Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আকাশপথে সুইডেন

চেমন আরা | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫৫ পিএম, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আমার বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়ি সুইডেনে । আমি দু’বার সুইডেন গেছি । প্রথমবার গিয়েছি ১৯৮২ তে আমার স্বামী কথাশিল্পী শাহেদ আলীসহ নববিবাহিত মেয়ের শ্বশুরবাড়ি দেখতে। দ্বিতীয়বার গিয়েছি ১৯৮৭ সালে মেয়ের সদ্যপ্রসূত সন্তানকে দেখতে। দ্বিতীয়বার আমি একা গিয়েছিলাম। তবে পথে পেয়েছিলাম ইডেন কলেজের সহকর্মী অধ্যাপিকা জোহরা আপা ও তার স্বামীকে। তারা যাচ্ছিলেন তাদের সুইডেন প্রবাসী ছেলের কাছে। বিমান বন্দরে এসে দেখা হয়ে গেলো জোহরা আপা ও তার স্বামীর সাথে।। ১৬ জুন ১৯৮৭ সাল বিকাল ৪টায় আমাদের ফ্লাইট ছিল। আমরা রাশিয়ান বিমান এরোফ্লোর্ট এর যাত্রী। সুইডেনের পথে আমাদের যাত্রা।
আজীবন ভ্রমণবিলাসী মন আমার। ভ্রমণে বেরুবার সুযোগ পেয়ে মনটা খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ভ্রমণে আনন্দ আছে, উল্লাস আছে সেই সঙ্গে আছে অজানা শঙ্কা।
বিষুব রেখার কাছাকাছি দেশের মানুষ আমি! এবার যাবো তুষারে ঢাকা হিমেল দেশে! পথে কয়েকটি ট্রানজিট। কয়েকবার ওঠা-নামা। প্রত্যেকটি বিমান বন্দরে ঘণ্টাখানিক অপেক্ষা। কিছুটা বিরক্তি কর, সেই সঙ্গে নতুন নতুন দেশ দেখার অভিজ্ঞতা। সবকিছু মিলে পুলক-মিশ্রিত অনুভ‚তি। তার পরেও কিছু শঙ্কা নিয়ে বিমান বন্দরে এসেছিলাম। পথে জোহরা আপাদের পেয়ে মনের দিক দিয়ে অনেক স্বস্তি খুঁজে পেলাম।
জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আমাদের বিমান যাবে সোজা বোম্বাই। তারপর করাচি, তাসখন্দ, মস্কো হয়ে সুইডেনের রাজধানী স্টক হলমে। ঠিক সময়ে আমাদের নিয়ে বিমান আকাশে উড়ল। নির্ভার মন নিয়ে মেঘের ভেলায় ভাসতে ভাসতে যাত্রা শুরু হলো আমাদের। আকাশ আর পৃথিবীজুড়ে বিশাল ব্যাপ্তি আর সর্বব্যাপী শূন্যতা মনের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক অপার্থিব অনুভ‚তি। আমার শরীরে মহা সুন্দরের পরশ পাচ্ছি যেন। পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো ভাসমান মেঘপুঞ্জে শেষ সূর্যের সোনালি আভা। অসীম শূন্যের মধ্যে এক অলৌকিক ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করছে। আমি আদি অন্তহীন শূন্যতার মধ্যে মনটিকে মেলে দিয়ে জানালার কাছের সিটে বসে আছি। আমার পাশে আছেন জোহরা আপা ও তার স্বামী। আগে-পিছে বহু মানুষের উপস্থিতিÑ কোনোটাই আমার চিন্তা- চৈতন্য নেই। আমি বিস্মিত, পুলকিত হয়ে মহিমাময় আল্লাহর অসীম কুদরতের বিপুলতা অনুভব করছি। হঠাৎ পাশে সৌম্য দর্শন একজন এয়ার হোস্টেসের উপস্থিতিতে সচকিত হয়ে উঠি। খাবারের ট্রলি নিয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এয়ার হোস্টেস। তিনটা ট্রে ট্রলি থেকে বের করে আমাদের সামনে পাতা টেবিলে খাবার রেখে স্মিত হাসি দিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
