Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কোরবানি : পশুত্বের বিনাশ

মাওলানা এসএম আনওয়ারুল করীম | প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম আলাইহিস সালামের সময় থেকেই আল্ল­াহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হালাল পশু কোরবানি করার প্রচলন চলে আসছে। যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ এবং আল্ল­াহর নেক বান্দারা রবের প্রতি নিজেদের প্রেম-ভালোবাসা ও আনুগত্য নিবেদনের জন্য কোরবানি করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রত্যেক জাতির জন্যই আমি কোরবানির ব্যবস্থা রেখেছি’ (সূরা হজ ; আয়াত ৩৪)। কিন্তু হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের সময় এসে বিশেষ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই কোরবানি আলাদাভাবে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়েছে। তাই প্রেম, ভালোবাসা, আনুগত্য ও উৎসর্গের এই অনুপম আদর্শকে আল্ল­াহ চিরস্মরণীয় করে রাখলেন। ঘটনাটির স্মারক হিসেবে একই দিবসে আমাদেরও কোরবানির আদেশ করলেন।
কিন্তু আমরা শুধু কোরবানি করি, কোরবানি হই না; পশু জবেহ করি, পশুত্বকে জবাই করি না। অথচ এরই নাম কোরবানি। দরবারে ইলাহি থেকে ফরমান শোনানো হচ্ছে- ‘কোরবানির পশুর গোশত কিংবা রক্ত কখনোই আল্ল­াহর কাছে পৌঁছবে না, পৌঁছবে শুধু তোমাদের কলবের তাকওয়া’ (সূরা হজ, আয়াত ৩৭)। এটিই কোরবানির শিক্ষা- আগে কোরবানি হও তারপর কোরবানি কর। হজরত ইব্রাহিম ও হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম যখন আল্ল­াহর আদেশের সামনে কোরবান হয়ে গেলেন এবং পিতা ইব্রাহিম পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামের গলায় তীক্ষœ ধারালো ছুরি চালালেন তখনই আল্ল­াহ ‘নিদা’ করে বললেন-‘(থামো) হে ইব্রাহিম! স্বপ্নকে তো তুমি সত্য করে দেখালে।’ (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০৫) এবং কোরবানি করার জন্য জান্নাত থেকে দুম্বা পাঠালেন। আর বললেন- ‘এভাবেই আমি মুহসিনীনদের পুরস্কৃত করি’ (সূরা আল-সাফফাত, আয়াত ১০৫)।
উল্লি­খিত আয়াতের তাফসিরে শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান (রহ.) লিখেছেন, এখানে সন্তানকে কোরবানি করা উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের আনুগত্য পরীক্ষা করা। অনেক আশা-আকাক্সক্ষা ও দোয়া-মোনাজাতের পর যে সন্তান আল্ল­াহ তাকে দান করেছেন, সেই সন্তানের মায়া আল্ল­াহর আনুগত্যে বাদ সাধে কিনা। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী (রহ.)ও অনুরূপ উদ্দেশ্য বয়ান করেছেন। তিনি লিখেছেন, এ ঘটনায় পিতার হাতে পুত্রের জবেহ উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল পিতৃস্নেহ তথা সেই পার্থিব প্রেমের জবাই, যা’ কখনো কখনো আল্ল­াহ প্রেমের সঙ্গে প্রতিদ্ব›িদ্বতায় অবতীর্ণ হয়। আর সাইয়েদ কুতুব শহীদ (রহ.) তাফসির ফি জিলালিল কোরআনে- লিখেছেন, এটি ছিল এক বিরাট পরীক্ষা। পরীক্ষার মাধ্যমে বান্দাকে কষ্ট দেয়া রবের উদ্দেশ্য নয়। আল্লাহ শুধু দেখতে চান আমার হুকুম পালনে বান্দার মনে কোন সংশয় দানা বাঁধে কিনা। আমার আহŸান শোনামাত্র বান্দা লাব্বাইক বলে, না কোন প্রশ্ন উত্থাপন করে? যদি কোন সংশয় দানা না বাঁধে, যদি কোন প্রশ্ন উত্থাপন না করে, তাহলে সেই বান্দাকেও আল্লাহ পিতা ইব্রাহিমের মতোই সম্মানিত করবেন। তাই ইব্রাহিমের ঘটনাটিকে আমাদের জন্য আলোর মিনার হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন।
কিন্তু আমরা কি আল্ল­াহর হুকুম পালনে সংশয়হীন হতে পেরেছি? আমরা কি পেরেছি প্রেমের সব বন্ধন ছিন্ন করে আল্ল­াহ প্রেমের বন্ধনকে মজবুত করতে? আমরা আজ সুন্দর সুন্দর পশু জবেহ করছি, কিন্তু আল্ল­াহর কাছে যা পৌঁছবে, তা সুন্দর করার চিন্তা করছি না। অথচ গলায় ছুরি চালানোর পরই নেমে এসেছিল জান্নাতি দুম্বা। সুতরাং আমাদেরও আগে নিজেদের গলায় তথা অদৃশ্য সেই পশুটির গলায় ছুরি চালাতে হবে, এরপরই নেমে আসবে আসমানি মদদ।
