পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্-নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক’ তালবিয়াহ ধ্বনিতে মুখর করে আজ পবিত্র মক্কার পাশে মানব জাতির আদি পিতা আদম আলাইহিস সালাম ও মা হাওয়া আলাইহাস সালামের মিলনের স্মৃতি বিজড়িত আরাফাত ময়দানে সমবেত হয়ে হজ্জ পালন করছেন। আজ ৯ যিলহজ্জ আরাফা দিবস পবিত্র হজ্জ। ইসলাম ধর্মের ৫টি স্তম্ভের অন্যতম হজ্জ। সামর্থ্যবান মুসলিমকে জীবনে অন্তত একবার এই হজ্জ পালন করা ফরজ। মহানবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মকবুল হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া কিছু নয়’। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম) অন্য হাদীসে এসেছে, ‘যে হজ্জ পালন করলো অথচ স্ত্রী সংসর্গ ও অশ্লীলতায় জড়ালো না, সে এমনভাবে ফিরলো যেন আজই তাঁর মা তাকে প্রসব করেছে’। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম) জীবনের সকল গুনাহ থেকে মুক্ত হবার আশায় দুই প্রস্থ সাদা (ইহরামের) কাপড় পরে অভ্যন্তরীণ হজ্জযাত্রীগণের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রায় ১৭ লক্ষাধিক মুসলিম একই কাতারে শামিল হয়ে হজ্জ পালন করছেন। তাদের মধ্যে সউদী সরকারের মেহমান হিসেবে হজ্জ পালন করছেন ২৮টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানসহ ১২৭৯ জন। ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ব্যবস্থাপনা দলসহ ১ লাখ ২৭ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি রয়েছেন হাজীগণের কাতারে।
জানা গেছে, গত ২৭ আগস্ট পর্যন্ত হজ্জের উদ্দেশে বিদেশ থেকে ১৭ লাখ ৫ হাজারেরও বেশি হজ্জযাত্রী আগমন করেন। তাদের মধ্যে ১৬ লাখ ২ হাজার ৬৬১ জন বিমান যোগে, প্রায় ১৪ হাজার ৮৩৫ জন সমুদ্র পথে এবং স্থলপথে আসেন ৮৭ হাজার ৬৮৫ জন হজ্জযাত্রী। একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বড় দলটি আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। কোটা বৃদ্ধির ফলে তাদের হজ্জযাত্রী সংখ্যা ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৪১ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাকিস্তান থেকে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৩৭ জন, তৃতীয় সর্বোচ্চ ভারত থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার ৫০ জন এবং চতুর্থ বৃহত্তম হজ্জযাত্রী দল থেকে বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ২২৯ জন। এর পরের অবস্থানে রয়েছে মিসর থেকে ১ লাখ ৮ হাজার জন। ২০১৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মিনায় পদপিষ্ট হয়ে ২ হাজারের মতো হাজীর মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনার পর ২০১৬ সালে ইরান কোন হজ্জযাত্রী প্রেরণ করেনি। কিন্তু এ বছর দু’দেশের মধ্যে দূরত্ব কিছুটা কমে আসায় তাদের ৮৬ হাজার হজ্জযাত্রী আজ হজ্জ পালন করছেন।
ওদিকে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে চাপাচাপিতে পদপিষ্ট হওয়া থেকে নিয়ে যে কোন ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে সদা তৎপর রয়েছেন সউদী নিরাপত্তা বাহিনীসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। মিনা-আরাফাহ-মুযদালিফায় হজ্জের পূর্বক্ষণে অনুষ্ঠিত হয়েছে মহড়া। সউদী রেড ক্রিসেন্টের প্রধান মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল-কাসেম বলেন, ‘আমাদের ২ হাজার ৪শ’রও বেশি স্বেচ্ছাসেবীর পাশাপাশি নিয়মিত সদস্যরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছেন। হজ্জের সময় হজ্জযাত্রীগণ যেসব স্থান অতিক্রম করবেন সেসব স্থানে আমাদের শতাধিক অ্যাম্বুলেন্স সেন্টার রয়েছে এবং প্রস্তুত রয়েছে ৪টি হেলিকপ্টার’।
