Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাশিয়া-পাকিস্তান সামরিক মহড়া শুরু সন্ত্রাস বিরোধী জোট গড়ার দিকে যাত্রা

ভ্যালু ওয়াক | প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রাশিয়া ও পাকিস্তানের মধ্যে সোমবার থেকে শুরু হয়েছে যৌথ সামরিক মহড়া। এর মধ্য দিয়ে দেশ দু’টি ক্রমেই সন্ত্রাস বিরোধী পরাশক্তি জোট গড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমান সামরিক মহড়া হচ্ছে ২০১৬ সালে রাশিয়া-পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম বন্ধুত্ব ২০১৬ মহড়ার সম্প্রসারিত রূপ। এ মহড়া গত বছর তাদের সামরিক অংশীদারিত্বকে নজিরবিহীন মাত্রায় উন্নীত করে। এদিকে পাকিস্তানের চিরশত্রু ভারত গত সপ্তাহে রাশিয়া-পাকিস্তান সামরিক মহড়া বাতিল করার জন্য মস্কোর কাছে কূটনৈতিক আবেদন জানালে মস্কো তা প্রত্যাখ্যান করে। বন্ধুত্ব ২০১৭ নামে আখ্যায়িত এ সামরিক মহড়া রাশিয়ার ককেশাস অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দু’সপ্তাহ ব্যাপী এ মহড়া চলবে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত। এ মহড়ায় সন্ত্রাস দমন, জিম্মি ঘটনা ও উদ্ধার অভিযানের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হবে। দ্রুজবা ২০১৭ সাংকেতিক নামের এ মহড়ায় দু’দেশের ২শ’ সৈন্য অংশ নিচ্ছে।
এ মহড়া রাশিয়া ও পাকিস্তানের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্বে এক নতুন মাত্রা সূচিত করেছে। শীতল লড়াইয়ের যুগে এ দেশ দু’টি পরস্পরের শত্রু ছিল। প্রেসিডেন্ট পুতিন ২০১৪ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরোপিত কয়েক দশকের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে তাদের মধ্যে সামরিক, অর্থনৈতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হতে শুরু করে। বন্ধুত্ব ২০১৭ মহড়া উদ্বোধনীতে দু’দেশের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা যোগ দেন। পাকিস্তানের সেনা প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে রাশিয়া সফর করবেন।
ইসলামাবাদের সাথে পাশ্চাত্যের উত্তেজনা হ্রাসের কোনো সম্ভাবনা না থাকার প্রেক্ষাপটে রাশিয়া-পাকিস্তান সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার আফগান নীতি কৌশল ঘোষণার সময় জঙ্গিদের নিরাপদ আশ্রয় দেয়ার জন্য পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেন। তার বক্তব্য মার্কিন-পাকিস্তান সম্পর্কে উত্তেজনা সঞ্চার করে। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দেন বলে খবরে বলা হয়। বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করার জন্য পাকিস্তানের উপর চাপ বৃদ্ধি দেশটিকে রাশিয়া ও তার পরীক্ষিত বন্ধু চীনের আরো কাছে ঠেলে দিতে পারে।
ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ট্রাম্পের কৌশলের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে তার মিত্রদের দিকে ঝুঁকিয়েছে। রাশিয়া হচ্ছে প্রথম মিত্রদের একজন যে পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করে পাশ্চাত্যকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে ইসলামাবাদের উপর চাপ সৃষ্টি এ অঞ্চলকে আরো অস্থিতিশীল করতে পারে।
মস্কো ভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্øেষক অ্যান্ড্রু করিবকো বক্তিগতভারে ভ্যালু ওয়াককে বলেন যে রাশিয়া-পাকিস্তান সামরিক মহড়া এবং রাশিয়া ও পাকিস্তানের মাঝে যৌথ সামরিক সহযোগিতা দু’দেশকে সন্ত্রাস দমন পরাশক্তি হতে এবং ইউরেশিয়ান নিরাপত্তা বিপুলভাবে জোরদার করার দিকে এগিয়ে নেবে।
তিনি বলেন, উত্তর ককেশাস অঞ্চলে চলমান এ সামরিক মহড়া শক্তিশালী প্রতীকী মূল্যের চেয়ে অেেনক বেশী কিছু। এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের রুশ আয়োজকদের সাথে পার্বত্য সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানের ব্যাপক অভিজ্ঞতা শেয়ার করবে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়া তাদের অতিথিদের ইসলামিক স্টেট বা দায়েশ বিরোধী অভিযানের কৌশল শিক্ষা দেবে।
করিবকো বলেন, রাশিয়া ও পাকিস্তান সন্ত্রাস বিরোধী সামরিক মহড়া থেকে বিপুলভাবে উপকৃত হতে পারে যেহেতু তাদের সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ের পৃথক অভিজ্ঞতা রয়েছে।
সম্প্রতি টাইমস অব ইসলামাবাদে রাশিয়া-পাকিস্তান সম্পর্ক বিষয়ে এক ব্যাপক ভিত্তিক বিশ্লেষণে তিনি বলেন, সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ের ক্ষেত্রে দু’ বড় শক্তির একে অপরের সাথে একটি কৌশলগত সম্পূরকতা রয়েছে। কারণ তারা উভয়েই এ বৈশি^ক সমস্যার হুমকির সম্মুখীন। তবে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন।