ট্রেতে অনেক পদের খাবার সাজানো রয়েছে। কিন্তু কিছুই আমি খেতে সাহস পেলাম না। কারণ, আমি সব সময়ই পেটের রোগে ভ‚গি। লক্ষ করলাম, জোহরা আপা ও দুলাভাই খুব তৃপ্তির সঙ্গে খেলেন। আমি শুধু এক টুকরো পাউরুটি জেলি লাগিয়ে খেলাম। এখানেই শেষ হলো প্লেনের যাত্রীদের প্রথম দফার খাওয়ার পর্ব। তারপর সবাই আয়েসী ভঙ্গিতে বসে আছে যার যার সিটে। কিছুক্ষণের মধ্যে ভেসে এলো এয়ার হোস্টেসের কণ্ঠস্বর ঋধংঃবহ ঃযব নবষঃ। যাত্রীরা আড়ষ্টতা ভেঙে যার যার সিট বেল্ট বেঁধে নিলো। এবার বিমান বোম্বাই এয়ারপোর্টে নামবে। একটানা দুই ঘণ্টা বিমানে বসে আছে সব যাত্রী। এখন মাটির সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। এখানে ঘণ্টাখানিক বিমান থামবে- বিমান পরিষ্কার হবে, জ্বালানি উঠবে ইত্যাদি
বিমান থামতেই যাত্রীরা সবাই সিট বেল্ট খুলে সিঁড়ি দিয়ে একে একে নেমে গেল। জোহরা আপাদের সঙ্গে আমিও নেমে পড়ি বোম্বাই বিমান বন্দরের অভ্যন্তরীণ চত্বরে।
সুবিশাল বিমানবন্দর। খাঁচায় বন্দী প্রাণী যেমন মুক্ত জীবনের স্বাদ পেলে আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠে- যাত্রীদের অবস্থাও তাই। বিমান থেকে নেমেই সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। কেউ কেউ বাথরুমের সামনে ভিড় করে আছে। কেউ কেউ কাস্টমস ফ্রি দোকানগুলোতে ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র দরদাম করছে, কেনাকাটা করছে। চারদিক আনন্দ উৎসব, প্রবীণ ও বুড়োদের মধ্যে তারুণ্যের আভা ছড়িয়ে পড়েছে। এ যেন তারুণ্যের জয়যাত্রা। আমরা করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই সব দৃশ্য দেখছি। হঠাৎ চোখ গেল এক শপিং সেন্টারের সামনের দিকে, দেখি বেগম সুফিয়া কামাল, ডক্টর নিলীমা ইব্রাহীম, বেগম জোহরা তাজউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন। অবাক হলাম, বিমানের ভেতরে আগে তাদের দেখিনি। পরে কথা বলে জানলাম, ওরা মস্কো সরকারে আমন্ত্রণে একটা সেমিনারে অতিথি হয়ে যাচ্ছেন। এরি মধ্যে বিমানে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। আমরা ১৪ নং গেট দিয়ে ঢুকলাম চেকিংয়ের জায়গায়। চেকিং শেষে বোর্ডিং কার্ড দিলো আমাদের। আমরা বোর্ডিং কার্ড দেখিয়ে বিমানে উঠে গেলাম।
এরোফ্লোট বিমানটিতে ইকোনোমি ক্লাসে ভিড় বেশি। বিমান উড়তেই দমবন্ধ হয়ে আসার যোগাড় আমার, কি করব বুঝতে পাচ্ছি না। সামনের রুমটা ভিআইপি রুম। একদম খালি। জোহরা আপা বললেন, ওই রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ বসেন। ঠাÐা বাতাস পাবেন, ভালো লাগবে। ওখানে ঢুকতেই দেখি বেগম সুফিয়া কামাল একদম কোণার একটা সিটে বসে আছেন। আর সব সিটই খালি। আমি সঙ্কোচে একটা খালি সিটে বসতে বসতে তাকে সালাম দিলাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন। অনেক