্রথমে নতুন অফিস নেয় মহাখালি ডিওএইসএস-এর ৮ নং রোডের ১০৭ নং বাড়িতে। সেখানে ট্রাস্ট বিজনেস কনসোর্টিয়াম নামে নতুন সাইনবোর্ড লাগানো হয়। পূর্বের গ্রাহকদের নতুন ঠিকানা না দিয়ে তাদের বিভিন্ন আইপি (এন্টারনেট প্রোটোকল) নম্বর থেকে ফোন করে তিনি বিদেশে আছেন বলে সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন। এদিকে মহাখালি অফিসে নতুন গ্রাহকের সন্ধান শুরু হয়। মাত্র এক মাসে প্রায় ২০ জন বিদেশগামীকে পেয়ে যায় সে। প্রত্যেকের কাছ থেকে পাসপোর্ট আর সর্বনি¤œ ৩ লাখ থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা নেয়া হয়। এখান থেকে সে সংগ্রহ করে প্রায় দেড় কোটি টাকা।
কিন্তু প্রতারণা এখানেই শেষ হয়নি। মাত্র এক মাসের মধ্যে মহাখালির অফিস ছেড়ে দেন রাসেল। গত জানুয়ারি মাস থেকে নতুন অফিস হয় মিরপুর ডিওএইচএস এলাকার ৩ নং রোডের ২৪৯ নং বাড়ির ৪ তলায়। এখানে স্বপ্নীল রিসোর্ট নামের আরেকটি ব্যবসার সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। ডিওএইচএসের এই বাড়িতে বসে এখন রাসেল ভুক্তভোগীদের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছেন।
রাসেলের ব্যবসার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত (নিয়োগপ্রাপ্ত) এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, এখন অনেককে আইপি ফোন থেকে কল করে রাসেল বলেন, আমি বিদেশে আছি। অনেককে র্যাব ও ডিবি দিয়ে ভয়-ভীতি দেখিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। কাউকে কাউকে ওই বাড়িতে ডেকে মারপিট করে চোর বলে পুলিশে দেয়া হয়েছে।
ঢাকার মালিবাগের ভুক্তভোগী মোহাম্মদ আলি জানান, কানাডা পাঠানোর জন্য তার থেকে পাঁচ মাস পূর্বে চার লাখ টাকা নিয়েছেন রাসেল। কিন্তু কানাডা পাঠাতে পারেনি। পরে তাকে ২ মাসের সময় দিয়ে দুটি চেক দেয়া হয়। কিন্তু তার ওই ব্যাংক হিসাবে কোন টাকা নেই। বিষয়টি রাসেলকে জানালে রাসেল তাকে ডিবি পুলিশ দিয়ে হয়রানি করছে। বিভিন্ন মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে মিন্টো রোডের ডিবি অফিসের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তাকে ভয় ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে তার অভিযোগ।
বগুড়ার ভুক্তভোগী ফরহাদ হোসেন জানান, তিনি বিদেশ যাওয়ার জন্য রাসেলকে ৫০ হাজার টাকা দেন। কিন্তু বিদেশ পাঠাতে না পেরে গত ১লা ফেব্রুয়ারী ৩৫ হাজার এবং ১৫ই ফেব্রুয়ারী ৪৫ হাজার টাকার ডাচ বাংলা ব্যাংকের দু’টি চেক দেয়া হয়। কিন্তু গত ১০ই মার্চ ফরহাদ টাকা তুলতে গেলে তার চেক ডিজ অনার হয়।
প্রতারণার শিকার বগুড়ার শাহজাহানপুরের হেলাল জানান, তিনি কাতার যাওয়ার জন্য রাসেলকে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা ও তার পাসপোর্ট দিয়েছিলেন। তাকে ভিসার ফটোকপি দেখিয়ে ফ্লাইটের কথা বলে ঢাকায় নিয়ে যান। কিন্তু ৪ দিন ঢাকায় অপেক্ষা করেও তার ফ্লাইট হয়নি। তার ভিসাটাই ভুয়া ছিল। পরে তিনি বাড়ি ফিরে যান। এরপর সে আর রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। তবে অফিসের এক স্টাফের মাধ্যমে ২টি চেক দিলেও তা ব্যাংকে ডিজ অনার হয়েছে।
