Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা

হোসেন মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫৯ পিএম, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বিশে^ মুসলমানদের সংখ্যা সাম্প্র্রতিককালে ১৬০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। এই বিরাট সংখ্যক জনসংখ্যার সমাজ জীবনে দু’টি ধর্মীয় উৎসব পালিত হয়Ñ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এক মাস রোজা পালনের পর বছরের প্রথম ও প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে আসে খুশির ঈদুল ফিতর। তার দু’মাস ১০ দিনের মাথায় আসে দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। মুসলিম জনজীবনে রমযান থেকে জিলহজ মাস বা রোজা থেকে কোরবানির সময়কাল পর্যন্ত এ চারটি মাস তুলনামূলকভাবে বেশি আনন্দময়। মূলত ঈদুল ফিতরের আনন্দই যেন প্রলম্বিত হয়ে ঈদুল আজহাতে পৌঁছে।
একজন মুসলমানকে নানাভাবে ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। নানা কাজ ও ঘটনার মধ্য দিয়ে তার ঈমান পরীক্ষা করেন আল্লাহ। সাধারণ মানবিক জ্ঞানে এসব পরীক্ষার ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। তবে অত্যন্ত দৃশ্যমান দু’টি পরীক্ষা সংঘটিত হয় রমজানের সময় রোজা পালন ও ঈদুল আজহার সময় কোরবানি দেয়ার মধ্য দিয়ে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, রোজার সময় ঈমানের পরীক্ষায় অংশ নেন সর্বস্তরের মুসলমান। কারণ প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ ও সজ্ঞান সকল মুসলমানের জন্যই রোজা ফরজ। কিন্তু ঈদুল আজহার কোরবানি ওয়াজিব, আর তা সকলের জন্য নয়, সামর্থ্যবানদের জন্য।
রোজা আত্মশুদ্ধির পরীক্ষা। পুরো এক মাস দিনের বেশির ভাগ সময় পানাহার বর্জন কোনো সামাজিক প্রথা নয় বা নয় কোনো মামুলি আনুষ্ঠানিকতা। রোজা পালন এক বিরাট সাধনা। রোজা অবশ্যই ঈমানের পরীক্ষাও বটে। কোনো দুর্বল ঈমানের লোকের পক্ষে সুবেহসাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনো খাবার ও এক ফোঁটা পানি না খেয়ে থাকার কথা ভাবা সম্ভব নয়, সম্ভব নয় রোজা পালন করা। অর্থাৎ রোজা একান্তই ঈমানের পরীক্ষা। আর এ ঈমানের পরীক্ষায় শামিল হন নারী-পুরুষ-ধনী-গরিব নির্বিশেষে সর্বস্তরের মুসলমান। তবে যারা রোজা আদায় করেন, তারা সবাই যে ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন বা হতে পারেন তা নয়। অবশ্য আল্লাহই সবকিছু ভালো জানেন।
কোরবানি যারা দেন, তারা পরীক্ষা দেন। এ পরীক্ষা আল্লাহর কাছে বান্দার পরীক্ষা। কোরবানির গোশত খাওয়া মামুলি কোনো উৎসব নয়Ñ তার মধ্যে রয়েছে ত্যাগ ও ত্যাগের শিক্ষা। এই ত্যাগের শিক্ষার জন্য আল্লাহ তায়ালা নির্বাচন করেছিলেন মুসলমানদের আদি পিতা হজরত ইব্রাহিম আ:কে। এ এমন এক শিক্ষা যা মানবগোষ্ঠীর আর কেউ তার সম্মুখীন আগে হয়নি। হজরত ইসমাইল আ: নবী ইব্রাহিম আ:-এর অনেক বেশি বয়সের সন্তান। একমাত্র সন্তান হিসেবে পিতা-মাতার অপরিসীম স্নেহ পেয়েছিলেন তিনি। ছেলেকে ঘিরে আবর্তিত হবে পিতার সকল স্বপ্ন ও আশাÑ এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে যে কোনো হিসেবেই পিতার কাছে সন্তানের মূল্য সর্বোচ্চ। সে সন্তানকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি দেয়ার মহা পরীক্ষা তাঁকে দিতে হবে, ইব্রাহিম আ:-এর তা জানা ছিল না। কিন্তু স্রষ্টার লীলা বোঝে সে সাধ্য কার? হজরত ইসমাইল যখন পিতার সাথে দৌড়াদৌড়ি করার (কাজ করার) বয়সে উপনীত হলেন, তখনি তিনি স্বপ্নে আল্লাহর অভিপ্রায় অবহিত হলেন। আল্লাহ তাঁর পিতার কাছে ইসমাইলকে কোরবানি চাইছেন। এই যে আল্লাহর ইচ্ছা, তা