দিন পর দেখা হলেও তিনি ঠিকই চিনতে পারলেন। আমার স্বামী যে কথাশিল্পী শাহেদ আলী এবং আমার মেয়ে যে সুইডেনে থাকে, সে খবর ও তিনি রাখেন। আমার সংসারের খুঁটিনাটি এবং ছেলে-মেয়েদের কুশলাদী অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তিনি জানতে চাইলেন। সে সঙ্গে কোথায় যাচ্ছি তাও। আমি তার সব কথার সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাম।
অপরাধী মনে কিছুক্ষণ ভিআইপি রুমে বসে এবং বেগম সুফিয়া কামালের সাথে কথা বলে বেশ স্বস্তি অনুভব করলাম। পরে আমার জায়গায় ফিরে আসতে চাইলে বেগম সুফিয়া কামাল বললেন, এখানে অনেক সিট খালি, এখানে বস না। আমি বললাম, না আপা! আমার একজন সহকর্মী আমার সাথে আছেন। আমি যাই।
বোম্বাই এয়ারপোর্টে নামার সময় জোহরা আপা পাসপোর্টসহ ব্যাগটা বিমানে ফেলে গিয়েছিলেন। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রী বেশ চিন্তিত ছিলেন। বিমানে এসে ব্যাগটা যথাস্থানে পেয়ে স্বামী-স্ত্রী মহাখুশি।
এখন বিমানের যাত্রা করাচির দিকে। ঘোষণা করা হচ্ছে বিমান একঘণ্টা ১০ মিনিটের মধ্যে করাচি পৌঁছাবে। বিমান যাত্রা শুরু করেছে। সবাই যার যার সিটে চুপচাপ বসা। ইউরোপিয়ান এক দম্পতি আমার পেছনের সিটে পাশাপাশি বসে গভীর মনোযোগের সাথে একটি ইংরেজি বই পড়ছে। ১২-১৪ বছরের দুটো ফিনিস মেয়ে নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে বাংলায়। ওদের মুখে বাংলা শুনে আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-তোমরা থাক কোথায়? মেয়েদের মধ্যে একজন বলল, আমরা তো বরিশাল থাকি। তোমরা এত সুন্দর বাংলা কেমন করে শিখলে? আমাদের মা-বাবা ওখানকার এক এতিমখানার তত্ত¡াবধায়ক। এতিম বাচ্চাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে বলতে আমরা বাংলা শিখে ফেলেছি। আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? উত্তরে জানাল, ফিনল্যান্ডে তাদের দেশে বেড়াতে যাচ্ছে। সঙ্গে এতিমখানার একজন সেবিকাও যাচ্ছে। সেবিকা মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তার বাড়িও ফিনল্যান্ডে।
বাংলাদেশ সময় রাত ১টা ১৬ মিনিটে বিমান এসে করাচির আকাশ সীমায় পৌঁছল। এয়ার হোস্টেস ঘোষণা দিলো- বিমান এখন নামবে। এক ঘণ্টা এখানে অপেক্ষা করবে। কিন্তু কেউ নামতে পারবে না। যাত্রীদের মধ্যে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আবার কেউ কেউ নামতে পারবেন না জেনেই সিট বেল্ট পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমি আর জোহরা আপা বিমানের জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে রাতের করাচি শহরটা দেখার চেষ্টা করছি। বহুদিন করাচিকে নিজের দেশ বলে জানতাম। কেমন যেন নাড়ির টান অনুভব করছি। এয়ারপোর্টটি বিরাট, বিশাল। হাজার হাজার বিজলি বাতির আলোয় দিনের দীপ্তি ছড়াচ্ছে। এত রাতেও সারা এয়ারপোর্টজুড়ে সজীব প্রাণ-প্রবাহ প্রবাহিত হচ্ছে। কর্ম কোলাহলে মূখর। অনেক বিমান সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো বিমানের পাশে বিরাট বিরাট ট্রাক। মাল খালাস হচ্ছে। এসব রঙ তামাসা দেখতে দেখতে কখন যে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেল বুঝলেই পারলাম না।