বিশ্ব মুসলিম আমরা আজ পরাজিত শত্রু-ভয়ে ভীত-কম্পিত। কারণ, আমরা আজ রবের আনুগত্য ছেড়ে নফসের গোলামিতে লেগে গেছি। বাইরের পশু জবেহ করছি কিন্তু ভেতরের পশুকে মোটাতাজা করছি। আমরা আজ আমাদের মুসলিম নামের ইতিহাস ও তাৎপর্যও ভুলতে বসেছি। কেন আমাদের মুসলিম বলা হয়? কী এর তাৎপর্য? হজরত ইবরাহিম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালাম কাবাগৃহ নির্মাণের পর দোয়া করলেন- ‘হে আল্ল­াহ আপনি আমাদের আপনার অনুগত বানান এবং আমাদের বংশধর থেকে মুসলিম উম্মাহ বা আপনার অনুগত জাতি সৃষ্টি করুন।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১২৮) কিন্তু আমরা কি মুসলিম হতে পেরেছি? আমরা কি পেরেছি পিতা ইব্রাহিমের মতো অনুগত হতে, নিজেকে কোরবান করতে? জীবনে একটিবার যদি ইব্রাহিমী কোরবানির বাস্তব নমুনা কায়েম করতে পারতাম, যদি ভেতরের পশুটিকেও জবাই করতে পারতাম, তাহলে আবার আমরা বিশ্বটাকে ন্যায়নীতি ও সুবিচার দিয়ে সাজিয়ে তুলতে পারতাম।
তাই আসুন কোরবানিতে আগে আমরা নিজেরা কোরবানি হই, তারপর কোরবানি করি। পশু জবেহ করার আগে নিজেদের পশুত্বকে জবাই করি। তাহলে আমাদের কোরবানি কোরবানি হবে। প্রত্যেক বস্তুর দু’টি দিক রয়েছে- প্রকাশ্য ও গোপনীয়। কোরবানির দু’টি অর্থ থাকা সম্ভব যথা- বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ। আমরা কোরবানির শুধু বাহ্যিক দিক পশু কোরবানির ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। নিজের অভ্যন্তরীণ মন্দ স্বভাবগুলো যেমন লোভ, লালসা, হিংসা, নফস বা রিপুগুলোকে কোরবানি বা ত্যাগ করতে সচেষ্ট থাকি না। কোরবানির মূল তাৎপর্য হলো- মাবুদের প্রেমে বান্দাহ তার যাবতীয় প্রিয় বস্তুগুলো ত্যাগ করবে। হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর রাহে নিজের একমাত্র প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাঈল (আ)-এর প্রতি ভালোবাসা ও প্রেমের আকর্ষণ ত্যাগ করে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করার জন্য পুত্রকে নিজ হাতে জবেহ করার জন্য জমিনে শুইয়ে দিয়ে ছুরি চালাতে উদ্যত হন। আল্লাহর প্রতি হজরত ইব্রাহিম (আ)-এর অগাধ প্রেম, ভালোবাসা, আকর্ষণ, নির্ভরতা, বিশ্বাস থাকার কারণে আপন পুত্রকে আল্ল­াহর নামে ত্যাগের মহিমাময় ঘটনাটি পৃথিবীর ইতিহাসে অদ্বিতীয় হয়ে আছে।
মাবুদের প্রতি হজরত ইব্রাহিম (আ)-এর এরকম অসামান্য বিশ্বাসের কারণে ‘তাওয়াক্কুলে ইব্রাহিম’ বলা হয়।
আমরা কোরবানির মূল তাৎপর্যকে এড়িয়ে এর বাহ্যিক অবস্থার প্রতি বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। অন্যের হক নষ্ট করা, গীবত, অর্থ, লালসা, কামনা-বাসনা, নফসের খায়েশগুলো দূর করে পশু কোরবানি দিলে তখন আমাদের কোরবানি যথার্থ হবে। আমরা আমাদের ভেতরের পশুত্বকে কোরবানি বা পরিত্যাগ করতে সচেষ্ট না থেকে শুধু বাহ্যিক পশু কোরবানি নিয়ে মহাধুমধামে ব্যস্ত থাকি। রাসূলে করিম (সা) সাহাবায়ে কেরামকে নিজেদের নফসের বিরুদ্ধে জেহাদে অবতীর্ণ হওয়াকে জেহাদে আকবর বা শ্রেষ্ঠ জেহাদ হিসেবে উল্লে­খ করেছেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাঈল (আ)-এর ত্যাগের এ চিরন্তন ঘটনাটি পৃথিবীর বুকে ধরে রাখার জন্য আল্ল­াহতাআলা হালাল চতুষ্পদ জন্তু নির্দিষ্ট সময়ে কোরবানি করার রীতি ফরজ করেছেন। অথচ দুঃখের বিষয় হলো, পশু কোরবানির সময়ও আমাদের পরিপূর্ণ ইখলাস থাকে না। অন্যের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে গরু কিনে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে অহংবোধ করতে কার্পণ্য করি না। এমনকি কোরবানির গোশত শরিয়তের বিধান মোতাবেক বণ্টন করা হয় না। একভাগ গরিব-দুঃখীদের, এক ভাগ আত্মীয় ও প্রতিবেশীর এবং একভাগ নিজের জন্য রেখে বিতরণ করলে কোরবানি যথার্থ ও সুন্দর হয়। আল্ল­াহতায়ালা বলেন, ‘আল্ল­াহর কাছে পৌঁছায় না পশুর গোশত এবং রক্ত; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ (সূরা-হজ-৩৭)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