Inqilab Logo

বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাদা সোনায় কালো থাবা

চোরাপথে আসছে নিম্নমানের গলদা পোনা

মিজানুর রহমান তোতা | প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম মাধ্যম সাদা সোনা চিংড়ি। বিরাট সম্ভাবনাময় চিংড়ি শিল্পের নীরব সর্বনাশ ঘটাচ্ছে ভারত। চোরাপথে আসছে অত্যন্ত নিম্নমানের চিংড়ি পোনা। যা ম্যাক্রোব্রেকিয়াম ম্যালকোমসোনি জাতের গলদা পোনা। ওই জাতটি আকারে ছোট এবং দেহবৃদ্ধির হার একেবারেই কম। স্বল্পমূল্য ও সহজলভ্য হওয়ায় খুলনা ও সাতাক্ষীরা সাধারণ চিংড়ি ঘের মালিকরা চোরাইপথে আসা ভারতীয় ওই গলদা চিংড়ি ক্রয় করছেন। এতে বড় জাতের গলদা চিংড়ির চাষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হারাচ্ছে বৈদেশিক বাজার। মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও চিংড়ি বিশেষজ্ঞরা দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, বাংলাদেশে সমুদ্র উপকুলে কিংবা নদীর মোহনা থেকে আরোহিত ন্যাচারাল গলদা পোনার জাতটি অত্যন্ত উন্নতমানের। ন্যাচারাল নাসিং গ্রাউন্ডের ম্যাক্রোব্রেকিয়াম রোসেনবারগিল জাতটি আকারে বড় এবং দ্রুত দেহবৃদ্ধিহারসম্পন্ন।
সুত্র জানায়, সম্প্রতি সুন্দরবন এলাকায় ৩দফায় ভারত থেকে চোরাপথে আসা বেশকিছু গলদা চিংড়ি পোনা আটক করে কোস্ট গার্ড। মৎস্য বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও চিংড়ির ক্ষতির কথা স্বীকার করে বলেছেন, জরুরিভাবে ভারতীয় চিংড়ি পোনার চোলাচালান বন্ধ করা দরকার। একটি সুত্র জানায়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই নদী ও সড়কপথে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে নিম্নমানের চিংড়ি পোনা ওপার থেকে চালান করা হচ্ছে। এমনিতেই একশ্রেণীর চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, ডিপো মালিক ও ঘের চাষীসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার নানা ত্রুটির কারণে শিল্পটি হুমকির মুখে। তার ওপর ভারত থেকে চিংড়ি পোনা চোরাচালান বন্ধ না হলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে শিল্পটিতে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কয়েক বছর আগে নন ট্যারিফ ব্যারিয়ার দেয় যে, ন্যাচারাল নাসিং গ্রাউন্ডের পোনায় উৎপাদিত গলদা চিংড়ি চাষ চলবে না। হ্যাচারির পোনায় চিংড়ি উৎপাদন করতে হবে। ওই শর্ত পুরণ করার জন্য মৎস্য অধিদপ্তর বরগুনা, পটুয়াখালি ও পিরোজপুরসহ সমুদ্র উপকুলের ন্যাচারের গলদা পোনা আহরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সেই থেকে পোনা সংকট দেখা দেয়। এই সুযোগ নেয় ভারত। সেখান থেকে নিম্নমানের গলদা চিংড়ি পোনা ঢুকাতে থাকে।
