Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আল কুরআনে কুরবানি

মুহাম্মাদ মুয়াজ্জম হোসাইন সিদ্দীকী | প্রকাশের সময় : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কুরবানি। মুসলিম জাতির সংস্কৃতির অংশবিশেষ ও একটি প্রিয় ইবাদতের নাম। ইসলাম ধর্মের দুটি জাতীয় উৎসবের একটি ঈদুল আযহার গুরুত্বপূর্ণ আমল এটি। আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। হযরত ইবরাহিম আ. এর মহান ত্যাগের স্মৃতিচারক এ কুরবানির ইতিহাস বেশ পুরোনো। সৃষ্টির প্রথম মানব হযরত আদম আ. এর সময় থেকে প্রত্যেক নবীর যুগেই এ কুরবানির রীতি চালু ছিলো। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আর আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানির রীতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেনো তাদেরকে আল্লাহ চতুষ্পদ জন্তু থেকে যা রিযিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে।” (সুরা হজ্জ : ৩৪) তবে এর প্রকৃতি, পদ্ধতি ছিলো ভিন্ন। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনুল কারিমে কুরবানির সূচনা, ঘটনা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সুন্দরভাবে আলোচনা করেছেন। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা আলকুরআনের আলোকে কুরবানি সম্পর্কে জানার প্রয়াস পাব।
আরবি শব্দ কুরবানির শাব্দিক অর্থ হলো নৈকট্য, সান্নিধ্য, উৎসর্গ, ত্যাগ ইত্যাদি। পরিভাষায় কুরবানি বলতে কোনো পশু যবেহ বা অন্য কিছুর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করাকে বুঝায়। তবে ব্যাপকভাবে কুরবানি বলতে কোনো কিছু অর্জনে ত্যাগ স্বীকারকে বুঝায়।
শুরুতেই আমরা জেনেছি যে কুরবানির সূচনা হয়েছে হযরত আদম আ.এর সময় থেকে। তার দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের সহোদরা বোন আকলিমাকে বিবাহ করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। পবিত্র কুরআনুল কারিমের সুরা মায়েদার ২৭-৩১ নং আয়াতে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “(হে রাসূল,) আর আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কুরবানি করেছিলো, অতঃপর তাদের একজনের উৎসর্গ অর্থাৎ কুরবানি কবুল হয়েছিলো এবং অপরজনেরটি কবুল হয়নি। সে (কাবিল) বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। সে (হাবিল) বলল, আল্লাহ তাআলা ধর্মভীরুদের পক্ষ থেকেই তো কবুল করেন।”
হযরত আদম আ. ও হযরত হাওয়া আ. ব্যতীত পৃথিবীতে অন্য কোনো মানুষের অস্তিত্ব ছিলোনা। আল্লাহ তাআলা মানব জাতির বংশ বৃদ্ধির জন্য আদম আ. এর সন্তানদের মাঝে পরস্পর বিবাহ বৈধ করেন। তবে এক্ষেত্রে একটা নিয়ম ফলো করতে হতো। উল্লেখ্য যে, আদম আ.এর একত্রে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে সন্তান জমজ জন্ম নিতেন। তবে তার সন্তানদের মধ্যে শুধু শীষ আ. একা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যা হোক, বিবাহের ক্ষেত্রে নিয়মটি ছিলো, প্রথম জন্ম নেয়া জমজ ছেলেমেয়ে দ্বিতীয় গর্ভে জন্ম নেয়া ছেলেমেয়েকে বিবাহ করবে। বিধি অনুযায়ী হাবিল কাবিলের সাথে জন্ম নেয়া আকলিমা, এবং কাবিল হাবিলের সাথে জন্ম নেয়া লিওয়াজাকে বিবাহ করার কথা। কিন্তু আকলিমা লিওয়াজার চেয়ে তুলনামূলক সুন্দরী হওয়ায় কাবিল আকলিমাকে বিবাহ করার জন্য সংকল্প করে। যা ছিলো আদম আ. এর শরিয়তের বিপরীত।