পূরণ করতে নবী ইব্রাহিম আ: বাধ্য। অন্যদিকে প্রিয় পুত্রকে কোরবানি কী করে সম্ভব? আল্লাহর অনুগ্রহভাজন নবী অথচ একজন রক্তমাংসের মানুষ হজরত ইব্রাহিম আ: এই প্রচÐ মানসিক দোলাচলতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত শিশুপুত্রকে বিষয়টি জানালেন এবং বিনা দ্বিধায় শিশু ইসমাইল আ: পিতাকে আল্লাহর ইচ্ছা পূরণ করতে বললেন। তারপর পিতা-পুত্র আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সমর্পিত হলেন। ইসমাইল আ:কে জবাই করার উদ্দেশ্যে তাঁকে কাত করে শুইয়ে দিলেন ইব্রাহিম আ:। সে সময় আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর পক্ষ থেকে ইসমাইল আ:-এর পরিবর্তে একটি বড় প্রাণী (নির্ভরযোগ্য সূত্রে বলা হয়েছে প্রাণীটি ছিল দুম্বা) কোরবানি দেন। আল্লাহ বলেছেন, এটা তাদের দু’জনের জন্যই ছিল সুস্পষ্ট পরীক্ষা। তখন থেকেই আল্লাহ অনাগত কালের মানুষদের জন্য কোরবানির বিধান চালু করেন। (সূত্রÑ সূরা আস সাফাত : আয়াত- ১০০-১০৯)
এ ঘটনার মধ্যে ঈমানদারদের জন্য দু’টি শিক্ষা রয়েছে। এক. আল্লাহর জন্য সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে বিনা দি¦ধায় কোরবানি দেয়া। দুই. আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের জীবনকে হাসিমুখে বিলিয়ে দেয়া। আর এ দু’টি কাজের মধ্যে রয়েছে সর্বোচ্চ ত্যাগের শিক্ষা। এ জন্য আল্লাহ তাঁর নবী ও শিশুপুত্রকে পুরস্কৃত করেছেন। হাজার হাজার বছর ধরে কোরবানির রীতি বহাল রয়েছে।
বিশ^ব্যাপী মুসলিম জনসমাজের মধ্যে আজো কোরবানির রীতি একইভাবে প্রচলিত থাকলেও আধুনিক মুসলিম জনসমাজে কোরবানির শিক্ষা ও আদর্শ তেমন কার্যকর নয়, বরং তা ক্রমেই আনুষ্ঠানিকতা মাত্রে পর্যবসিত হতে চলেছে। মুসলিম বিশে^র দিকে তাকালে দেখা যায়, সংখ্যার দিক দিয়ে প্রতি বছরই কোরবানিদাতার সংখ্যা বেড়ে চলেছে, ক্রমশই বেশি সংখ্যক পশু কোরবানি হচ্ছেÑ কিন্তু কোরবানির প্রকৃত শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ মুসলমানের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। আগের দিনেও সম্পদশালী মুসলমান ছিলেন। তারাও কোরবানি দিয়েছেন। তারা সে কোরবানি দিয়েছেন ঈমানি চেতনা থেকে। আর এখন বহু কোরবানিই হয় লোক দেখানো জাঁকজমকে। কোরবানি দেয়া তার জন্য ওয়াজিব যার সামর্থ আছে। এখন সমাজে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে, আর বেড়েছে মানুষের নাম কেনার স্পৃহা। এ ধরনের কোরবানি দাতারা কে কত লক্ষ টাকার গরু কোরবানি দিতে পারেন তার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন নয়, আল্লাহর পথে ত্যাগ স্বীকার নয়Ñ তাদের মধ্যে কাজ করে প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রদর্শনের হীন মানসিকতা। অথচ তাদের এ উপলব্ধি হয় না যে কত অর্থ দিয়ে কত বিশালাকার বা কত মোটাতাজা গরু কোরবানি দেয়া হলো তা কোনো বিষয় নয়। আল্লা যা দেখেন তা হচ্ছেÑ কোরবানিদাতা বান্দার নিয়ত ও তাকওয়া। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘বলো আমার সালাত, আমার হজ ও কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সবই বিশ^জগতের প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যে।’ (সূরা আনাম : আয়াত-১৬২)। অনেক মানুষই এ কথা ভুলে যায়। তার মধ্যে ফুলেফেঁপে ওঠে সম্পদের অহঙ্কার। নিজের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি প্রকাশের জন্য সে তখন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। অথচ আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালার কাছে কখনো (কোরবানির) রক্ত ও গোশত পৌঁছায় না। বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াটুকুই পৌঁছায়।’ (সূরা হজ : আয়াত-৩৭) আল্লাহ তায়ালার এ হুঁশিয়ারি এ ধরনের লোকদের মনে কোনো ছায়াপাত করে না।
