Inqilab Logo

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

চলছে চাঁদাবাজি

কারওয়ান বাজারের ইজারার মেয়াদ শেষ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রাজধানীর কারওয়ান বাজার কার পার্কিংসহ আশেপাশের এলাকার ইজারর মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও দখল ছাড়েনি পূর্বের ইজারা দার। এখনো তারা এই এলাকা থেকে অবৈধভাবে অতিরিক্ত টোল আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে কোনো ধরনের কর বা খাজনা না দিয়েই গত প্রায় ৭ মাস ধরে টোলের নামে চাঁদা আদায় করছে।
উল্টো ডিএনসিসির বিরুদ্ধে মামলা করে ইজারা প্রক্রিয়াকে গত ৭/৮ মাস ঝুলিয়ে রেখেছে। শুধু তা-ই নয়, সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত টোল হারের ১০ গুণেরও বেশি টাকা আদায় করছে সংঘবন্ধ এ চক্রটি। সিটি কর্পোরেশনের নাকের ডগার উপর দিয়ে রাজধানীর বৃহত্তম পাইকারি আড়ত কারওয়ান বাজার এখন চাঁদাবাজদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। মাসে এখানে চাঁদাবাজির পরিমাণ কোটি টাকারও বেশি। প্রায় ২৪ ঘণ্টা নানা বাহানায় এখানে চলে চাঁদা উত্তোলন। সরেজমিন কাওরান বাজার ঘুরে ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া যায় চাঁদাবাজির এসব তথ্য। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বাজারে প্রতিদিন অন্তত ৫ হাজার পাইকারের আনাগোনা রয়েছে। পণ্য কেনা, পরিবহনে লোড করা, ভ্যান গাড়িতে পণ্য নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই গুনতে হচ্ছে নির্দিষ্ট পরিমাণের চাঁদা। পণ্য কিনে ট্রাকে লোড করার জন্য একটি স্থানে সেগুলো রাখার জন্যও দিতে হয় টাকা। চাঁদাবাজরা বেশ কয়েকটি খাত বের করে সেখান থেকে নিয়ম করে চাঁদা আদায় করছে। চাঁদা আদায়ের সুবিধার্থে সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পদও বাগিয়ে নিয়েছে তারা। চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করলে দিতে হয় চরম মাশুল।
সিটি কর্পোরেশনকে ঠকিয়ে গত ৭ মাস ধরে অবৈধভাবে এখান থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে এ সংঘবদ্ধ চক্রটি নিজেদেরমধ্যে ভাগ বাটেয়ারা করে নিচ্ছে। আর কর্পোরেশন হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, কারওয়ান বাজার এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে কার পাকিংয়ের নামে অতিরিক্ত টোল আদায়ের অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। এ ছাড়াও তার আশেপাশের এলাকা থেকেও নানাভাবে চাঁদাবাজি করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, নানা কারণে আমরা গত কয়েক মাস যাবত ওই এলাকাটির ইজারা কাজ সম্পন্ন করতে পারিনি। আগামী তিন চার দিনের মধ্যে আমরা নতুন ইজারাদারের কাছে এলাকাটি বুঝিয়ে দিতে পারবো বলে আশা করছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন কারওয়ান বাজারে আসা ট্রাক প্রতি চাঁদা তোলা হয় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতিরাতে কারওয়ান বাজারে অন্তত ৪০০ ট্রাক পণ্য নিয়ে ঢোকে। গড়ে ২০০ টাকা করে চাঁদা ধরলে প্রতি রাতে ট্রাক থেকেই চাঁদা ওঠে ৮০ হাজার টাকা। ট্রাক থেকে পণ্য নামিয়ে যেসব ভ্যানে তোলা হয় সেগুলোকে চাঁদা দিতে হয় ৫০ টাকা করে। কারওয়ান বাজারে ৭০০ ভ্যান গাড়ি রয়েছে। গড়ে প্রতিরাতে ৪০০ ভ্যান গাড়ি চালু থাকলে এ খাত থেকে চাঁদা আসে ২০ হাজার টাকা। বিভিন্ন আড়ত থেকে মালামাল কিনে সেগুলো আবার পিকআপে লোড করতে হলেও পাইকারদের চাঁদা গুনতে হয়। ৫ হাজার পাইকার প্রতি রাতে ১০০ টাকা করে চাঁদা দিলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ লাখ টাকা।
