Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মালাজিকার্দ যুদ্ধ

| প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কে. এস. সিদ্দিকী
(২৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিতের পর)
মালাজিকার্দ যুদ্ধের ৯৪৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের প্রদত্ত ভাষণ দিয়ে লেখাটি শুরু করা হয়েছিল। ভাষণে তিনি অভ্যুত্থান রুখে দেয়াকে রোমানদের বিরুদ্ধে জয়ের অনুরূপ মন্তব্য করে বলেন: এই যুদ্ধে সুলতান আল্প আরসালানের নেতৃত্বে প্রাক অটোমান উপজাতিরা বাইজান্টাইনদের পরাজিত করে রোমান স¤্রাট ড্যাফোদলের সিংহাসন দখল করে। এ সংক্ষিপ্ত উক্তিতে রোমান স¤্রাটের নাম উল্লেখ থাকলেও তার গ্রেফতার হওয়া এবং সুলতান আল্প আরসালানের সাথে তার কথোপকথন, ক্ষমা প্রার্থনা এবং চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমা প্রাপ্তি ইত্যাদির বিষয়ের কথা মূল ভাষণে আছে কিনা প্রকাশিত খবরে তা বলা হয়নি। যুদ্ধ বিজয়ের কিছুটা বর্ণনা পূর্বে প্রদান করা হয়েছে। রোমান স¤্রাটের গ্রেফতার হওয়া ইতিহাসের একটি বিস্ময়কর ঘটনা।
মালাজিকার্দ যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের ফলে তারা যে বিপুল গণিমতের অধিকারী হয়েছিল তার মধ্যে রোমান স¤্রাটের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাকে গণিমতের অন্তর্ভুক্ত করা না গেলেও বাইজান্টাইনের ইতিহাসে এর গুরুত্ব তুলনাহীন। যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর হস্তগত মালে গণিমতের পরিমাণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ যে পরিসংখ্যান প্রদান করেন সংক্ষেপে তা নি¤œরূপ:
কয়েদি ও গণিমতের মাল বেশুমার। ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্রের দাম কমে গিয়েছিল। একেকটি দিনারের বিনিময়ে তিন তিনটি লৌহবর্ম বিক্রি হয়। মালবহনকারী তিন হাজার গাড়ি হস্তগত হয় এবং একটি মিনজানিক গোপিয়া হস্তগত হয়, যা বারোশ লোক বহন করতে সক্ষম। মুসলমানগণ সাফল্যের সাথে প্রত্যাবর্তন করেন। এর পর থেকে রোমানরা আমিনিয়ার আশে পাশে আক্রমণ চালায়নি।
রোমান স¤্রাটের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাটি অদ্ভুত ধরনের। সুলতানের এক গোলাম এ ব্যাপারে যে ভূমিকা পালন করে তা অভিস্মরণীয়। বর্ণিত আছে যে, উভয় পক্ষে যখন তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তখন এক পর্যায়ে সেলজুকী বাহিনীর হাতে তিনি গ্রেফতার হন। সুলতান যখন ক্যাম্পে আগমন করেন, তখন খুবই ক্লান্ত ছিলেন। কেননা, তিনি সৈন্যদের সাথে বহুদূর পর্যন্ত গমন করেছিলেন পলায়নরত শত্রæ সৈন্যদের পশ্চাদধাবনে। ক্যাম্পে প্রত্যাবর্তনের পর তুর্কি বাহিনীর সেনাপতি তাকে জানান যে, তারই এক গোলাম বাইজান্টাইনি স¤্রাটকে বন্দি করেছেন। কিন্তু তার এ কথা বিশ্বাস হলো না। তিনি সে গোলামকে তলব করেন এবং তাকে পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করার নির্দেশ দেন।
গোলাম জানায় যে, তীব্র যুদ্ধ চালু ছিল, এ সময় আমি এক ব্যক্তিকে ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় দেখি, যার শিরোস্ত্রাণে ক্রসেডের চি‎হ্ন রয়েছে এবং তার চতুর্দিকে রক্ষীরা ঘিরে রেখেছে। তাই আমি তাকে খতম করার জন্য আমার ঘোড়া ছেড়ে দেই। গ্রামের কাউকে চিৎকার করে বলতে শুনি, তাকে হত্যা করবে না, তিনি স¤্রাট। সুলতান গোলামের জবানীতে স¤্রাটকে বন্দি করার অদ্ভুত কাহিনী শুনে তার বুদ্ধিমত্তার জন্য তাকে পুরস্কৃত করেন এবং তাকে পদমর্যাদা স্বরূপ রাজকীয় বিশেষ পাহারাদের অন্তর্ভুক্ত করেন।
সুলতানের দরবারে বন্দি রোমান স¤্রাট: রোমান সা¤্রাজ্যের মহা প্রতাপশালী স¤্রাটকে সুলতান আরসালানের দরবারে হাজির করা হয়। সুলতান তুর্কি রীতিনীতি অনুযায়ী বন্দি স¤্রাটের পৃষ্ঠদেশে আস্তে আস্তে চাবুক দ্বারা তিনবার আঘাত করেন। অতঃপর সুলতান ও বন্দি স¤্রাটের মধ্যে কথোপকথন অনুষ্ঠিত হয়, যা নিন্মরূপ:
সুলতান: আমি কি পরস্পর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে তোমার নিকট খলিফার দূত প্রেরণ করিনি এবং তুমি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করোনি? আমি কি তোমার নিকট আমার দূত প্রেরণ করিনি যে, আমার দুশমনকে আমার কাছে ফেরত দাও। তুমি কি তা করতে অস্বীকার করোনি? তোমার নিকট আমি কি আমার একজন সংবাদ বাহক প্রেরণ করিনি যে, তুমি নিজের দেশে ফিরে যাও, তুমি কি এর জবাবে এই কথা বলোনি যে, আমি এ অভিযানে বিপুল পুঁজি নিয়োগ করেছি, এখন ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না?