সাম্প্রতিককালে এক শ্রেণির কাÐজ্ঞানহীন মানুষের মধ্যে এক লজ্জাকর প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোরবানির গোশতের ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছেÑ সম্পূর্ণ গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের জন্য রাখা, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিলি করা ও এক ভাগ গরিব-দুঃখীদের দেয়া। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন, ‘অতপর (কোরবানির) এ গোশত থেকে (কিছু) তোমরা নিজেরা খাবে, দুস্থ এবং অভাবগ্রস্তদেরও তার কিছু অংশ দিয়ে আহার করাবে। (সূরা হজ : আয়াত- ২৮) কিন্তু কিছু লোক গরিব-দুঃখীদের ভাগের সম্পূর্ণ অংশ যেমন বিতরণ করে না, তেমনি আত্মীয়স্বজনের অংশও সম্পূর্ণ না বিলিয়ে ভালো করে নিজের উদরপুর্তির জন্য রেখে দেয়। এ ক্ষেত্রে কোরবানির মূল লক্ষ্য যে ত্যাগ তা অর্জিত হয় না। কোরবানির ক্ষেত্রে আরেকটি নিন্দনীয় প্রবণতা ইদানীং দেখা যাচ্ছে। তা হলো অবৈধ পন্থায় সম্পদ উপার্জনকারীদের কোরবানি প্রদানের ক্ষেত্রে আর্থিক প্রাচুর্যের প্রদর্শনী। অথচ কোরবানি কবুল হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো হালাল উপার্জন। অবৈধ পন্থায় উপার্জিত পথে যারা কোরবানি প্রদান করেন এবং কোরবানি দেয়ার পরও কোরবানির ত্যাগের শিক্ষায় উজ্জীবিত না হয়ে পূর্বাবস্থায় থেকে যান, তাদের অর্থ ব্যয় বা জাঁকজমকের প্রদর্শনীই হয়, কোরবানি আর হয় না।
কোরবানি হজের সাথে সম্পর্কিত হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য। রোজা মুসলমানদের আত্মশুদ্ধির আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি সোনায় পরিণত করে, আর কোরবানি তাদের দেয় ত্যাগের শিক্ষা। এ ত্যাগ শুধু অর্থ খরচ করে পশু কোরবানির মধ্যেই সীমিত নয়। এ ত্যাগের ক্ষেত্র বহু প্রসারিত। নিজের সব কিছু আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করাÑ যেমন হজরত ইব্রাহিম আ: করেছিলেন নিজের সবচেয়ে প্রিয় ও মূল্যবান সম্পদ শিশুপুত্রকে, কোরবানির প্রধান শিক্ষা। আর এ শিক্ষারই আওতায় পড়ে সমাজের দীন-দুঃখী বা অভাবগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করা, মানুষে মানুষে সৌহার্দ প্রতিষ্ঠা করা, সত্য ও ন্যায়ের পথে নিজে থাকা ও অন্যকে থাকতে উদ্বুদ্ধ করা প্রভৃতি। কিন্তু এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই যে, বছরে একবার অর্থাৎ ১০ জিলহজের দিন ধনী ও সামর্থ্যবানরা সাধ্যমতো অর্থ ব্যয় করে একটি পশুকে কোরবানি দিয়ে, তার গোশত বিতরণ করে এবং নিজে খেয়ে কোরবানির প্রথাটি বাস্তবায়ন করেনÑ মূল শিক্ষায় কেউ আর উজ্জীবিত হন না।
আমরা মানুষ। আমাদের মনের মধ্যে বাস করে পশু। সে পশুশক্তি আমাদের ক্রোধ, ঘৃণা, অন্যায়, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, নীতিহীনতা, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, অহঙ্কারের দিকে ঠেলে দেয়, যার পরিণতি হচ্ছেÑ সত্য ও সুন্দরের বিনাশ আর মিথ্যা ও অসুন্দরের অনাকাক্সিক্ষত বিস্তার। কোরবানির ত্যাগের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে পশু কোরবানি দেয়ার সাথে সাথে এ পশুপ্রবৃত্তিগুলোকেও কোরবানি দিতে হবে। সেটাই হবে সত্যিকার কোরবানি যার মধ্য দিয়ে একজন মুসলমান হয়ে উঠবে সুন্দর মানুষ। তখনি কোরবানি সার্থক হবে, সকলের জীবন হবে প্রকৃতই সুন্দর।
লেখক : সাংবাদিক

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন