দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য,যিনি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানী করা বিধিবদ্ধ করেছেন;যেন তারা তাঁরই প্রদত্ত চতুষ্পদ জন্তু আল্লাহর নামে কুরবানী করতে পারে। তাঁর প্রিয় হাবীব (স) এর প্রতি,তাঁর আল,আসহাব ও আহলে-বায়ত-এর প্রতি অগণিত দুরূদ ও সালাম,যাঁর মাধ্যমে এ কুরবানী করার মাহাতœ,আদর্শ,বিধি-বিধান,কল্যাণ,পন্থা-পদ্ধতি শেখার সৌভাগ্য আমরা পেয়েছি।
কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ভোগের মানসিকতা পরিহার করে ত্যাগের মহিমায় অভ্যস্থ হওয়ার জন্য এটি একটি শিক্ষামূলক ইবাদত। স্বভাবগতভাবে আমরা সব সময় নিজের ভোগ-বিলাসের চিন্ত্ায় মগ্ন থাকি। যে-কারণে ত্যাগের অভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইসলামী শরীয়ত ‘কুরবানী’র বিধান বিধিবদ্ধ করেছে। পশু জবাই এর মাধ্যমে আমরা আমাদের সত্তার মাঝে লুকিয়ে থাকা পাশবিকতা, দোষ-ত্রæটি, পশু-প্রবৃত্তি বিসর্জন দিতে শিখবো; তাতেই আমাদের কুরবানী স্বার্থক হবে।
কুরবানীর অর্থ:আরবী ‘ক্বুরবান’ ও ‘ক্বুরবাতুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নৈকট্য লাভ করা, হোক তা পশু কুরবানীর দ্বারা বা অন্য কোনভাবে। একইভাবে ‘কুরবাতুন’ যেসব নেক আমল দ্বারা মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা হয় যেমন ইবাদত-আনুগত্য,কল্যাণকাজ ইত্যাদি(আল-মুসত্বালিহাত ওয়াল-আলফায়ুল-ফিকহিয়্যা:খ-৩,পৃ-৮০,দারুল-ফাযীলাহ,কাহেরা,মিসর) বাংলা ভাষায় ‘কুরবানী’ মানে ত্যাগ,উৎসর্গ করা, পশু কুরবানীর মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তবে হাদীস,ফিকহ-ফাতাওয়া ইত্যাদি গ্রন্থে‘ কুরবানী’ এর পরিবর্তে ‘উদ্বহিয়্যা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। পারিভাষিক অর্থে,“আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনকল্পে কুরবানীর দিনে যে পশু জবাই করা হয়,তারই নাম‘কুরবানী’। একই কারণে কুরবানীর দিনকে ‘ইয়াওমুল-আদ্বহা’ ও কুরবানীর ঈদকে ‘ঈদুল-আদ্বহা’ বলা হয়।”।(কাওয়াইদুল-ফিকহি:মুফতী আমীমুল ইহসান র.পৃ-১৮২)
ফাযাইল:(১):মহানবী (স) ইরশাদ করেন:“ঈদুল-আযহা’র দিনগুলোতে মহান আল্লাহর কাছে আদম-সন্তানদের সর্বাধিক প্রিয় আমল হচ্ছে, তাদের পশু কুরবানী করা। আর এ পশুর শিং,লোম ও খুর কিয়ামত দিবসে তার পক্ষে (সাক্ষী হিসাবে) উপস্থিত হবে। এ কুরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই,আল্লাহর কাছে কবূল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কুরবানী করো।(তিরমিযি ও ইবনে-মাজা)
(২)আরেকটি হাদীসে এসেছে, “সাহাŸাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (স)! এ কুরবানী’র স্বরূপ কি? মহানবী (স) উত্তরে বললেন,“এটা হচ্ছে তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ)-এর সুন্নাত-আদর্শ।” সাহাবাগণ পুনঃ আরজ করলেন,হে আল্লাহর রাসূল (স)! এতে আমাদের কি লাভ হবে? নবীজী (স) উত্তরে বললেন,“তার প্রত্যেকটি লোমের বিনিময়ে এক-একটি করে পুণ্য রয়েছে”। তাঁরা পুনঃ আরজ করলেন, পশমের(ভেড়া ও দুম্বা) ক্ষেত্রেও? তিনি জবাব দিলেন,এগুলোরও প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে।”(মুসনাদে আহমদ ও ইবনে-মাজা)