রাসেলের বিরুদ্ধে ভিসা জাতিয়াতির অভিযোগও রয়েছে। একজনের ভিসা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে তা এডিট করে অন্য ব্যক্তির নাম বসানো হয়। পরে সেটি ফটোকপি করে ভুক্তভোগীদের দিয়ে সেটা তার ভিসা বলে জানানো হয়। এমনকি বিমানের ভুয়া টিকিটও দেখানো হয় অনেককে।
জানাযায়, মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে পিরোজপুরের ফিরোজ আকন নামে এক ব্যক্তি থেকে ১ লাখ ১২ হাজার টাকা নেন। রাসেল কাতার গমনেচ্ছু তারেক আলী নামে এক ব্যক্তির ভিসা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে নাম এডিট করে ফিরোজ আকনের নাম বসিয়ে দেয়। সেটি ফটোকপি করে ফিরোজ আকনকে দেয়া হয়। এই প্রতিবেদক ইন্টারনেটে সার্সও এর সত্যতা পায়।
প্রতারণার শিকার একাধিক ভুক্তভোগী এ প্রতিবেদককে জানান, রাসেল বর্তমানে মিরপুর ডিওএইচএসের যে বাড়িতে অবস্থান করছে সেটি সেনাবাহিনীর সাবেক এক কর্মকর্তার (মৃত)। বাড়িতে বর্তমানে থাকেন ওই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী শারমিন বিনতে সিদ্দিক ও এক সন্তান। রাসেলের স্ত্রী থাকলেও স্ত্রীকে বাড়িতে (বগুড়ায়) রেখে এখানেই থাকেন তিনি। সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীর সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠায় তাকেও ব্যবসায়িক অংশীদার করে নিয়েছে রাসেল। সেনাবাহিনীর ট্রাস্ট পরিবহনের নামের সাথে মিল রেখে ট্রাস্ট বিসনেস কনসোর্টিয়াম নামে ব্যবসা করে যাচ্ছেন তারা। বর্তমানে রাসেল প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও শারমিন সিদ্দিক চেয়ারম্যান।
অনুসন্ধানে জানাযায়, শারমিন বিনতে সিদ্দিকের প্রভাবে রাসেল এখন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সংরক্ষিত এলাকা হওয়ায় সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। আবার ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন সময়ে ডিজিএফআই ও ডিবি পুলিশ পরিচয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করে এই প্রতিবেদককে এক ভুক্তভোগী জানান, কয়েক দিন পূর্বে তাকে ডিবি পুলিশের পাঁচজন সদস্য গিয়ে আটক করে। তাকে ক্রস ফায়ারের হুমকি দেয়া হয়। পরে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।
এসব বিষয়ে রাসেল বিন শহীদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কাউকে চেক দেইনি। এ প্রতিবেদকের কাছে চেকের কপি আছে জানালে তখন অবশ্য স্বীকার করেন। সংরক্ষিত এলাকায় তিনি কিভাবে থেকে ব্যবসা করছেন জানতে চাইলে তিনি ভাড়ায় আছেন বলে জানান। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে রাসেল সেখানে থাকেন। র্যাব ও ডিবি দিয়ে হয়রানির বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার র্যাব-ডিবিতে কেউ নাই। কিন্তু ডিবি পুলিশ তার পক্ষে একজনকে তুলে এনেছে এমন ঘটনা এ প্রতিবেদকের জানা আছে এমন চ্যালেঞ্জ করলে তিনি বলেন, সেটা পুলিশ করিয়েছে। আমি মামলা করেছি। এখন পুলিশ কাকে দিয়ে কি করিয়েছে তা তারা জানে। রাসেল বলেন, আপনাকে অনুরোধ করবো, আপনি আমার অফিসে এসে সব বিষয়গুলো বিস্তারিত জেনে যান। উপরের কথোপকথনের প্রায় আধা ঘন্টা পর আবার এ প্রতিবেদককে ফোন করে এ সংবাদটি এখন না করে তার অফিসে চায়ের দাওয়াত দেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।