দু সহোদরের মাঝে দ্ব›দ্ব নিরসনে তাদের উভয়কে কুরবানি করতে বলা হলো। যার কুরবানি কবুল হবে সেই আকলিমাকে বিবাহ করতে পারবে। তখন কুরবানি কবুল হওয়ার একটি নিদর্শন ছিলো এই যে, যার কুরবানি কবুল হতো তার কুরবানিকৃত বস্তু আকাশ থেকে একখÐ আগুন এসে জ্বালিয়ে দিতো। আর যার কুরবানিকে আগুন জ্বালিয়ে দিতোনা তার কুরবানি কবুল হয়নি বলে ধরে নেয়া হতো। পূর্বেকার নবীদের যুগে কুরবানির বস্তু জ্বালিয়ে দেয়ার বিষয়ে পবিত্র কুরআনের সুরা আলে ইমরানের ১৮৩ নং আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে।
হাবিল পশু পালন করতেন। তাই তিনি একটি দুম্বা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি হিসেবে পেশ করেন। আর কাবিল কৃষিকাজ করতো। সে কিছু শস্য কুরবানি হিসেবে পেশ করলো। উভয়ের কুরবানিকে রাখা হলো। আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবিলের দুম্বাকে জ্বালিয়ে দিলো। কিন্তু কাবিলের কুরবানি কবুল হলোনা। ক্ষোভে, দুঃখে কাবিল হাবিলকে হত্যা করার সংকল্প করতে লাগল। অবশেষে তাকে হত্যা করে ফেললো। আর এটাই ছিলো মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যা।
হাবিল ও কাবিলের কুরবানির ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে সকল উম্মতের উপর এ রীতি চলে এসেছে। তবে আমরা যে কুরবানি পেয়েছি বা কুরবানি করি, তা হলো মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহিম আ. তার স্বীয় পুত্র ইসমাইল আ.কে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশে যে কুরবানি করেছিলেন তার স্মৃতিচারক হিসেবে। পিতাপুত্রের আনুগত্যের মহা এক দৃষ্টান্ত ছিলো এ কুরবানি। সাহাবায়ে কেরাম প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, এই কুরবানি কি? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহিম আ. এর সুন্নাত। (মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস নং-৩৪৬৭)
পবিত্র কুরআনুল কারিমের সুরা আস সফফাতের ১০২-১০৭ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহিম আ. এর সীমাহীন কুরবানি অর্থাৎ প্রিয় সন্তানকে যবেহ করার ঘটনা অত্যন্ত চমৎকারভাবে উল্লেখ করেছেন।
হযরত ইবরাহিম আ. এর পুত্র ইসমাইল পিতার সাথে চলাফেরার বয়সে উপনীত হলেন। ইবরাহিম আ. পরপর তিনদিন স্বপ্নে তার প্রিয় সন্তানকে কুরবানি করতে দেখে বুঝতে পারলেন যে, নিশ্চয়ই এটা মাহবুবের পক্ষ থেকে মুহিবের জন্য পরীক্ষা। কেননা নবীদের স্বপ্নও আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী। তাই তিনি পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে স্বীয় পুত্রকে স্বপ্নের কথা অবগত করে মতামত জানতে চাইলেন। নবীপুত্র বলে কথা। ইসমাইল আ. পিতাকে বললেন, হে পিত! আপনাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে আপনি তা পালন করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। যেমন পিতা তেমন পুত্র। অতঃপর পিতা পুত্র উভয়ই পরামর্শে ঐকমত্য হয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলেন। হযরত ইবরাহিম আ. পুত্র ইসমাইলকে কুরবানির উদ্দেশে মীনার ময়দানে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে শয়তান তিনবার তাদেরকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রত্যেকবারই তিনি শয়তানকে সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করেন। শয়তানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