চিংড়ি বিশেষজ্ঞগণ গলদা চিংড়ি সম্পর্কে বলেছেন, গলদা চিংড়ির বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাক্রোব্রেকিয়াম রোসেনবারগিল। পৃথিবীতে ম্যাক্রোব্রেকিয়াম পরিবারে প্রায় শতাধিক প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। ওই চিংড়ি মিঠা পানিতে বসবাস করে। মিষ্টি পানির খাল, বিল, পুকুর ও ঘেরে পাওয়া যায়। অধিকাংশ গলদা চিংড়িই তাদের জীবন চক্রের শুরুতে মিঠা লবন মিশ্র পানির প্রয়োজন পড়ে। তাই সমুদ্রের সাথে সরাসরি অথবা ঘুরপথে যুক্ত এমন পানিতেই তাদের পাওয়া যায় বেশী। দেশের মধ্যে নদীপথে ঐ চিংড়ি পরিযান করে ২শ’ কিলোমিটার থেকে ৪ শ’ কিলোমিটার পর্যন্ত। বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, জাপান, তাইওয়ান ও আমেরিকাসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই গলদা চিংড়ি পাওয়া যায় এবং ব্যাপকভাবে চাষ হয়। বাংলাদেশ ও ভারতে গলদা চিংড়ি ম্যাক্রোব্রেকিয়ামের ৩৪ রকম জাত রয়েছে। এর মধ্যে ম্যাক্রোব্রেকিয়াম রোসেনবারগিল প্রজাতির দেহবৃদ্ধির হার এবং মোট দেহ বৃদ্ধি অন্যান্য সকল প্রজাতির চেয়ে তুলানামুলকভাবে শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বেশী। ওই প্রজাতির চিংড়ি লম্বায় ৩২ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৩শ’২০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। ভারতে এই প্রজাতির চিংড়ি পোনা যা পাওয়া যায় তা শতকরা মাত্র ২০ ভাগ। সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায় ম্যাক্রোব্রেকিয়াম ম্যালকোমসোনি জাতের চিংড়ি। ভারতের গোদাবরী নদীসহ পশ্চিমবঙ্গ উড়িষ্যা অঞ্চলের নদ-নদীতে ওই জাতের চিংড়ি পোনা আকারে ছোট এবং দেহবৃদ্ধির হার একেবারেই কম। যার একটা অংশ চোরাচালান হয়ে আসছে বাংলাদেশে। তাতে বিরাট ক্ষতি হচ্ছে নীরবে।
সুত্র জানায়, বাংলাদেশে গলদা চিংড়ির মোট প্রাপ্ত প্রজাতিগুলোর মধ্যে ম্যাক্রোব্রেকিয়াম রোসেনবারগিল জাত পাওয়া যায় শতকরা ৮০ ভাগ। বাংলাদেশের ক´বাজারসহ অন্যান্য এলাকায়ও ওই জাতের চিংড়ি পোনা পাওয়া যায় বেশী। যদিও বাংলাদেশে এর সংরক্ষণ ও যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেজন্য তড়িঘড়ি হাতের কাছে স্বল্প মূল্যে পাওয়ার কারণে ভারতীয় ছোটজাতের পোনা ক্রয় করে একশ্রেণীর ঘের মালিকরা গোটা শিল্পটির মারাত্মক ক্ষতি করছে। বাংলাদেশে চিংড়ি শিল্পের মধ্যে গলদা চিংড়ি ঘেরের সংখ্যা বেশী। মিষ্টি পানি নির্ভর গলদা চিংড়ির ঘেরের সংখ্যা ৩২ হাজার ১২৮ টি এবং লবণ পানি নির্ভর বাগদা চিংড়ির ঘেরের সংখ্যা ১৮ হাজার ৯৬১ টি। ফলে বেশীসংখ্যক ঘের ক্ষতির আশংকায় পড়ছে। সুত্রমতে, এমনিতেই নাœা কারণে বৃহদাকার বাগদা ও গলদা চিংড়ির পর্যাপ্ততা কমে যাচ্ছে। তার উপর ভারতীয় চিংড়ি পোনা সর্বনাশ ঘটাচ্ছে। ছোট অবস্থায় পোনার পেটে ডিম এসে যাচ্ছে এবং রফতানীর ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে। ভারত থেকে চোরাপথে আসা গলদা চিংড়ির পোনা বা পিএল যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে তার জন্য জোরালো ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। একইসাথে ভারতীয় ছোটজাতের বাগদা ও গলদা চিংড়ি পোনা আরো কি কি ক্ষতি করছে, শিল্পটি বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করছে কিভাবে, তা বিষদভাবে খতিয়ে দেখা দরকার বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গলদা পোনা

২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