স¤্রাট: আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন এবং আমি আপনার সমীপে যে মালমাত্তা পেশ করবো, আপনি তা গ্রহণ করুন। আমাদের উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বের চুক্তি হোক, আপনি আমাকে আপনার সিংহাসনের একজন নগণ্য গোলাম মনে করুন। আমাকে একজন কমান্ডার ও আপনার এজেন্ট হিসেবে গ্রিসে প্রেরণ করুন। আমাকে হত্যা করলে আপনার কোনো লাভ হবে না। কেননা, গ্রিসে আমার স্থানে অপর কাউকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হবে।
সুলতান: আমি তোমাকে ক্ষমা করা ব্যতীত আর কিছু চিন্তা করিনি। কিন্তু তোমাকে এর মূল্য দিতে হবে।
স¤্রাট: সুলতান, আপনি বলুন কী পরিমাণ?
সুলতান: একেকটি দিনার।
স¤্রাট: আপনি যদি আমার প্রাণের বিনিময়ে সমগ্র গ্রিস সা¤্রাজ্যকে আপনার সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করেন তাও হবে যথার্থ, কিন্তু যখন থেকে আমি গ্রিসদের স¤্রাট হয়েছি, তাদের অর্থ সম্পদ ব্যয় করেছি, তাদের সম্পদ জব্দ করেছি এবং তাদেরকে দরিদ্রও করেছি, যাতে সৈন্যকে সুসংগঠিত ও সজ্জিত করে যুদ্ধ করতে পারি।
এভাবে সুলতান আল্প আরসালান ও বন্দি স¤্রাট রোমানুসের মধ্যে ঐতিহাসিক কথোপকথন শেষ হয়। কিন্তু আলোচনা অব্যাহত থাকে এবং বাইজান্টাইনি স¤্রাটকে নি¤েœাক্ত শর্তাবলী পূরণ করতে হয়।
১. স¤্রাট তার মুক্তির বিনিময় হিসেবে পনোরো লাখ দিনার মুক্তিপণ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবেন।
২. সেলজুকী সুলতানকে তিনি বার্ষিক তিন লাখ দিনার খেরাজ (রাজস্ব) প্রদান করবেন।
৩. সেলজুকী সুলতান প্রয়োজনে যত সংখ্যক সৈন্য চাইবেন, তা সরবরাহ করতে হবে।
বাইজান্টইনি স¤্রাটের যখন দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, তার মুক্তির জন্য শুধু বর্ণিত শর্তগুলোই যথেষ্ট তখন তিনি সুলতানকে বলেন যে, আমার স্থলে অপর কাউকে সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়ার পূর্বেই আমাকে এখান থেকে যাত্রা করার সুযোগ করে দেওয়া হোক। তা না হলে আমি আমার ওয়াদা পূরণ করার যোগ্যই থাকবো না। এতে আল্প আরসালান স্মরণ করিয়ে দেন যে, নব অধিকৃত এলাকাগুলো গ্রেফতারকৃত মুসলমানদের দেওয়ার সম্মতি ব্যতীত এ চুক্তি পূর্ণ হবে না। এতে স¤্রাট বলেন, আমি নিরাপদে নিজের দেশে পৌঁছার পর সংশ্লিষ্ট প্রদেশগুলোর নানা স্থানে অবস্থানরত কয়েদিদেরকে সৈন্য প্রেরণ করে তাদেরকে সুলতানের হাওলা করে দেবো। যদি এখন আমি কোনো প্রকারের নির্দেশ জারি করি, তা কেউ মানবে না। মুসলমান কয়েদিদের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, আমি স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথেই তাদেরকে পাঠিয়ে দেবো এবং তাদের সাথে উত্তম আচরণ করবো। উল্লেখ থাকে যে, সুলতান আল্প আরসালান যে মহাবিজয় লাভ করেছিলেন তার তুলনায় এসব শর্ত ছিল খুবই হালকা। তাছাড়া শর্তগুলোর বাস্তবায়ন নির্ভর করছিল স¤্রাটের নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের উপর।
চুক্তি ও স¤্রাটের মুক্তি: চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর বাইজান্টাইনি স¤্রাটকে মুক্তি দান করা হয়। পরের দিন ভোরে সুলতান যথার্থভাবে রাজকীয় বিদায় সম্মাননা জানানোর জন্য আগমন করেন। রবিবার বাইজান্টাইনি স¤্রাট সেলজুকী সুলতানের দরবারে উপস্থিত হন। তার তখন মনে হচ্ছিল তিনি তার হারানো সিংহাসন ফিরে পেয়েছেন। সুলতান তাকে নিজের সিংহাসনের পাশেই বসান এবং তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘোষণা প্রদান করেন, আপনাকে নিজের বন্ধু বলা যায় এই জন্য যে, আমার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মেছে যে, আপনি আমার আস্থা লাভের যোগ্য? আমি আপনাকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দিচ্ছি, যাতে আপনি স্বীয় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেন।
এ সরকারি ঘোষণার পর সুলতান আল্প আরসালান স¤্রাটের ফিরতি সফর প্রসঙ্গে দুইশ’ জোওয়ানের এক নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ করেন এবং স¤্রাটকে বিদায় জানানোর জন্য সুলতান খোদ ৬ কি.মি. দূর পর্যন্ত স¤্রাটের সঙ্গে গমন করেন। বাইজান্টাইনি স¤্রাট তাগিদ করে বলেন, তিনি সুলতানের সোয়ারীর সঙ্গে পদব্রজে গমন করবেন, কিন্তু সুলতান তা বাইজান্টাইনি স¤্রাটের মর্যাদা হানিকর মনে করেন এবং তাকে পদব্রজে গমনের অনুমতি দানে অস্বীকার করেন। বিদায়কালে উভয়ে পরস্পর গলাগলি করেন। অতঃপর বিদায় পর্ব শেষ হয়।
স¤্রাট তার দেশে প্রত্যাবর্তনের আগেই তার সিংহাসন দখল করে নেন অন্য একজন। তিনি নিজের অধিকার আদায়ের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তার ওপর নির্মম অত্যাচার চালানো হয়। তাকে অন্ধ করে ফেলা হয়। এরপর ১০৭২ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
স¤্রাটের মৃত্যু সংবাদ শুনে সুলতান খুবই মর্মাহত হন। তিনি প্রতিশোধের শপথ গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি মধ্য এশিয়ার অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন। বাইজান্টাইনি স¤্রাটের মৃত্যুর ফলে তার সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করা হয়। পুনরায় আনাতুলিয়ায় আক্রমণের ধারা শুরু হয়ে যায়। তুর্কিরা আবার জেগে উঠে এবং তারা মধ্য এশিয়া ও আনাতুলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং সেখান হতে চতুর্দিক ছড়িয়ে পড়ে। এরপর অত্যন্ত দ্রæত এ এলাকায় বিভিন্ন তুর্কি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
সুলতান আল্প আরসালানের মালাজিকার্দ যুদ্ধে মহাবিজয় ছিল ইতিহাসে এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। তখন বাগদাদের খলিফা ছিলেন কায়েস বিন আমরিল্লাহ। তিনি মালাজিকার্দ যুদ্ধে অভূতপূর্ব বিজয়ে আনন্দিত হয়ে যে শুভেচ্ছাবাণী ও সাধুবাদ সুলতান আল্প আরসালানকে পাঠান তা ইতিহাসের এক বিরল রেকর্ড। তার পূর্ণ বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে আলা হোসাইনী রচিত আখবারুদ্দোওলা তিম সাল জুকিয়া ও হোসাইন রচিত তারিখুল ইরাক ফিল আছরিল সেলজুকী ইত্যাদি গ্রন্থে। খলিফা তার শুভেচ্ছা বাণীর সূচনায় প্রশংসাসুলভ খিতাবী বাক্য ব্যবহার করেন, যা ইতিহাসে দুর্লভ দৃষ্টান্ত।
সেলজুকী সুলতান আল্প আরসালান হিজরী ৪৬৫ সালে এক বিশাল বাহিনীসহ চীন বিজয়ের জন্য যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু পথেই ৬ রবিউল আওয়াল তার ইন্তেকাল হয়ে যায়। ফলে তার চীন বিজয়ের আশা পূরণ হয়নি। মৃত্যুর সময় তিনি বলেছিলেন, আমি যে যুদ্ধে গিয়েছি, সর্বদা আমার ইচ্ছা ও ভরসা ছিল আল্লাহতায়ালার ওপর। কিন্তু এখানে যখন একটি টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আমি আমার সৈন্যদের পর্যবেক্ষণ করি, তখন আমার অন্তরে ধারণা হলো যে, এখন দুনিয়ায় কেউ আমার মোকাবিলা করতে সক্ষম নয়, আমি নিশ্চিতভাবে সমগ্র চীন দেশ অধিকার করবো। সম্ভবত আমার এ ধারণা আমার ব্যর্থতার কারণ।
(সমাপ্ত)



 

Show all comments
  • jabbar molla ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:১১ এএম says : 0
    আমা‌দের ইতিহাস কত চমৎকার! অথচ... আজ আমা‌দের প‌রিন‌তি কত বেদনার!
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যুদ্ধ


আরও
আরও পড়ুন