দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
বছর ঘুরে আবার আমাদের কাছে হাজির হয়েছে বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক মাস হিজরী নববর্ষ বা মহররম। ইসলামি বর্ষপঞ্জি মতে, মহররম মাস হলো আরবি সনের সর্বপ্রথম মাস। মহান আল্লাহ তা’আলার কাছে চারটি মাস সকল মাসের চেয়ে ফজিলতপূর্ণ ও সম্মানিত। আর তা সয়ং আল্লাহ’ই ঘোষনা করেছেন। এভাবে, “আল্লাহ তা’আলা আসমান-জমিন সৃষ্টি করার দিন থেকেই মাসের সংখ্যা বার নির্ধারণ করে রেখেছেন। তন্মধ্যে চারটি মাস অধিক সম্মানিত। সুতরাং তোমরা এই সম্মানিত মাসগুলোর মধ্যে (ঝগড়াবিবাদ ও খুনাখুনি) করে নিজেদের উপর জুলুম করো না।” ‘মহররম’ আয়াতে বর্ণিত চারটি মাসের মধ্যে অন্যতম। অন্য তিনটি হলো- জিলকদ, জিলহজ্জ ও রজব। মহররম মাসের সম্মানের ব্যপারে প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা আল্লাহ’র মাস মহররমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। কেননা, যে ব্যক্তি মহররমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত দান করে সম্মানিত করবেন আল্লাহ তা’আলা।’ (মুসলিম, ইবনে মাজা ফরমানে মুস্তফা (সা.) হচ্ছে, ‘রমজানের রোজার পরই আল্লাহ তা’আলার কাছে প্রিয় হলো মহররম মাসের রোজা।’ (মুসলিম)
মহররম মাসের রোজা হলো, ইয়াওমুল আশুরা তথা মহররমের দশ তারিখের রোজা। তবে যেহেতু ইয়াহুদিরা দশ তারিখ রোজা রাখে, সে জন্য প্রিয়নবী (সা.) দশ তারিখের রোজার সাথে মিলিয়ে আরো একটি অর্থাৎ ৯ ও ১০ তারিখ দু’টি রোজা রাখার জন্য বলেছেন। নিঃসন্দেহে এই রোজা অনেক ফজিলতপূর্ণ, যা একাধিক হাদিস ও আওলিয়ায়ে কেরামদের আমল দ্বারা প্রমাণিত। এ মাস যেহেতু সম্মানিত মাস, তাই এ মাসে সামার্থ অনুযায়ি দান-খাইরাত, নফল নামাজ, রোজা, কুরআন তেলওয়াত, মিলাদ-কিয়াম, মাহফিল ইত্যাদি আমল করা যেতে পারে।
মহররম মাসের ১০ তারিখকে ইয়াওমুল আশুরা বলা হয়। ইয়াওমুল আশুরা বিশ্ব ইতিহাসের অতীব তাৎপর্যমন্ডিত একটি দিন। এ দিনেই সৃষ্টি হয়েছিলো এ মহা বিশ্ব এবং এর ধ্বংসও হবে এ দিনেই। এ দিনেই হযরত আদম (আ.) ধন্য হয়েছিলেন মহান আল্লাহর ক্ষমা লাভে। হযরত নুহ (আ.) মহা প্লাবন থেকে, হযরত আইয়ুব (আ.) তাঁর কঠিন বিমার থেকে, হযরত মুসা (আ.) ফিরাউনের কবল থেকে, হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে, হযরত ইবরাহিম (আ.) নমরূদের অগ্নিকুন্ড থেকে, হযরত ইউসুফ (আ.) মৃত্যুকূপ থেকে পরিত্রান পেয়ে ছিলেন এ দিনেই। এমনিতর অসংখ্য ঘটনায় সমুজ্জল এই ইয়াওমুল আশুরা। তবে এ দিনটি বিশ্ববাসীর কাছে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ যে কারণে, সেটি হলো- এ দিনেই সংঘটিত হয়েছিলো বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক কারবালা যুদ্ধ। সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এখানে সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেছিলেন মহান আল্লাহ’র প্রিয় হাবীব, সমস্ত শ্রীমান ব্যক্তিদর মহা স¤্রাট, নবী কুলের সর্দার, উভয় যগতের সুলতান নবী মুস্তফা (সা.) এর প্রিয় দৌহিত্র, মা ফাতিমার (রা.) কলিজার টুকরা হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)।
অন্যায় অসত্যের ব্যাপারে আপোষহীন ইমাম হোসাইন (রা.) জালিম ইয়াযিদ বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত-মজলুম মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে নিজ দেহের শেষ রক্ত বিন্দুটুকু পর্যন্ত বিসর্জন দিতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করেননি। আর এই ত্যাগ ও শাহাদাতের মধ্যে দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছেন সত্য ও ন্যায়ের জ্বলন্ত প্রতীক। জগদ্বাসীর কাছে তিনি হয়ে আছেন, চির স্মরণীয় ও বরণীয়।
পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজীরবিহীন আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ইসলামের সঠিক বার্তাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। নৈতিক, চারিত্র্যিক এবং মানবীক সকল অসৎ গুণাবলী যাদের ছিলো মজ্জাগত, তারা ইসলামি খেলাফতকে পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসেবে ভোগ করতে গিয়ে ইসলামের সুমহান আদর্শকেই কলঙ্কিত করতে বসেছিলো। ইসলামের নামে এই স্বেচ্ছাচার নবী দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। উপরন্ত খেলাফতের অধিকার ছিলো ইমাম হোসাইন (রা.) এর। অথচ উমাইয়া শাসক মুয়াবিয়ার সাথে ইমাম হাসান (রা.) এর চুক্তি ভঙ্গ করে মুয়াবিয়া পুত্র ইয়াযিদ ক্ষমতার আসনে বসেই তার সামনের সবচে বড় চ্যালেঞ্জ ইমাম হোসাইন (রা.) এর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগে যায়। ইমাম হোসাইন (রা.) এই সঙ্কটকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করেন, যাতে বিশ্ববাসী প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অবহিত হবার সুযোগ পায় এবং ইসলামের প্রকৃত বার্তা ধীরে সুস্থে হলেও সবার কাছে পৌঁছে যায়। সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ইমাম হোসাইন (রা.) এর সেই আন্দোলনকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা হয়। কালের আমোঘ পরিক্রমায় দেখা গেছে, ভালো এবং মন্দের মধ্যে দ্ব›দ্ব-সংঘাত চলে এসেছে আদিকাল থেকে। সত্যের পক্ষে কোনো কোনো সংগ্রাম ছিলো দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
আবার কোনো কোনো সংগ্রাম ছিলো অত্যাচারীদের রাজনৈতিক ঘুর্ণাবর্তে অস্পষ্ট। ইমাম হোসাইন (রা.) এর যে আন্দেলন তা ছিলো তৎকালীন শাসকবৃন্দের ইসলামবিনাশী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট সংগ্রাম। যদিও সে সময়কার জনগণের কাছে অজ্ঞানতার কারণে তা ছিলো রাজনৈতিক মেঘে ঢাকা সূর্যের মতো অস্পষ্ট। যার ফলে তখন ইসলাম অনুরাগীরাও দ্বিধা- দ্ব›েদ্বর দোলাচলে ভূগেছিলো। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আজ ব্যাপক গবেষণা আর ইতিহাস পর্যালোচনায় প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত হয়ে গেছে সবার সামনে। গবেষকরা আজ ইমাম হোসাইনের (রা.) সেই সংগ্রামের যথার্থতা খুঁজে পেয়েছেন। এতোকাল পর তাঁর আন্দোলনের যথার্থতা খুঁজে পাওয়ার মধ্যেই অনুমিত হয় যে ইমাম হোসাইন (রা.) এর সেই আন্দোলন কতো সুদূরপ্রসারী ছিলো। সমাজ বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ইমাম হোসাইন (রা.) এর আন্দোলনের মূল্যবোধগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়। অধ্যাপক মুর্তজা মোতাহহারীর দৃষ্টিতে এসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধটি হলো তাঁর সহজাত সত্যনিষ্ঠা ও অবিচল সততা। আসলে প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব কিছু সহজাত বৈশিষ্ট্য থাকে। ঐ বৈশিষ্ট্যের আলোকেই তাঁর জীবনের সকল কিছু পরিচলিত হয়।
ইমাম হোসাইন (রা.) এর জীবনের বৈশিষ্ট্যও ছিলো এরকম দৃঢ় সততায় সমৃদ্ধ। তার কারণ ইমাম হোসাইন (রা.) এর জীবনের যে মূল্যবোধগুলো ছিলো, সেগুলো স্বয়ং রাসূলে খোদার আদর্শ ও শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত। প্রিয়নবী (সা.) এর শিক্ষা মানেই হলো পবিত্র কুরআনের শিক্ষা। আর কুরআনের শিক্ষা হলো অনৈসলামি বা খোদাদ্রোহী ব্যক্তির কাছে মাথানত না করা, শাহাদাৎকামিতা, নিজস্ব আদর্শকে সমুন্নত রাখার ব্যাপারে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ থাকা। হোসাইনি আন্দোলনের মূল্যবোধগুলোকে বিখ্যাত গবেষক অধ্যাপক মুর্তজা মোতাহহারী দুইটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। একটি ক্ষুদ্র, অপরটি বৃহত্তর মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধগুলোই ইমাম হোসাইন (রা.) এর আন্দোলনকে কালজয়ী স্থায়িত্ব বা চিরন্তন ঐশ্বর্য দিয়েছে। এইসব মূল্যবোধ ইমাম হোসাইনের মধ্যে যেমন ছিলো তেমনি তাঁর সঙ্গী সাথীদের মধ্যেও ছিলো। ক্ষুদ্র মূল্যবোধগুলোর মধ্যে একটি হলো তাঁর সুদূরপ্রসারী ও সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী। সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী বলতে রূপকার্থে বলা যায়, ইমাম হোসাইন (রা.) একটা ইটের মধ্যেও যা স্বাভাবিকভাবেই দেখতে পেতেন অন্যরা তা আয়নাতেও দেখতে পেতেন না।
শহীদ অধ্যাপক মোতাহহারীর মতে হোসাইনী আন্দোলনের পিছনে ছিলো একটা গভীর বোধ ও উপলোব্ধি। এই বোধই তাঁর আন্দোলনকে মহান করে তুলছে। এই উপলব্ধিটা হলো উমাইয়া শাসকরা যে খেলাফতির নেপথ্যে ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ চালাতো, তা জনগণ প্রকাশ্যে দেখতে পেত না। কিন্তু ইমাম হোসাইন (রা.) এর দৃষ্টি প্রখরতার কারণে তিনি দেখতে পেতেন। ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াযিদের ক্ষমতাসীন হবার কথা শুনে বলেছিলেন “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং তার দিকে প্রত্যাবর্তন করবো ! হে ইসলাম বিদায় ! যখন উম্মতের জন্যে ইয়াযিদের মত ব্যক্তি নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়।” ইমাম হোসাইন (রা.) এর এই উক্তি দূরদৃষ্টিরই পরিচায়ক। কেননা, অন্যরা ইয়াযিদকে সে ভাবে চিনতে পারে নি, যেভাবে চিনতে পেরেছিলেন ইমাম হোসাইন (রা.)। সমকালীন জনগনের উপলব্ধিগত দুর্বলতা, তাদের স্থুলদৃষ্টি, এবং বিস্মৃতি ইমাম হোসাইন (রা.) এর শাহাদাত লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।”
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।