করিবকো ব্যাখ্যা করেন যে সিরিয়ায় রাশিয়া দায়েশ বিরোধী অভিযানে যে শিক্ষা লাভ করেছে , দায়েশের খোরাসান গ্রুপের আফগানিস্তানে উপস্থিতির প্রেক্ষাপটে তা পাকিস্তানের জন্য প্রয়োজনীয়। পাকিস্তান তার পর্বতময় সীমান্তে আফগানিস্তান ভিত্তিক সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সাথে তার লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারে। তিনি আরো বলেন, দায়েশ যদি মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি থেকে বিতাড়িত হয় ও তাদের কিছু রুশ ভাষাভাষী সদস্য উত্তর ককেশাসে তাদের ব্যর্থ খিলাফতের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চায় তখন এ অভিজ্ঞতা রাশিয়ার জন্য সুবিধাজনক হতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের ক্রমাগত উন্নতি হয়েছে। দু’ দেশ ঠান্ডা লড়াই যুগের তাদের মধ্যকার ব্যবধান পিছনে ফেলে এসেছে এবং বড় ধরনের ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে পরিচ্ছন্নভাবে তাদের সম্পর্ক পুনরায় শুরু করেছে। ওয়ামিংট ডি.সি-র জর্জটাউন বিশ^^বিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অস্ট্রেলিয়ান, নিউজিল্যান্ড অ্যান্ড প্যাসিফিক স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো ড. ক্লড রাকিসিটস ভ্যালু ওয়াককে ব্যাখ্যা করেন যে কেন পাকিস্তান সম্প্রতি রাশিয়ার সাথে তার ভাষায় প্রেমের খেলা খেলছে।
তিনি বলেন, পাকিস্তান তার সামরিক সম্পর্কের বহুমুখীকরণে আগ্রহী। পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে আগ্রহী এ বিশ্লেষক ব্যাখ্যা করেন যে এ ব্যাপারে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্তও পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের উপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল ছিল। যাহোক, আমার ধারণা যে পাকিস্তান চীনের উপর অতিনির্ভরশীলতা কমাতে চায়। এটাই তার রাশিয়ার সাথে প্রেমের খেলার কারণ।
ড. রাকিসিটস বিশদ করে বলেন যে কেন রাশিয়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানের দিকে এগিয়েছে। তিনি বলেন, ইউরোপীয় অবরোধের কারণে মস্কো বিচ্ছিন্নতাবোধের শিকার হওয়ায় এশীয় দেশগুলোর দিকে দৃষ্টি দিয়েছে।
মস্কোর সাথে ইসলামাবাদের বিকাশমান সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বিশেষ করে আফগানিস্তান বিষয়সহ দু’দেশের মধ্যে কিছু অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। উভয় দেশই আফগান তালিবানকে সমর্থন করে এবং আফগান সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দু’দেশের সম্পর্কই জটিল।
সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানের ক্ষেত্রে রাশিয়া পাকিস্তানকে কি শিক্ষা দিতে পারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, রাশিয়ার নিরাপত্তা বিভাগ সন্ত্রাস দমন বিষয়ে পাকিস্তানকে প্রত্যক্ষ বহু অভিজ্ঞতার কথা জানাতে পারে। বিশেষ করে ১৯৯০ ও ২০০০-র দশকে চেচেন বিদ্রোহীদের সাথে লড়াইয়ে অভিজ্ঞতা। তবে তিনি বলেন, অভিযানের ক্ষেত্রের পার্থক্যের কারণে রাশিয়ার সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানের মূল্যবোধের পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রাশিয়ার অভিযানের ক্ষেত্র নগর ভিত্তিক, পক্ষান্তরে পাকিস্তানের ক্ষেত্র হচ্ছে পাহাড় ও দুর্গম এলাকা।
ইসলামাবাদ তার সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ে কিভাবে মস্কোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে জিজ্ঞেস করা হলে এ বিশ্লেষক বলেন, সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ে মস্কোর তুলনায় ইসলামাবাদ নতুন। সে কারণে রাশিয়া থেকে পাকিস্তানে তথ্যের বিনিময় হবে প্রচুর। তিনি সতর্ক করে বলেন, রাশিয়া সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ে যে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে পাকিস্তান টিটিপি বা অন্যান্য পাকিস্তান ভিত্তিক সন্ত্রাসী গ্রুপের ক্ষেত্রে তা পরিহার করতে পারে।
তিনি বলেন, চেচনিয়ার জনগণের ব্যাপক মৃত্যু ও আর্থিক ক্ষতির পর রাশিয়া চেচনিয়ায় বিজয় পেয়েছে।
রাশিয়া-পাকিস্তান সামরিক মহড়া দু’দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরো জোরদার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৫ সাল থেকে পাকিস্তান রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাসহ তাদের কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কেনার ব্যাপারে আলোচনা করে আসছে।
ইসলামাবাদ এ পর্যন্ত রাশিয়ার কাছ থেকে ৪টি এমআইএল এম আই -৩৫ এম অ্যাসল্ট হেলিকপ্টার পেয়েছে। গত মাসে তা সরবরাহ দেয়া হয়। ট্রাম্পের আফগান কৌশলের বিরুদ্ধে সমর্থন সংগ্রহের জন্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ মাসের প্রথমে যে সব দেশ সফর করেন তার মধ্যে রাশিয়া ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইউরেশীয় শক্তি।
পাকিস্তানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ আসিফের ইউরেশীয় অন্যান্য দেশ সফরের তালিকায় ছিল চীন ও তুরস্ক। আফগানিস্তান প্রশ্নে এ তিন দেশই একই মনোভাব পোষণ করে। এ থেকে একটি তত্ত¡ জন্ম নিয়েছে যে চীন-রাশিয়া-তুরস্ক- পাকিস্তান একটি জোট গঠন করতে পারে। করিবকো এর আগে ভ্যালু ওয়াককে বলেছিলেন যে এ ধরনের কোনো জোট গঠিত হলে তা আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা লাভের পথ উন্মুক্ত করতে পারে এবং ইউরেশীয় ভূ রাজনীতিতে সামগ্রিকভাবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাশিয়া-পাকিস্তান
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