অপরদিকে পবিত্র হজ্জ পালনের জন্য গতরাত থেকেই হজ্জযাত্রীরা মিনা থেকে আরাফার উদ্দেশে রওনা হন। মহানবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদর্শিত পদ্ধতি অনুযায়ী আজ বাদ ফজর হজ্জযাত্রীগণের মিনা থেকে আরাফাহ ময়দানে যাওয়ার কথা। কিন্তু প্রায় ২০ লাখ হজ্জযাত্রী পরিবহনের সুবিধার্থে সউদী সরকার নিযুক্ত মুয়াল্লিমগণ আগের (৮ যিলহজ্জ) রাত থেকেই তাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল বাসে করে স্থানান্তর শুরু করে দেন। আর কিছু সংখ্যক হজ্জযাত্রী নিজেদের ব্যবস্থাপনায় পায়ে হেঁটে আজ সূর্যোদয়ের পর আরাফাহ ময়দানে আসবেন বলে জানা গেছে।
হজ্জের জন্য নির্ধারিত ৫ দিনের প্রথম দিন গতকাল হজ্জযাত্রীগণ মিনায় অবস্থান করে ৫ ওয়াক্ত সলাত আদায় করেছেন। গতরাতে পুনরায় তাদের নিয়ে যাওয়া হয় মিনা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরবর্তী আরাফাহ’র ময়দানে। সেখানে আজ যোহর ও আসর আদায় করবেন। আরাফাত ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামেরা থেকে খতীব সাহেব হজ্জের খুৎবা পাঠ দিবেন এবং যোহর ও আসর এক আযানে দুই ইকামাতে কসর অর্থাৎ দুই রাকআত যোহর ও দুই রাকআত আসর সলাত আদায় করবেন। আর তাঁবুতে অবস্থানরতদের মধ্যে মুকীমরা যোহরের সময় যোহর ও আসরের সময় আসর আদায় করবেন। আর মুসাফিরগণ এক আযানে দুই ইকামাতে যোহর ও আসর কসর করে আদায় করবেন। এরপর মাগরিব পর্যন্ত অবস্থান করে জীবনের যাবতীয় গুনাহর ক্ষমা চেয়ে কাঁকুতি মিনতি করে মুনাজাত করতে হবে। এছাড়া দেশ ও জনগণের উন্নতি, অগ্রগতি, বালা-মুসিবত থেকে নাজাত এবং মৃত-জীবিত নিকটাত্মীয়দের মাগফিরাত কামনায় মুনাজাত করবেন হাজীগণ। আরাফাতে অবস্থানকেই মূলত হজ্জ বলা হয়। মহানবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল-হাজ্জু আল-আরাফাহ’ অর্থাৎ আরাফাতে অবস্থানই হচ্ছে হজ্জ। যারা আরাফাতের সীমানায় অবস্থান করবে না তার হজ্জ হবে না।
সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থান করে চলে যাবেন মুযদালিফায়। হেঁটে বা গাড়িতে চড়ে আরাফাহ থেকে মুযদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও এশা সলাত আদায় করবেন তারা। মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপই নির্দেশ দিয়েছেন। হজ্জের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম দিন জামারাতে নিক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় (কমপক্ষে ৪৯টি বা তার বেশি) পাথর এখান থেকেই অনেকে সংগ্রহ করে থাকেন। মিনাতেও প্রয়োজনীয় পাওয়া যায়। মুযদালিফায় খোলা আকাশের নিচে মাথা না ঢেকে ঘুমিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে নিবেন পরের দিনের কার্যক্রম সহজভাবে করার স্বার্থে। বাদ ফজর মুযদালিফা থেকে মিনায় ফিরবেন হাজীগণ। তবে সঙ্গে মাজূর (বিভিন্ন সমস্যায় থাকা) ব্যক্তি থাকলে রাত্রী দ্বিপ্রহরের পরও মুযদালিফা ত্যাগ করা যায়।
হজ্জের তৃতীয় দিন অর্থাৎ আগামী শুক্রবার হজ্জযাত্রীগণকে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে যাবার আগেই জামারাতুল আকাবা বা বড় জামরাতে ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। এরপর কেউ ইচ্ছা করলে সেখান থেকেই হারাম শরীফে ফরজ তাওয়াফ করতে মক্কায় যেতে পারেন। অথবা কুরবানীর টাকা ব্যাংকে পরিশোধ করে থাকলে মিনায় তাঁবুতে এসে মাথা মুÐন বা চুল ছোট করে ইহরাম থেকে প্রথম দফা হালাল হয়ে স্বাভাবিক পোশাক পরিধান করতে পারবেন। ফরজ তাওয়াফ না করলে দ্বিতীয় দফা হালাল তথা স্ত্রী সংসর্গে আসা যাবে না।