এবার আমাদের গন্তব্য তাসখন্দ অভিমুখে। ঘড়ির দিকে তাকালাম, ৩টা ৩৭ মিনিট। জোহরা আপাও এরি মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমার চোখে ঘুম নেই। বিমান যাচ্ছে অনেক উপর দিয়ে। বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ভীষণ অন্ধকার। বিমানের ভেতর আশেপাশে তাকালাম। প্রায় সব যাত্রী ঘুমাচ্ছেন। এদের সবার সঙ্গে আমি যেন এক আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করলাম। দেশ, কাল, বর্ণ, ধর্মের সীমানা পেরিয়ে আমরা সবাই একই বিমানের যাত্রী। এই মুহূর্তে এই তো আমাদের পরিচয়। এই সব ভাবছি আমি। এয়ার হোস্টেস ট্রলি নিয়ে আমাদের সিটের পাশে এসে দাঁড়াতে আমি তিনটি জুসের প্যাকেট তুলে নিলাম। করাচি থেকে তাসখন্দ আড়াই ঘণ্টার রাস্তা। ভীষণ গরম লাগছে। অনেকক্ষণ ধরে বিমানে আটকা। বারবার সঙ্গের যাত্রীদের দিকে তাকাচ্ছি। কারো কোনো অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না আমার। আমি নিরুপায় হয়ে বসে আছি। পাশের সিটে জোহরা আপা, তার পরের সিটে তার স্বামী দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। আমি বারবার হাতঘড়ি দেখছি। ৪/১ মিনিটে এয়ার হোস্টেসের কণ্ঠে ঘোষণা হলো-আমরা তাসখন্দ এসে গেছি। বিমানের ভেতর জীবনের সাড়া পড়ে গেল। বিমানটি মাটি স্পর্শ করতেই সবাই মাটিতে নামার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্লেনের সাথে সিড়ি লাগার সঙ্গে সঙ্গে সবাই হুড়মুড় করে নেমে পড়ি। নামতেই এক পশলা ভোরের বাতাস শরীরটা জুড়িয়ে দিয়ে গেল।
সকালবেলার নৈসর্গিক পরিবেশ। আলো আঁধারীর লুকোচুরি খেলার মধ্যে বিমান বন্দরটা রহস্যময় হয়ে উঠেছে। বন্দরে মেরামতির কাজ চললে। ট্রানজিট যাত্রীদের জন্য বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে তিন তলায়। এখানে কোনো শপিং সেন্টার নেই। আমরা তিন তলায় গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় কিছুক্ষণ বসলাম। কেউ কেউ ওয়াসরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিলেন। সবার মধ্যে সজীব, তরতাজা ভাব। ঘণ্টাখানিক বিশ্রাম নিয়ে আমরা সবাই ফিরে এলাম বিমানে।
১৭-৭-৮৭ তারিখ সকাল ৭:৩২ মিনিটে আমাদের যাত্রা শুরু মস্কোর দিকে। মেঘের সমুদ্রের উপর দিয়ে বিমান চলছে। দৃষ্টির সীমানায় পেঁজা তুলোর মতো মেঘ কোথাও বা পাহাড়ের রূপ ধরে আছে আর কোথাও বা সমুদ্র হয়ে আছে। আমাদের প্লেন তার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি আর জোহরা আপা আল্লাহর লীলাখেলা দেখছি আর নিজেদের মধ্যে তার অসীম কুদরতের কথা বলাবলি করছি। বিমান চলছে অনেক উপর দিয়ে। আর মেঘের রূপময় খেলা চলছে আমাদের অনেক নিচে। এই মুহূর্তে আমরা স্বর্গ-মত্যের মাঝখানে এক অপার্থিব জগতের বাসিন্দা। সময় ফুরিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মস্কো নামব। এয়ার হোস্টেসের ঘোষণার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। কিন্তু কোনো ঘোষণা ছাড়াই বিমান নামতে শুরু করল নিচের দিকে।