সড়ক ও ফুটপাতে ভাসমান দোকানদারদের কাছ থেকেও আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের চাঁদা। সড়ক ও ফুটপাতে প্রতি রাতে এক হাজারের বেশি সবজির অস্থায়ী দোকান বসে। সকাল পর্যন্ত চালু থাকা এসব দোকানের জায়গাও চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণে। ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, তিন ফুট আয়তনের ভাসমান দোকানের জন্য চার হাজার ও ছয় ফুটের দোকানের জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এ ছাড়া দোকানের জায়গা (ফুটপাত) বরাদ্দ পেতে অগ্রিম দিতে হয় অবস্থানভেদে ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। মাসিক ভাড়া ছাড়াও প্রতি রাতে বসার জন্য এসব অস্থায়ী দোকানদারদের আরো ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।
দিনের বেলা মূল চাঁদাবাজি হয় পার্কিংয়ের নামে। পার্কিংয়ের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ১০টি স্পট নির্ধারণ করে সেগুলো ইজারা দেয়। ইজারার নাম করে এসব স্পটে নির্ধারিত ৩০ টাকার পার্কিং ফি আদায়ের বদলে ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ ছাড়াও জনতা টাওয়ার ও ক্রিসেন্ট মার্কেটের সামনে অবস্থান করা পিকআপ থেকে ১৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ অবৈধ। পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ভবন থেকে পার্কিংয়ের নামে চাঁদা আদায় করছে এ চক্র। কয়েকটি ভবনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হোটেল লা ভিঞ্চি প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা, ওয়ান ব্যাংক প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা করে পার্কিংয়ের জন্য দেয়। এসব টাকা সিটি কর্পোরেশনের বদলে সোজা চলে যায় ইজারাদারের পকেটে।
সূত্র জানায়, কারওয়ান বাজারের পার্কিং স্পটগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন থানা শ্রমিক লীগের সভাপতি দাবিদার আবদুল মতিন মৃধা। তার সঙ্গে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকটি অঙ্গ সংগঠন। এ ছাড়া ২৬নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেনের নিয়ন্ত্রণে কারওয়ান বাজারের ৪০ ভাগ, তেজগাঁও থানা শ্রমিক লীগ সভাপতি মতিন মৃধার কাছে ৪০ ভাগ ও অন্যান্য সংগঠনের দখলে রয়েছে ২০ ভাগ এলাকা। এ ছাড়া কারওয়ান বাজার এলাকায় রয়েছে পাঁচটি জুয়ার আসর। পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করছেন মতিন মৃধা ও তার লোকজন। জুয়ার আসর নিয়ন্ত্রণে আরো আছে শ্রমিক লীগের কাশেম, খালেক ও হারুন। রেললাইনের মাদকের ব্যবসার পেছনেও রয়েছে এদের প্রত্যক্ষ মদত।
এদিকে সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তেজগাঁও থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা নিজ উদ্যোগে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ৭টি মামলা দায়ের করেছি। প্রয়োজনে আরো করব। চাঁদাবাজি বন্ধে আমরা তৎপর আছি। যতখানি সম্ভব এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনব।
কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেট প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত ইসলামিয়া শান্তি সমিতির সেক্রেটারি লোকমান হোসেন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কারওয়ান বাজারে কোনো ধরনের অপকর্মের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত নন। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পারিবারিকভাবে তারা এখানে ব্যবসা করে আসছেন।
এ সময় লোকমান হোসেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, আমার বিরুদ্ধে কেউ কোন অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ দিতে পারলে আমি আমার ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক সব পদ থেকে পদত্যাগ করবো। অপরদিকে মতিন মৃধার একাধিক মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করে সবই বন্ধ পাওয়া গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চাঁদাবাজি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