(৩) মহানবী (স) আরও ইরশাদ করেন:“যার কুরবানী করার সামর্থ থাকা সত্তে¡ও সে কুরবানী না করে ,সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে”।(তারগীব/মুসতাদরাকে হাকিম)
(৪) হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) বলেছেন, “ঈদুল-আযহা দিবসের পরেও আরও দু‘দিন কুরবানী করা যায়। একই রকম বর্ণনা হযরত আলী (রা)-সূত্রেও বিদ্যমান”।(মুয়াত্তা ইমাম মালেক)
মাসাইল: কুরবানী কার জন্য ওয়াজিব? যাদের ওপর যাকাত/ফেৎরা ওয়াজিব হয়ে থাকে তাদের ওপর কুরবানীও ওয়াজিব। তবে পার্থক্য শুধু এটুকু যে, যাকাতের ক্ষেত্রে নিসাব পরিমাণ সম্পদ সারা বৎসর হাতে থাকা শর্ত;আর ফেৎরা ও কুরবানী’র ক্ষেত্রে যথাক্রমে ঈদুল-ফিতরের দিন এবং কুরবানী’র তিনদিন ওই পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই, ফেৎরা ও কুরবানী ওয়াজিব হয়ে থাকে।
কুরবানীর সময়: ১০ই যিলহাজ্জ ফজরের পর হতে ১২ই যিলহাজ্জ সন্ধ্যা পর্যন্ত, এ তিনদিন কুরবানী করার সময়।তবে প্রথমদিনে বেশী সওয়াব পাওয়া যায়।
বিধি মোতাবেক যেখানে জুমু‘আ ও ঈদের সালাত জরুরী হয়ে থাকে সেখানে ঈদের সালাতের পূর্বে কুরবানী করা বৈধ নয়।আর যেখানে বিধি মোতাবেক ।ঈদের জামাত জরুরী হয় না সেখানে ফজরের পরেই কুরবানী করা যায়।
নিজের কুরবানীর পশু নিজহাতে জবাই করা উত্তম;তবে মেয়েলোক হলে অথবা অন্য কোন কারণে অপর কাউকে দিয়ে জবাই করলেও বাধা নেই।
কুরবানীর পশু জবাই করার সময় মুখে নিয়ত করা বা দু‘আ উচ্চারণ করা জরুরী নয়;করলে ভালো। তাই কেবল অন্তরে নিয়ত রেখে মুখে সশব্দে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করলেই কুরবানী সহীহ-শুদ্ধ হয়ে যায়।
কুরবানী শুধু ব্যক্তির নিজের ওপর ওয়াজিব হয়।পুত্র-কন্যা বা স্ত্রীর কুরবানীযোগ্য সম্পদ থাকলে,তাদের কুরবানী পৃথকভাবে তাদের ওপর ওয়াজিব হবে। তাই পূর্ব-আলোচনা ব্যতীত এবং একে-অপরকে দায়িত্ব বা অনুমতি প্রদান ব্যতীত কুরবানী করলে তা শুদ্ধ হবে না। সন্তান নাবালক হলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। সুতরাং নাবালকের সম্পদ থাকলেও তা থেকে কুরবানী করা বৈধ নয়। একইভাবে যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব সে নিজের ওয়াজিব পরিহার করে স্ত্রী/বাবা-মা বা অন্য কারও নামে কুরবানী করলে তা শুদ্ধ হবে না।
নিজের ওয়াজিব পালনের পাশাপাশি সামর্থ থাকলে,নফল হিসাবে মহানবী (স)-এর নামে,জীবিত বা মৃত পিতা-মাতা,দাদ-দাদী,শ্বশুর-শাশুড়ী,পীর-উস্তাদ প্রমুখের পক্ষেও কুরবানী করা উত্তম। এতে তাঁদের আমলনামায়ও বিশাল অঙ্কের সওয়াব যোগ হবে। উদাহরণত, যারা এককভাবে এক বা একাধিক পশু বা একাধিক অংশ কুরবানী করেন,তাঁরা একটি বা এক নাম নিজের ওয়াজিব হিসাবে দিয়ে অবশিষ্ট অংশে পিতা-মাতা,স্ত্রী প্রমুখের নামে দিতে পারেন।
কুরবানীর পশু: ছাগল,খাসী,পাঠা,দুম্বা,ভেড়া নর-মাদী জন্তুতে শুধু একজন বা এক নামেই কুরবানী করা বৈধ হয়। আর গরু,মহিষ ও উটÑএ তিন প্রকারের জন্তুতে এককভাবে অথবা সর্বোচ্চ সাতজনে মিলে কুরবানী দেয়া বৈধ হয়। তবে শরীকদের কারও অংশ এক-সপ্তমাংশের কম হলে কুরবানী শুদ্ধ হবে না।
কুরবানীর জন্তু ক্রয় থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ, ঘাস খাওয়ানো,জবাই,বন্টণ ইত্যাদি সর্বপ্রকার যৌথ খরচ, দায়-দায়িত্ব আনুপাতিক হারে সকল অংশীদারকে বহন করতে হবে;নতুবা কুরবানী সহীহ হবে না। অংশ অনুপাতে সমান হারে গোশত ইত্যাদি বন্টণ করতে হবে;তবে সম্মতি সাপেক্ষে পায়া/মাথা/ভুড়ি কোন শরীক যদি না নেয় বা কম নেয়,তাতে কোন সমস্যা নেই।
কুরবানীর গোশত:কুরবানীর গোশত কুরবানীদাতা,ধনী-গরীব,নারী-পুরুষ সকলেই খেতে পারে। এমনকি অমুসলিমদেরও তা প্রদান বা আহার করা বৈধ। তবে যাকাত,ফেৎরা ও কুরবানীর চামড়া ইত্যাদি বাধ্যতামূলক দানগুলো অমুসলিমদের প্রদান বৈধ নয়। তা ছাড়া,কুরবানীর গোশতের ক্ষেত্রে সাধারণ বিধান হচ্ছে,তা তিন ভাগ করে একভাগ নিজে,একভাগ স্বজনদের এবং একভাগ গরীবদের প্রদান ‘মুস্তাহাব’ তথা ভালো। কিন্তু প্রয়োজনে তার ব্যতিক্রম বা কমবেশী করলেও কোন পাপ হবে না। অবশ্য,যত বেশী পরিমাণ গরীবদের দেয়া হবে ততবেশী উত্তম ও অধিক সওয়াব পাওয়া যাবে।
মান্নতের কুরবানী,ওসিয়্যত পালনের কুরবানী এবং যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব ছিল কিন্তু বিশেষ কোন কারণ বশত কুরবানীর সুনির্দিষ্ট তিনদিনে তা পালন করতে না পারায়,পরে তা কাযা করছেনÑএ তিন প্রকার কুরবানীর গোশত নিজে বা ধনী কাউকে দান বা আহার বৈধ নয়। তা কেবল গরীবদের মাঝেই বন্টণ করতে হবে।
কুরবানীর চামড়া:কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রয়ান্তে তা কেবল ফকীর-মিসকীনের হক হয়ে যায়।যে-কারণে চামড়ার মূল্য একমাত্র তাদেরকেই দেয়া যাবে যারা বিধি মোতাবেক যাকাত,ফেৎরা গ্রহণ করতে পারে।কোন ধনী বা সচ্চল ব্যক্তিকে যেমনিভাবে যাকাত,ফেৎরা দেয়া যায় না, কুরবানীর চামড়াও দেয়া যায় না।একইভাবে তা ব্যাপক জন-কল্যাণমূলক কোন কাজে বা প্রতিষ্ঠানেও প্রদান করা জায়েয নয়।যেমন মসজিদ, মাদরাসা,এতিমখানা,হাসপাতাল বা কোন সমিতি,সংস্থাকে। কেননা, এসব ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বৈধ ব্যয়খাত হিসাবে সংশ্লিষ্ট গরীব অসহায়দের সরাসরি মালিক বানিয়ে দেয়ার যে-শর্ত অবশ্য পালনীয়;তা পালিত হয় না এবং সম্ভবও হয় না।অবশ্য মাদরাসা বা এতিমখানার গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের, গরীব শিক্ষক/ইমাম/মুয়াযযেন/খাদেম প্রমুখকে প্রদান করা বৈধ হয়।কিন্তু এদের কাউকে তা বেতন বা পারিশ্রমিক বিবেচনায় প্রদান করা জায়েয নয়।
কুরবানীর নিয়ম:কুরবানী করার নিয়ম হচ্ছে,জন্তুটিকে কিবলামুখী শায়িত করে যথাসাধ্য অধিক ধারালো চুরি/চাকু দ্বারা জবাই করবে।‘ইন্নি ওয়াজ্জাহতু.........’আরবী দু‘আটি পাঠান্তে,কার কার বা কয়জনের পক্ষে কুরবানী হচ্ছে তা পূর্বে জেনে নিয়ে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’বলে জবাই করবে।জবাই-পূর্ব মুহুর্তে যেমন মনে থাকবে,“হে আল্লাহ! তুমিই এ পশু সম্পদ দিয়েছো এবং তোমার নামেই তা কুরবানী করছি”।একইভাবে জবাই শেষে বলবে,“হে আল্লাহ! এ কুরবানীকে সেভাবে কবূল করে নাও,যেভাবে তা তোমার হাবীব হযরত মুহাম্মদ (স) ও তোমার খলীল হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পক্ষ থেকে কবূল করেছিলে।”
মহান আল্লাহ আমাদের জেনে-শুনে,নিষ্ঠাপূর্ণ ও সহীহভাবে কুরবানী করার তাওফীক দিন। আমীন!
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।