পুত্র ইসমইলকে কুরবানি করার জন্য ইবরাহিম আ. পুর্ণ প্রস্তুত। পুত্র ইসমাইলের আবদার অনুযায়ী তাকে বেঁধে শুইয়ে দিলেন। ইবরাহিম আ. জবাইয়ের ছুরি চালনা করবেন এমনাবস্থায় জিবরাইল আ. বলে উঠলেন ‘আল্লাহু আকবার’। ইসমাইল আ. বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার”। ইবরাহিম আ. বললেন, ‘আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।”
তাকবির পাঠ শেষে ইবরাহিম আ. পুত্র ইসমাইলকে জবাইয়ের শত চেষ্টা করেও জবাই করতে সক্ষম হলেন না। আল্লাহ তাআলা তার খলিল ইবরাহিম আ. এর এ ত্যাগ তথা কুরবানিকে কবুল করে নিলেন। ইবরাহিম আ. দেখলেন যে, পুত্র ইসমাইলের পরিবর্তে একটি বেহেশতি দুম্বা যবেহ অবস্থায় তার সামনে উপস্থিত। তাফসিরে ইবনে কাসিরে উল্লেখ আছে যে, হযরত আদম আ. এর পুত্র হাবিল যে দুম্বা কুরবানি করেছিলেন সেই দুম্বাটিই আল্লাহ হযরত ইসমাইলের স্থলে দান করেন।
আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম আ. কে ডাক দিয়ে বললেন, “হে ইবরাহিম! তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছ। আর এমনিভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি।” আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম আ. এর এ সীমাহীন ত্যাগে এমনই খুশি হলেন এবং কবুল করলেন, এ কুরবানিকে কিয়ামত পর্যন্ত পরবর্তী উম্মতদের জন্য বিধান হিসেবে দান করলেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইবরাহিম আ.এর সুন্নতকে স্মরণীয় করে রাখার যে কুরবানির বিধান দান করেছেন এর মূল লক্ষ্য হলো তার সন্তুষ্টি অর্জন ও তাকওয়া। কারণ আল্লাহ তাআলা তো আমাদের থেকে কোনো পশু বা এ জাতীয় কিছু চাননা। আর তার কাছে এ সকল কিছু পৌঁছেও না; বরং তার কাছে পৌঁছে এ কুরবানির মাধ্যমে কে কতটুকু তাকওয়া প্রদর্শন করতে পেরেছে, কে কতটুকু ত্যাগ বিসর্জন দিতে পেরেছে, কে সত্যিকারার্থেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করেছে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের সুরা হজ্জ্বের ৩৭ নং আয়াতে কুরবানির উদ্দেশ্য বলে দিয়েছেন যে, “আল্লাহ তাআলার নিকট কুরবানির পশুর গোশত বা রক্ত কিছুই পৌঁছেনা; বরং তার কাছে পৌঁছে তাকওয়া।” অর্থাৎ কে কতটুকু আল্লাহর ভয় নিয়ে এ কুরবানি করতে পেরেছে।
শুধু কুরবানি নয়, মুসলিম জীবনের সকল কাজই হবে আল্লাহর জন্য। নামায, কুরবানি, জীবন, মরণ সবই আল্লাহ তাআলার জন্য। স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই এ লক্ষ্য তার রাসুলের মাধ্যমে সুরা আনআ’মের ১৬২ নং আয়াতে ঘোষণা করেছেন, “আপনি বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ সবকিছুই বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য।” আদম আ. পুত্র হাবিলের কুরবানি কবুলের পেছনের কারণটিও যদি আমরা লক্ষ্য করি, সেটি হলো তাকওয়া। হাবিল ছিলেন মুত্তাকি। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা তার কুরবানি কবুল করেছেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় পবিত্র কুরআনের হাবিলের এ উক্তির মাধ্যমে- “তিনি (হাবিল) বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের থেকেই কবুল করেন।” (সুরা মায়েদা)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