সবাই ভীত হতচকিত। কোনো সঙ্কেত ছাড়া বিমান তো এমন করে নামার কথা না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সত্যি বিমান এক অনির্ধারিত বিমান বন্দরে অবতরণ করেছে। এখানে নেমে গেল বেগম সুফিয়া কামাল গ্রæপ। এয়ার হোস্টেস বিমানের ক্রু কারো মুখে কোনো কথা নেই। আমরা এখন কোথায়? জিজ্ঞেস করেও কারো কাছে উত্তর মিলছে না। এয়ার হোস্টেস ক্রুরা নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করছে, ওয়ারলেসে কথা বলছে। মিনিট দশেক পর বিমান আবার উড়তে শুরু করল। এবার ও মস্কো থেকে অনেক দূরে এক অনির্ধারিত বিমান বন্দরে এসে বিমান অবতরণ করল। ঘোষণা হলোÑ এখানে আমাদের সবাইকে নামতে হবে। আমাদের সবাইকে নিয়ে বিমান বন্দরের ভেতরে একটা বড় হল ঘরে বসতে দেয়া হলো। আমরা কোথায় যাচ্ছি। বিমান কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছুই জানতে দিচ্ছে না। সবাই যেন জিম্মি হয়ে আছি। রাশিয়ান লোকদের কাছে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা সবাই অসহায় অবস্থার শিকার। প্রায় ঘণ্টাখানিক আমাদের সবাইকে বসে থাকতে হলো। এরই মধ্যে আমাদের জন্য কিছু কোল্ড ড্রিংকসের বোতল এলো ট্রলি করে। বোধশক্তিহীন অবস্থায় সবাই কোথায় আছি কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছি না।
এমনিতে একাকি যাচ্ছি সুইডেনে। তার উপর বিমানের এইসব কর্মকাÐে নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কোল্ড ড্রিংকসের বোতল পেয়ে আপাতত স্বস্তি বোধ করলাম।
জোহরা আপারা এই প্রথম বিদেশে যাচ্ছেন। তাদের অবস্থাও খুব সঙ্গীন। মুখটা শুকিয়ে চুর হয়ে আছে। শুধু দোয়া পড়ছেন বিপদ মুক্তির। রাজশাহীর মেয়ে ঝর্ণা যাচ্ছে স্বামীর কাছে। সেও একা। বিয়ে হয়েছে চার মাস আগে। গায়ে গতরে এক দঙ্গল গহনা। জমকালো বুটিদার শাড়ি পরনে। সব নিয়ে বেসামাল হয়ে যাচ্ছে বারবার। এক পাকিস্তানি পরিবার চার-পাঁচটা ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে যাচ্ছে কর্মস্থল মস্কো হয়ে নরওয়ে। দুঃসহ অবস্থা তাদের। বাচ্চাদের সামলাতে মা-বাবা গলদঘর্ম। এক সিলেটি ভদ্রলোক লন্ডন যাচ্ছেন। মস্কো গিয়ে কানেকটিং বিমান ধরার কথা। সব গড়বড় হয়ে গেছে তার। সিলেটি ভাষায় রাশিয়ান বেটাআইনদের মুÐপাত করছেন। জোহরা আপার স্বামী যাত্রীদের মধ্যে ঘুরাঘুরি করে এখানে বসিয়ে রাখার কারণ জানতে চেষ্টা করছেন। কেউ সঠিক কিছু বলতে পারছেন না। এমন সময় রাশিয়ান দু’জন তরুণ অফিসার এসে সবার কাছে