হজ্জের চতুর্থ ও ৫ম দিন সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাবার পর জামারাতে গিয়ে ছোট থেকে বড় ৩টি জামারাতে ৭টি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। অসুস্থ ও দুর্বল মহিলাগণ জামারাতে যেতে সক্ষম না হলে তার পক্ষ থেকে নিযুক্ত ওয়ালি তার নিজের পাথর নিক্ষেপের পর অপরের পাথর নিক্ষেপ করে দেবেন।
প্রতি দিন হজ্জযাত্রীকে মিনার তাঁবুতে এসে অবস্থান করতে হবে। এটা সুন্নাত। তবে কারো কারো মতে ওয়াজিব এবং এটা না করলে দম দিতে হবে। ৫ম দিন সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাবার পর ৩টি জামারাতে কঙ্কর মেরে দ্রæত এসে সূর্য অস্ত যাবার আগেই মিনা ত্যাগ করতে হবে। নইলে ৬ষ্ঠ দিবস সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাবার পর আবারো ৩টি জামারাতে ৭টি করে কঙ্কর মেরে মিনা ত্যাগ করতে হবে।
মক্কায় ফিরে হজ্জযাত্রীগণ বিদায়ী তাওয়াফ করে স্বদেশে ফিরে যাবেন। তবে যারা দেরীতে মক্কা ত্যাগ করবেন তারা বিদায়ের দিন বিদায়ী তাওয়াফ করবেন।
এদিকে হজ্জযাত্রীদের নিরাপত্তায় সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। ২০১৫ সালের হজ্জে মিনায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় দুই হাজারেরও বেশি হজযাত্রীর মৃত্যু হয়। সেই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আর যাতে সে ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পথে পথে সহযোগিতার জন্য পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাবেসী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের উত্তম ব্যবস্থা রয়েছে হজ্জযাত্রীগণের গমনাগমনের দীর্ঘ পথ জুড়েই।
সউদী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেজর জেনারেল মনসুর আল-তুর্কি জানান, সরকারি সংস্থাগুলো ২০ লাখ হাজির সেবা দিতে প্রস্তুত রয়েছে। মঙ্গলবার সউদী আরব সরকার হজ উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘোষণা দেয়। অনুমতি না থাকায় ৪ লাখ মানুষের মক্কায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনুমতি না থাকায় ২ লাখ ৮ হাজার ২৩৬টি গাড়ি মক্কায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এছাড়া, মক্কার প্রবেশ মুখে ৩ হাজার ২৯৬টি গাড়ি জব্দ করা হয়েছে।
হজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সউদী সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় ২২টি উন্নয়ন প্রকল্প সম্পন্ন করা হয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, মিনায় আল-ওয়াদি হাসপাতালের পশ্চিমে একটি পায়ে হাঁটার সেতু, মক্কার আল-আজিজিয়া থেকে মিনা’র জামারা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার রাস্তায় ছাউনি স্থাপন, বিপুল সংখ্যক নতুন শৌচাগার নির্মাণ, বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য জামারা অঞ্চলে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা ও ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত রাস্তায় ছাউনি স্থাপন। আরাফায় ব্যারিকেড দিয়ে ও সিমেন্টের প্রাচীর নির্মাণ করে পায়ে চলাচলের রাস্তাকে সুরক্ষিত করা হয়েছে।
এছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নামিরা মসজিদের ভেতরে ও বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। জাবাল-আল-রাহমাহ পাহাড়ে আরোহণ করার সুবিধার্থে সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।