Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিত্যপণ্যে ভাড়ার প্রভাব

নূরুল ইসলাম : | প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়ক ফেরি পারাপারে সময়ক্ষেপণ যানজটসহ বিভিন্ন অজুহাতে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে ট্রাক মালিকেরা
চাল, ডাল, কাঁচামালসহ নিত্যপণ্য পরিবহনে ভাড়া বেড়েছে। ভাঙাচোরা সড়ক, ফেরী পারাপারে সময়ক্ষেপণ, দীর্ঘ যানজটসহ নানা অজুহাতে পণ্যবাহী ট্রাকের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে মালিকরা। ব্যবসায়ীদের মতে, ঈদের ৩/৪দিন আগে থেকে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভাড়া বেশি নিচ্ছেন পণ্যবাহী ট্রাকের মালিকেরা। ঈদের পরও না কমায় এর প্রভাব পড়ছে চালসহ নিত্যপণ্যে। চাল ও কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় পণ্য পরিবহনে ভাড়া আগের চেয়ে ট্রাক প্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা বেড়েছে। ঈদের আগে কোরবানির পশু বহনের কারনে সঙ্কট দেখা দিলে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ট্রাক ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়। ঈদ শেষে বর্ধিত সেই ভাড়া আর কমানো হয়নি। বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ রুস্তম আলী খান ইনকিলাবকে বলেন, ঈদের আগে থেকে দেশের চারটি ঘাটে কমপক্ষে ২ হাজার ট্রাক ফেরী পারাপারের জন্য অপেক্ষমান থাকছে। যেখানে ২০টি ফেরীর দরকার সেখানে দেয়া হচ্ছে মাত্র ৬টি। ৩ ঘণ্টার জায়গায় ৩ দিনও সময় লাগছে। এ কারণে ট্রাকের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, চারটি ফেরিঘাটসহ দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়কগুলোতেও ভয়াবহ যানজট লেগেই আছে। ভাঙাচোরা সড়কে পণ্যবাহী ট্রাকসহ কোনো যানবাহনই স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। এতে করে খরচ বেড়ে যাওয়ায় ট্রাক ভাড়া বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকায় যাতায়াতকারী পণ্যবাহী ট্রাকের ভাড়া ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ঢাকার বাদামতলীর কাঁচামাল ব্যবসায়ী ইউসুফ ঢালী বলেন, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ট্রাকের ভাড়া বেড়েছে। আগে যশোর থেকে ঢাকায় সবজিবাহী ট্রাকের ভাড়া ছিল ২০-২২ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২৮/৩০ হাজার টাকা। এই বাড়তি ভাড়া পুষিয়ে ওঠার জন্য বাধ্য হয়ে আমরা সবজির দাম বাড়িয়ে দিয়েছি। ওই ব্যবসায়ী বলেন, আমরা যে হারে দাম বাড়াই পাইকারী বাজারে তা নিমিষেই দ্বিগুণ এবং খুচরা বাজারে তা আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। এতে করে একজন ক্রেতার হাত পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে ২০ টাকা কেজির সবজি ৭০ টাকা হয়ে যায়। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের চাল ব্যবসায়ী কালিদাস সাহা ইনকিলাবকে বলেন, ঈদের আগে গরু বহনের কারনে ট্রাক সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। তখন চাল বা অন্যান্য মালামাল পরিবহন করার জন্য প্রয়োজনীয় ট্রাক পাওয়া যাচ্ছিলো না। সাথে ঈদের আগে সড়কে-মহাসড়কে ভয়াবহ যানজটের কারনে হঠাৎ করে ট্রাকের ভাড়া বেড়ে যায়। তিনি বলেন, আগে বেনাপোল থেকে এক ট্রাক চাল আনতে ভাড়া লাগতো ২৫ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে ৩০-৩২ হাজার টাকা হয়েছে।
অন্যদিকে, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলাচলকারী পণ্যবাহী ট্রাকের ভাড়াও বেড়েছে। চট্টগ্রামের পাইকারী ব্যবসায়ী হায়দার আলী জানান, ভোমরা স্থলবন্দর থেকে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ পর্যন্ত এক ট্রাক পণ্য পরিবহনের ভাড়া আগে ছিল ৩০-৩২ হাজার টাকা। কিন্তু দু-তিন সপ্তাহ ধরে একই পণ্য পরিবহনে ট্রাকপ্রতি ৩৮-৪০ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ট্রাক সংকট, ভাঙাচোরা সড়ক,যানজট, ফিরতি পথে গাড়ি খালি থাকাসহ নানা অজুহাতে আগের চেয়ে ট্রাকপ্রতি ১০ হাজার টাকা বেশি নিচ্ছেন মালিকরা। পুরান ঢাকার পাইকারী ব্যবসায়ী মোঃ সালাহউদ্দিন বলেন, আগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার ভাড়া ট্রাকপ্রতি ১৭-১৮ হাজার টাকার মধ্যে ছিল। এখন তা বেড়ে ২৭-৩০ হাজার টাকা হয়েছে। ঈদের কয়েক দিন আগে থেকে হঠাৎ করেই এই ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত সব পণ্য চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনি, মাঝির ঘাট, সদরঘাট, ভাটিয়ারী, সীতাকুন্ড, মনছুরাবাদ ও পাহাড়তলী এলাকায় মজুদ হয়। এসব এলাকা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পণ্য সরবরাহ করা হয়। একইভাবে চারটি স্থলবন্দর ও দেশের বিভিন্ন মোকাম থেকে পণ্য আসে খাতুনগঞ্জসহ চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারগুলোতে। বগুড়ার পাইকারী ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম থেকে আমদানীকৃত মালামাল আনতে এখন আগের চেয়ে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি ভাড়া লাগছে। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ট্রাক মালিকেরা এভাবে ভাড়া বাড়িয়ে দেয়ায় আমরা পাইকারী ব্যবসায়ীরাতো বটেই, খুচরা এমনকি ক্রেতাদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, খানাখন্দেভরা সড়ক-মহাসড়কে যানজটসহ বিভিন্ন সমস্যার কারনে ২-৩ হাজার টাকা ভাড়া বাড়ালেও চলতো। হঠাৎ করে ৪০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করায় চাল, ডাল, সবজিসহ সবধরণের পণ্যে এর প্রভাব পড়ছে। এতে করে বেচাকেনাও কমে গেছে। যাত্রাবাড়ী পাইকারী মার্কেটের কাঁচাবাজারের আড়তদার মোমিন হোসেন বলেন, ফেরী পারাপার, খানাখন্দের সড়ক-মহাসড়কের কারনে মালামাল পরিবহনে যেমন দেরি হচ্ছে তেমনি কাঁচা সবজিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ট্রাকের ভাড়া বৃদ্ধি করায় খরচ পড়ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। সব মিলে সাধারণ ক্রেতারা যেমন ভুক্তভোগি আমরাও তার বাইরে নই। তিনি বলেন, কস্টিং বেশি দিয়েও টাটকা মালের গ্যারান্টি পাওয়া যাচ্ছে না। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী সমিতির নেতা নাজিম উদ্দিন বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যায় ফলন ব্যাহত হওয়ায় চালসহ তরিতরকারির সংকট তৈরি হয়েছে। এর ওপর কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রবেশের ফলে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর চাপ বেড়েছে। এ অবস্থায় বর্ধিত ট্রাক ভাড়া পণ্যের দাম আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তেজগাঁওয়ের ট্রাক মালিক জুম্মন বেপারী বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকার সড়ক-মহাসড়ক অনেক আগে থেকেই ভাঙাচোরা। সময়মতো সেগুলো মেরামত না করায় তিন ঘণ্টার পথ যেতে ৭ ঘণ্টা লাগে। তিনি বলেন, ঈদের আগে রংপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত আসতে একটা ট্রাকের দুদিন বা তারও বেশি সময় লেগেছে। এখনও ১৮ ঘণ্টার বেশি লাগে। এ ছাড়া শিমুলিয়া বা দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে পারাপারের জন্য এখনও ১০-১২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এসব কারণে প্রতি ট্রিপে পণ্য পরিবহনে আগের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ সময় ব্যয় হচ্ছে। এতে জ্বালানীসহ শ্রমিকদের পারিশ্রমিকও বেড়ে গেছে। বাধ্য হয়ে আমরা ভাড়া বাড়িয়েছি। আরেক ট্রাক মালিক মোশাররফ হোসেন বলেন, আগে একটি ট্রাক ১৬-২০ ঘণ্টায় চট্টগ্রম থেকে রংপুর পৌঁছাত। কিন্তু ভাঙাচোরা সড়কের কারনে এখন চট্টগ্রাম থেকে রংপুর পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৩০ ঘণ্টা। তাছাড়া আগে চট্টগ্রাম থেকে আমদানিকৃত পণ্য পরিবহন করে ফেরার পথে ওইসব মোকাম থেকে চট্টগ্রামে পণ্য আনা হতো। বন্যার পর থেকে রংপুর অঞ্চলে কোনো ধরণের ফলন না থাকায় ফেরার সময় খালি আসতে হয়। তাই আগের চেয়ে বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ রুস্তম আলী খান বলেন, একদিকের মালামাল পরিবহণের কারণে ট্রাক ভাড়া ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আমদানীকৃত পণ্য খালাসের সক্ষমতা কম হওয়ায় একটা ট্রাককে মালামাল নেয়ার জন্য এক থেকে তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়। এজন্যও ভাড়া বেড়েছে। তিনি বলেন, সরকারের উচিত ফেরি পারাপার সচল করাসহ সড়ক-মহাসড়কগুলো দ্রুত সংস্কার করে যানজট নিরসন করা। পণ্যবাহী ট্রাকগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারলে এর ভাড়া কমানো সম্ভব হবে। অন্যথায় ভাড়া কমাতে চাইলে ট্রাক মালিকদের ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে।



 

Show all comments
  • কামরুল ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:১৯ পিএম says : 0
    এই বিষয়টি তুলে ধরার জন্য রিপোর্টার নূরুল ইসলাম ভাইকে মোবারকবাদ
    Total Reply(0) Reply
  • তারেক মাহমুদ ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১:২৭ পিএম says : 0
    নিত্যপণ্যে ভাড়ার প্রভাবে সব কিছুর দামই বেড়বে এটাই তো স্বাভাবিক।
    Total Reply(0) Reply
  • কামাল ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১:২৮ পিএম says : 0
    সরকারের কাছে অনুরোধ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
    Total Reply(0) Reply
  • নাঈম ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১:২৮ পিএম says : 0
    এভাবে চলতে থাকলে ধনী ছাড়া বাকী সকলকে না খেয়ে থাকতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • রফিকুল ইসলাম ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১:২৯ পিএম says : 0
    এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
    Total Reply(0) Reply
  • ফারহানা শারমিন ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১:৩১ পিএম says : 0
    এগুলো কী আমাদের দেশের কর্তা বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা দেখেন না ?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিত্যপণ্যে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