Inqilab Logo

শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ট্রাম্পের আফগান নীতি দক্ষিণ এশিয়াকে কি আরো অস্থিতিশীল করে তুলেছে

ডি ডব্লিউ | প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ট্রাম্পের আফগানিস্তান নীতির ফলে দক্ষিণ এশিয়ার মত একটি পরিবর্তনশীল অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রশ্ন যে তার আফগান নীতি কি দক্ষিণ এশিয়াকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলেছে? এদিকে ইসলামপন্থীদের সমর্থনের কারণে ট্রাম্প যে দেশটির সমালোচনা করেছেন সেই পাকিস্তান আফগান সংঘাতে চীনের বৃহত্তর অংশগ্রহণ চায়। তবে বহু নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষক যখন সুস্পষ্ট কৌশলের অভাবের কারণে ট্রাম্পের আফগানিস্তান নীতির সমালোচনা করেছেন তখন পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কথিত তালিবান অভয়াশ্রমের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের সাথে ইসলামাবাদের অসহযোগিতা বিষয়ে তাকে দ্ব্যর্থহীন দেখা গেছে।
ট্রাম্পের পূর্বসূরী জর্জ বুশ ও ওবামাও ইসলামপন্থীদের প্রতি সমর্থন ও পাশ্চাত্যের সাথে মৈত্রীজোট বিষয়ে পাকিস্তানের দ্বিমুখী ভূমিকা বিষয়ে সন্দেহগ্রস্ত ছিলেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন যে তাদের কেউই এটাকে তাদের মূলনীতির আওতায় আনেননি যা ট্রাম্প করেছেন। ট্রাম্প একতরফা ভাবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জঙ্গি অবস্থানগুলোতে বিমান হামলার নির্দেশ দিতে পারেন এবং ইসলামাবাদের সামরিক সাহায্য কর্তন করতে পারেন বা যুক্তরাষ্ট্র চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রæপগুলোকে সমর্থন দেয়ার জন্য পাকিস্তানের সরকারী ও সামরিক কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন।
আফগান যুদ্ধ : মার্কিন সাফল্য ও সমস্যা
সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় দিচ্ছে বলে ট্রাম্পের দাবিতে স্বাভাবিক ভাবেই পাকিস্তান ক্রুদ্ধ হয়েছে যা আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্য লাভকে কঠিন করে তুলতে পারে। পাকিস্তান সরকার ও বিরোধীদলগুলো মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করেছে এবং তাদের দেশ ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ভাবতে পারে বলেও হুমকি দিয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা আসিফ ট্রাম্পের আফগানিস্তান নীতি নিয়ে আলোচনার জন্য চীন, রাশিয়া ও তুরস্কে তিনদিনের সফরে যাচ্ছেন।
সর্বশেষ ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে নয়া মার্কিন কৌশল, যাতে যুক্তরাষ্ট্র আফগান সংঘাতে পাকিস্তানের প্রধান শত্রু ভারতের বৃহত্তর ভূমিকা গ্রহণ চাইছে, এ অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক শ্রেণিবিন্যাস আমূল পরিবর্তন করতে পারে। মার্কিন নীতি আফগানিস্তান ও ভারতের সাথে চীন ও পাকিস্তানকে বৃহত্তর সংঘাতের পথে স্থাপন করে দক্ষিণ এশিয়াকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
প্রধান লাভবান আফগানিস্তান
আফগান সরকার তাদের দেশে অব্যাহত মার্কিন সম্পৃক্ততা এং চূড়ান্তভাবে মার্কিন প্রশাসন কর্তৃক পাকিস্তানকে বড় সমস্যা হিসেবে স্বীকার করাকে স্বাগত জানিয়েছে যেদিকে আফগান কর্মকর্তারা বারবার অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন।
আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি সরকার আশাবাদী যে নয়া মার্কিন আঞ্চলিক কৌশল দীর্ঘায়িত সংগাত অবসানে সাহায্য করবে। প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র শাহ হুসাইন মারতাজাবি বলেন, নয়া মার্কিন কৌশল এ অঞ্চল যে সব হুমকি ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন সেগুলোকে চিহ্নিত করেছে। এর ফলে আফগানিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ মেয়াদে লাভবান হবে বলে আমাদের বিশ^াস। তিনি সম্ভবত পাকিস্তানের উল্লেখ করে বলেন, মার্কিন কৌশলে যে সব দেশ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বশীলতার সাথে তাদের ভূমিকা পালন করেনি সে সব দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ট্রাম্পের নয়া নীতিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
কিন্তু আসলে কি ট্রাম্প ইসলামাবাদের উপর চাপ সৃষ্টি করবেন? আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা যে যুক্তরাষ্ট্রের কি এমনসুবিধা আছে যে সে পাকিস্তানকে তার দাবি মানাতে পারবে?
কাবুল বিশ^বিদ্যালয়ের এক প্রভাষক ওয়াদির সাফি ডি ডবিøউর পশতু-দারি সার্ভিসকে বলেন, আমি মনে করি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে এটা সুস্পষ্ট করেছেন যে এ বিরোধে তাদেরকে খোলাখুলি একটা পক্ষ নিতে হবে। যদি পাকিস্তান বিদ্রোহীদের নিরাপদ আশ্রয় দেয়া অব্যাহত রাখে এবং আফগান সংঘাত নিরসনে ভূমিকা না রাখে তাহলে তাকে কঠোর পরিণতি ভোগ করতে হবে।
পাকিস্তানের সাহায্য আবশ্যক কিনা
পাকিস্তান আস্থাশীল যে আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তার উপর নির্ভর করা অব্যাহত রাখবে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ বা জঙ্গি গোপন অবস্থানে এক তরফা বিমান হামলা পাকিস্তানিদের চরম পশ্চিমা-বিরোধী মনোভাবে উদ্বুদ্ধ করে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী দেশটিকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে জেনে যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত পাকিস্তানের সাথে সহযোগিতা করে আসছে।
ওবামা তার মেয়াদে আফগান সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে উপজাতীয় এলাকায় ড্রোন হামলা বৃদ্ধি করেছিলেন। কিন্তু তিনি দেশটিতে সুবিধা বজায় রাখতে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সাথে সম্পৃক্ততা বজায় রাখেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এক্ষেত্রে উল্টো হচ্ছে যে ইসলামাবাদ আফগানিস্তানের ব্যাপারে তার নিজস্ব কৌশল অব্যাহত রেখেছে যা হচ্ছে কাবুলে ভারতের প্রভাব হ্রাস রাখা এবং আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ প্রত্যাহারের জন্য অপেক্ষা করা।
পাকিস্তানের জঙ্গি সমস্যা
একই সময়ে কিছু পাকিস্তানি বিশ্লেষক বলছেন, পাকিস্তানের স্বার্থেই ট্রাম্প প্রশাসনকে তাদের পাশে রাখা দরকার। পাকিস্তানের গবেষক ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আয়শা সিদ্দিকা ডি ডবিøউর উদর্ৃু সার্ভিসকে বলেন, ট্রাম্পের আফগান নীতি বক্তৃতা নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার কোনো যুক্তি আছে বলে আমি মনে করি না। পাকিস্তানের তার সাথে সম্পৃক্ত থাকা উচিত। ট্রাম্প আফগানিস্তানে আরা সৈন্য পাঠাচ্ছেন এবং সে জন্য তারে ইসলামাবাদের সাহায্য প্রয়োজন।
২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে মার্কিনিরা আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার পর থেকে পাকিস্তান ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্কে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ট্রাম্পের বক্তৃতার পর দু’দেশের ব্যবধান আনুষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। পাকিস্তানের উপর আমেরিকার নির্ভরতা হ্রাস পাচ্ছে দেখে ইসলামাবাদ ইতোমধ্যেই বেইজিংয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
এখন চীন পাকিস্তানে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করায় পাকিস্তান ওয়াশিংটনের উপর কম নির্ভরশীল। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে (সিপিইসি) বহু শত কোটি ডলার বিনিয়োগ তাদের অংশীদারিত্বের উদাহরণ।
একজন অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ইনাম উর রহিম বলেন, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে পারে, কিন্তু ওয়াশিংটন শিগগিরই বুঝতে পারবে যে সে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। ট্রাম্প যদি তা করতে চান তাহলে পাকিস্তান, চীন ও রাশিয়া একটি জোট গঠন করতে পারে যাতে ইরানও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
আফগানিস্তানে চীনের স্বার্থ
বেইজিংয়ের চীনা সমাজ বিজ্ঞান একাডেমির বিশেষজ্ঞ ইয়ে হাইলিন বলেন, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে শত্রæতা সন্ত্রাসীদের পরাজিত করার ক্ষেত্রে বিপরীত ফল দিতে পারে।
ডি ডবিøউর চীনা সার্ভিসকে তিনি বলেন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীন সব সময়ই সবচেয়ে ভালো কিছু করার চেষ্টা করেছে। সন্ত্রাসীদের পরাজিত করাই এ অঞ্চলে চীনের কৌশলগত স্বার্থ।
ইয়ে বলেন, পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে ভূমিকা রাখছে। মার্কিন অভিযোগ অত্যন্ত অন্যায্য। ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে যে আর্থিক সাহায্য দেয় তা দাতব্য হিসেবে দেয় না, ন্যাটো বাহিনী পরিবহন ও জ¦ালানি ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সাহায্য ব্যবহার করছে।
চীন ইতোমধ্যে দীর্ঘায়িত আফগান সংকট অবসানে গঠিত চতুর্দেশীয় সমন্বয় গ্রæপের অংশীদার। এ চার দেশ হচ্ছে আফগানিস্তান,চীন, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র। এ গ্রæপ প্রতিষ্ঠা এ পর্যন্ত কোনো সাফল্য অর্জন করেনি। গ্র্রুপের ইসলামাবাদ ও কাবুল সামরিক বিষয়ে বিরোধে লিপ্ত, আর যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে রয়েছে আস্থার অভাব।
চীন ও রাশিয়া মার্কিন প্রত্যাহার চায়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে চীন পাকিস্তানে বিপুল বিনিয়োগ করেছে ্ সে কারণে সে শান্তি চায়, অন্তত যে সব এলাকায় তার বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। চীন মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আফ্রিকার বাজারে পৌছনোর স্থল ও সাগর পথ প্রতিষ্ঠায় তার প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার চীন-পাকিস্তান অর্র্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) প্রকল্পের অংশ হিসেবে বেলুচিস্তানে একটি বন্দর নির্মাণ করেছে।
আফগানিস্তানের ব্যাপারে চীনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা গ্রহণের আরেকটি কারণ হচ্ছে জিনজিয়াং প্রদেশে তৎপর ইসলামপন্থীরা এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে তালিবান ও অন্যান্য ইসলামপন্থী গ্রুপগুলোর সাথে তাদের জোট নিয়ে উদ্বেগ।
পাকিস্তানের বেসামরিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর যেখানে চীনের বিপুল প্রভাব রয়েছে সেখানে আফগানিস্তান এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ। সুতরাং আফগান সংকট সমাধানে ইসলামাবাদ ও কাবুলকে এক পাতায় আনা বেইজিংয়ের জন্য্র সহজ হবে না।
নিরপেক্ষ থাকা
নয়া দিল্লী ভিত্তিক একজন আফগান বিশেষজ্ঞ ওমর আগা ডি ডবিøউর হিন্দি সার্ভিসকে বলেন, পাকিস্তান ভারতকে প্রধান শত্রæ বলে মনে করে। তারা জানে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ভারতের বৃহত্তর বূমিকা পালন দেখতে চায়। সুতরাং ইসলামাবাদ বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ হবে, এটাই যৌক্তিক।
তিনি বলেন, পাকিস্তানমনে করে, এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনের সাথে সহযোগিতা করাই বেশী ফলপ্রসূ হবে। চীনও সকল আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে পাকিস্তানকে সমর্থন দিচ্ছে।
আগা আরো বলেন, আফগানিস্তান বিসয়ে ট্রাম্প ভারতের কাছ থেকে কি চান তা পরিষ্কার নয়।
একই সময় ভারত ও পাকিস্তানের শান্তি কর্মীরা তাদের স্ব স্ব দেশকে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের এবং মার্কিন-চীন প্রতিদ্ব›িদ্বতা, সে সাথে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় বিশ^শক্তিগুলোর কৌশলগত স্বার্থে কোনো পক্ষ না নেয়ার আহবান জানান। যেমন পাকিস্তানি শান্তিবাদী কর্মী ও লেখক হ্যারিস খালিক। তিনি বেইজিং, মস্কো বা ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই আঞ্চলিক বিরোধগুলোর আঞ্চলিক সমাধান করার জন্য বারংবার আহবান জানিয়েছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ট্রাম্প


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