পাসপোর্ট চেয়ে নির্দেশ দিলেন বাসে গিয়ে বসতে। জো হুকুম মেনে নিয়ে আমরা সবাই বাসে চাপলাম। এখানে আরেক হয়রানি। রাশিয়ান লোকেরা সহজে আমাদের নাম উচ্চারণ করতে পারছে না দেখে ভীষণ বিরক্তি লাগছে আমার। আমি ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওদের হাতের কাগজ দেখে বাঙালিদের নামগুলো উচ্চারণ করে দিলাম। ফলে নাম ডেকে পাসপোর্ট ফেরত দিতে বেশ দেরী হয়ে গেল। এরপর বাস ছাড়ল মহাসড়ক ধরে মস্কো বিমান বন্দরের উদ্দেশে। প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছলাম মস্কো বিমান বন্দরে। এখানেও ঝামেলা ঝক্কি কম পোহাতে হয়নি। তবুও আকস্মিক বিমান যাত্রার ছন্দপতনে একদিকে ভীত সঙ্কিত হয়ে পড়লেও বাসে ওঠে মস্কো নগরীর নান্দনিক শোভা দেখতে পেয়ে মনটা কিছুটা হালকা হয়ে উঠল। যাক গে সেসব কথা, এবার আমাদের যাত্রা স্টকহোমের অভিমুখে।

এবার উঠেছি এমন একটি বিমানে যা চিন্তারও অতীত। সে কি আলিশান বিমান। ঢাকা থেকে যে এরোফ্লোটে আমরা এসেছি, সে এরোফ্লোটের সঙ্গে এর কোনো তুলনা হয় না। বনানী, গুলশানের একটা সুবিশাল দালান যেন তুলে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে প্লেনের ভেতর। গোটা প্লেনে চার পাঁচটা রুমের বিরাট হলঘর। প্রত্যেক রুমে ৩০০ যাত্রীর বসার ব্যবস্থা আছে। সঙ্গে রয়েছে সিনেমা দেখার ব্যবস্থা এবং বাচ্চাদের খেলাধুলার ব্যবস্থাও। এত বড় প্লেন!
আকাশে উড়বে কেমন করে ভাবতেই শিহরিত হচ্ছি। আবার মনে মনে খুশিও লাগছে। এমন ঝকঝকে এমন খোলামেলা বাড়ির মতো প্লেনে এর আগে আর কোনো দিন উঠিনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এসব দেশের মানুষের অবদান কি ব্যাপক ভাবতেই অবাক লাগে।
এক ঘণ্টা পঁচিশ মিনিটে প্লেন এসে স্টকহোমের মাটিতে নামল। মনে আমার অবিশ্বাস্য পুলক জাগা অনুভূতি। স্টকহোমে এখন কনকনে ঠাÐা, ঝিরঝির বৃষ্টি, হাড় কাঁপানো শীত। কর্তব্যরত বিমান কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছাড়া গোটা বিমানবন্দর জনমানবশূন্য। কার্পেট মোড়া করিডোর দিয়ে এগিয়ে গেলাম কাউন্টারের দিকে। খুব অল্প সময়ে পাসপোর্ট চেকিংয়ের ঝামেলা শেষ করে সবাই এসে পড়লাম বিমানবন্দরের বাইরে লাউঞ্জে। মাল টানার জন্য খালি ট্রলি একটা নিয়ে মাল আসার জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। জোহরা আপারা আমার আগেই মাল আসার জায়গায় পৌঁছে গেছেন। ওখানে মালের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একবার চোখ ফেরালাম বিমানবন্দরের প্রবেশদ্বারের দিকে। ওখানে অনেক উৎসুক মুখের ভিড়। আমি অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি মেয়ে জামাইয়ের।
সবাই আপন আপন পরিচিতজনদের খুঁজে নিতে চেষ্টা করছে। স্টকহোমের মাটিতে নেমে বিমান বিভ্রাটের ভীতিকর পরিস্থিতির কথা ভুলে গেলাম।
লেখিকা : কথাসাহিত্যিক, প্রফেসর



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন