দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
আরবী মাসসমূহের মধ্যে অন্যতম মাস হলো জিলহজ্জ। এ মাস হজ্জের মাসসমূহের মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন ইবাদাত-বন্দেগী ও ফযিলতের কারণে এ মাস অন্য মাসসমূহ হতে ব্যতিক্রম। বিশেষ করে এ মাসের প্রথম দশক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা এ দশদিনের কসম করেছেন। এ দশদিনের মধ্যে ইসলামের অন্যতম ফরয বিধান হজ্জের কার্যাবলী পালন করতে হয়। এছাড়াও এ দশকে ঈদুল আযহা, কুরবানী, তাকবীরে তাশরীক প্রভৃতি বিধানাবলী সম্পন্ন করতে হয়। অত্র প্রবন্ধে জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের অন্যতম বিধান ‘তাকবীরে তাশরীক’ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। ইনশাআল্লাহ।
‘তাকবীরে তাশরীক’ এর পরিচয়
তাকবীর শব্দের অর্থ হলো- বড়ত্ব ঘোষণা করা। আর তাশরীক শব্দের অর্থ হলো- সূর্যের আলোতে রেখে গোশত শুকানো। আরবগণ তাদের কুরবানীর গোশত ঈদের তিনদিন পর পর্যন্ত রোদে দিয়ে শুকাতো, এজন্য এ দিনগুলো আইয়ামে তাশরীক বলা হয়। তাকবীরে তাশরীক হলো- ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’- বাক্য বলা।
‘তাকবীরে তাশরীক’ এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ইসলামে বিভিন্ন আমল বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিচারণে হয়ে থাকে। যেমন: সাফা-মারওয়ায় সায়ী, কুরবানী, জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ প্রভৃতি ইসমাঈল ও ইবরাহীম আ. এর স্মৃতিচারণে হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে ‘তাকবীরে তাশরীক’ এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। যার স্মৃতিচারণ স্বরূপ এখনো তাকবীরে তাশরীকে প্রচলন চলে আসছে। বর্ণিত আছে, যখন ইবরাহীম আ. তাঁর পুত্র ইসমাঈল আ. কে জবাই করতে উদ্যত হলেন, তখন জিবরাঈল আমীন বললেন- আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। অত:পর ইসমাঈল আ. বললেন- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার (আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই আর আল্লাহ মহান)। তখন ইরবাহীম আ. বললেন- আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ (আল্লাহ মহান আর তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা)। এরপর থেকে এটি ইসলামের বিধান হিসাবে নির্ধারিত হলো। (তাফসীরে কুরতুবী)
বুঝা গেল- ‘তাকবীরে তাশরীক’ হলো ইবরাহীম আ. কর্তৃক তাঁর পুত্র ইসমাঈল আ.কে যবেহকালীন সময়ের কিছু উক্তির স্মৃতিচারণ। যা আজও আমাদের শরীয়তের বিধান হিসাবে প্রচলিত রয়েছে।
‘তাকবীরে তাশরীক’ এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য
প্রতিবছর ০৫দিন ব্যাপি পালনকৃত বিশেষ আমল ‘তাকবীরে তাশরীক’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। এ আমলের রয়েছে একটি বরকতময় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। ‘তাকবীরে তাশরীক’ পাঠের স্বতন্ত্র কোন ফযিলত বর্ণিত না থাকলেও ‘তাকবীরে তাশরীকে’ বিদ্যমান শ্রেষ্ঠ বাক্যসমূহের আলাদা আলাদা ফযিলত রয়েছে। নি¤েœ তাকবীরে তাশরীকের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা হলো-
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ ঃ
জিলহজ মাসের ফযিলতপূর্ণ পবিত্র দিনগুলোতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশি পরিমাণে আল্লাহ তায়ালার মহত্ব বর্ণনা তথা তাকবীর, আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের ঘোষণা তথা তাহলীল এবং আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা তথা তাহমীদ পাঠ করার জন্য আদেশ প্রদান করেছেন। যেমন তিনি বলেন- এ দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে তাহলীল, তাকবীর ও তাহমীদ পাঠ কর। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং- ৫৪৪৬) অতএব রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ পালনার্থে তাহলীল, তাকবীর ও তাহমীদ সম্বলিত যৌগিক আমল ‘তাকবীরে তাশরীক’- এর গুরুত্ব অপরিসীম।
ইবরাহীম আ. এর স্মৃতিচারণ ঃ
তাকবীরে তাশরীকের প্রচলের সাথে ইবরাহীম আ. এর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মরণীয় ঘটনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইবরাহীম আ. স্বীয় পুত্র ইসমাঈল আ.কে যবেহ করার সময়ে তাদের দু’জন এবং জিবরাঈল আ. এর পঠিত দোয়ার শব্দগুলোর সমন্বয়ে তাকবীরে তাশরীক। মুসলমানগণ প্রতি বছর ০৫ দিন ইবরাহীম আ. এর সেই বরকতময় স্মৃতিচারণ করে থাকে তাকবীরে তাশরীক পাঠের মাধ্যমে। তাকবীরে তাশরীক পাঠের মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝে সেই চেতনা কাজ করে। অতএব ইবরাহীম আ. ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল আ. এর স্মৃতিবিজড়িত ‘তাকবীরে তাশরীক’ ইসলামে শরীয়তে বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার।
কয়েকটি বিশেষ আমলের সমন্বয় ঃ
তাকবীরে তাশরীক হলো কয়েকটি বিশেষ আমলের সমন্বিত রূপ। এতে রয়েছে ০৪ বার তাকবীর, ০১ বার তাহলীল এবং ০১ বার তাহমীদ। তাকবীরে তাশরীকের এ উপাদানগুলো ইসলামী শরীয়তে অত্যন্ত ফযিলতের। নি¤েœ এর উপাদান গুলোর ফযিলত তুলে ধরা হলো-
ক) তাকবীরের ফযিলত ঃ
তাকবীর হলো আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ব ও বড়ত্ব ঘোষণা করা। আল্লাহ তায়ালা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার আদেশ প্রদান করে বলেন- আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। (সুরা মুদ্দাসসির, আয়াত নং- ০৩)
‘আল্লাহু আকবার’ আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রিয় বাক্যসমূহের মধ্যে অন্যতম। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- চারটি বাক্য আল্লাহ তায়ালার কাছে সর্বাধিক প্রিয়। তা হলো- সুবহান আল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এবং আল্লাহু আকবার। এছাড়াও বিভিন্ন হাদীসে তাকবীরের গুরুত্ব ও ফযিলত বর্ণিত হয়েছে।
খ) তাহলীলের ফযিলত ঃ
তাহলীল তথা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ হলো তাওহীদের বাণী। তাহলীলের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের ঘোষণা প্রচারিত হয়। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা ইসলামের শাখাসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এসেছে- ঈমানের ৭০ এর অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোত্তম হলো- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা। আর সর্বনি¤œ হচ্ছে- রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ১৬২) তাওহীদের বাণী হিসাবে তাহলীল ইসলামী শরীয়তের বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
গ) তাহমীদের ফযিলত ঃ
তাহমীদ হলো আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও স্তুতি জ্ঞাপন করা। আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করলে তিনি বান্দার উপর নিয়ামতের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ তায়ালা প্রশংসাজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে আলহামদুলিল্লাহবলার অগণিত সওয়াব বর্ণিত আছে। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে- আলহামদুলিল্লাহ নেকীর পাল্লাকে পরিপূর্ণ করে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ৫৫৬) অতএব তাহমীদ তথা আলহামদুলিল্লাহ বলা অত্যন্ত ফযিলতের একটি আমল।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান- তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ সমন্বিত ‘তাকবীরে তাশরীক’ অত্যন্ত গুরুত্ব ও ফযিলতের একটি আমল।
‘তাকবীরে তাশরীক’ সম্পর্কিত মাসয়ালা-মাসায়েল
০১। ০৯ জিলহজ হতে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরয নামাযের পরক্ষণেই অনতিবিলম্বে তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা ওয়াজিব।
০২। উক্ত দিনসমূহে প্রত্যেক ফরয নামাযের পর প্রত্যেক মুসলমান, চাই সে গোলাম হোক, কিংবা স্বাধীন হোক, মুসাফির হোক, কিংবা মুকীম হোক, একাকী আদায়কারী হোক কিংবা জামায়াতে আদায়কারী হোক- সবার জন্য তাকবীরে তাশরীক ওয়াজিব।
০৩। পুরুষগণ তাকবীরে তাশরীক জোরে বলবে।
০৪। মহিলাগণ তাকবীরে তাশরীক আস্তে বলবে।
০৫। মাসবুক ব্যক্তি নিজ নামায শেষ করার পর তাকবীরে তাশরীক পাঠ করবে।
০৬। ঈদের নামাযের শেষে তাকবীর বলতে দোষের কিছু নেই। (হাশিয়াতু ইবনে আবেদীন,খন্ড- ০৩, পৃষ্ঠা নং- ৭২- ৭৫)
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তাকবীরে তাশরীক যথাযথভাবে পাঠ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।