দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
যমযমের পানির বহুমুখি বরকত ও উপকারিতার পেছনে ইলাহী কারণের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক কারণও আজ উৎঘাটিত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করেছে যে, যমযমের পানি আর পৃথিবীর সাধারণ পানির গুণাগুণ বৈশিষ্ট্য এক নয়। এর মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে খনিজ উপাদান। নি¤েœ সাধারণ পানি ও যমযমের পানির পার্থক্যের চিত্রটি আমরা অনুধাবন করতে পারি।
খনিজ উপাদান জমজমের পানি সাধারণ পানি
সোডিয়াম ১৩৩ ৩৭.৮
ক্যালসিয়াম ৯৬ ৭৫.২
ম্যাগনেশিয়াম ৩৮.৮৮ ৬.৮
পটাশিয়াম ৪৩.৩ ২.৭
বায়োকার্বোনেট ১৯৫.৪ ৭০.২
ক্যালরি ১৬৩.৩ ৭৩.৩
ফ্লোরাইড ০.৭২ ০.২৮
নাইট্রেড ১২৪.৮ ২.৬
সালফেট ১২৪.০ ১০৭
মোট দ্রবীভ‚ত ক্ষারীয় উপাদান ৮৩৫ ৩৫০
সূত্র : উইকিপিডিয়া
আমরা যমযম পানির ফজিলত, বৈশিষ্ট্য, উপকারিতা ও যুগে যুগে এ পানি থেকে উপকারের বিষয়টি জানলাম। এবারে আমরাও এ পানি পান করে বরকত লাভ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
হজ্জ ও ওমরাকারী ভাইরা তাওয়াফ শেষে সায়ীর পূর্বে, হজ্জ আদায় শেষে, বায়তুল্লাহ থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে অর্থাৎ সবসময়ই তৃপ্তিসহকারে যমযমের পানি পান করতে পারেন। এছাড়া পৃথিবীর সকল মুসলমানের জন্যই যমযমের পানি পান করা মুস্তাহাব। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জমজমের পানি পান করেছেন। আমরা বিভিন্ন নেক নিয়তে যমযমের পানি পান করতে পারি। কেননা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যমযমের পানি যে উদ্দেশে পান করা হবে তার সে উদ্দেশ্য হাসিল হবে। তবে কিবলামুখী হয়ে, তিন নিঃশ্বাসে, তৃপ্তি সহকারে, বড় কোনো নেক উদ্দেশে পান করা এবং পান শেষে আলহামদুলিল্লাহ বলা সুন্নত। পান করার সময় এ দুআ পড়া-
“আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিয়া, ওয়া রিযকান ওয়াসিয়া, ওয়া শিফায়াম মিন কুল্লি দা-ইন।”
“হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে উপকারী জ্ঞান লাভের প্রার্থনা করছি। প্রশস্ত রিযিক এবং সকল প্রকার রোগ থেকে মুক্তিলাভের প্রার্থনা করছি।” (মুসতাদরাকে হাকেম, ১ম খÐ, পৃ.-৪৭৩) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. যমযমের পানি পান করার সময় দুআ পড়তেন।
দাঁড়িয়ে বা বসে উভয়াবস্থায়ই পান করা যাবে। যমযমের পানি পবিত্র বস্তু ছাড়া অন্যান্য কাজে ব্যবহার উচিত নয়। এ পানি দ্বারা গোসল করা জায়েজ হলেও ইস্তিঞ্জার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা মাকরুহে তাহরিমী। আর এ পানি পানের নিয়তের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তালিবুল ইলম যারা হক্কানী আলেম হয়ে ইলমের খেদমত করতে চায়, তাদের উচিত ইলম বৃদ্ধির নিয়তে এ পানি পান করা। ওলামায়ে কেরাম যুগে যুগে এ উদ্দেশ্যে পান করেছেন এবং তাদের মাকসাদে পৌঁছেছেন। যেমন- আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতী র. বলেন, হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি র. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি যমযমের পানি পান করেছিলাম স্মৃতিশক্তিতে হাফিজ শামসুদ্দিন যাহাবি র. এর স্তরে পৌঁছার নিয়তে। সুয়ূতী র. বলেন, ইবনে হাজার র. ঐ স্তরে পৌঁছেছিলেন; বরং তার স্মৃতিশক্তি আরও অধিক প্রখর হয়েছিল। (তাবাকাতুল হুফফাজ, ১ম খÐ, পৃ.-৫২২)
আর আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতী র. যমযম পান করেন এই নিয়তে যে, আল্লাহ তায়ালা যেন তাকে ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম সিরাজুদ্দিন আল বুলকিনি র. এর স্তরে এবং হাদিস শাস্ত্রে হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি র. এর স্তরে পৌঁছিয়ে দেন।
প্রসিদ্ধ মুফাসসির আল্লামা ইবনুল আরাবি র. বলেন, ৪৮৯ হিজরির জিলহজ মাসে আমি মক্কায় অবস্থান করছিলাম। আমি খুব বেশি করে যমযম পান করতাম। প্রত্যেকবার যমযমের পানের সময় আমি ইলম ও ঈমানের নিয়ত করতাম। ফলে আল্লাহ তায়ালা এর বরকত আমাকে দান করলেন এবং আমি যথাসাধ্য ইলম হাসিল করলাম। কিন্তু আমলের নিয়তে যমযম পান করতে ভুলে গেলাম। হায়! যদি আমলের নিয়তেও পান করতাম, তবে আল্লাহ আমাকে ইলম ও আমল উভয়টির বরকত নসিব করতেন। কিন্তু তা হলো না। (আহকামুল কুরআন, ৩য় খÐ, পৃ.-৯৮)
আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে জাফর বলেন, হাদিস শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম ইবনে খুজায়মা র. কে জিজ্ঞেস করা হলো, এতো ইলম আপনি কীভাবে অর্জন করলেন? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যমযমের পানি যে নিয়তে পান করা হয় অর্থাৎ তাই কবুল হয়।” আর আমি যখন যমযম পান করেছিলাম, তখন আল্লাহর নিকট উপকারী ইলম প্রার্থনা করেছিলাম। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, ১৪খÐ, পৃ.-৩৭০)
ঐতিহাসিক ইবনে আসাকির বর্ণনা করেন যে, খতিব বাগদাদি র. যমযম পানের সময় তিনবারে পান করেন এবং আল্লাহর নিকট তিনটি জিনিস প্রার্থনা করেন। ১. তার লেখা ‘তারিখে বাগদাদ’ গ্রন্থটি যেন তিনি নিজে বাগদাদে পড়িয়ে শোনাতে পারেন। ২. জামে মানসুর-এ যেন তিনি হাদিসের দরস দেওয়ার সুযোগ পান। ৩. তার দাফন যেন হয় বিশর আল হাফি র. এর কাছে। আল্লাহ তায়ালা খতিব বাগদাদি র. এর সবগুলো চাওয়া পূরণ করে দিয়েছিলেন। (তাবাকাতুশ শাফিঈয়া আল কুবরা, ৪র্থ খÐ, পৃ.-৩৫)
শায়খ ইয়াহইয়া ইবনে আহমাদ আল আনসারি র. কুরআন হিফজের নিয়তে যমযম পান করেন। ফলে তিনি খুবই স্বল্প মেয়াদে কুরআন হিফজ করতে সক্ষম হন।
হাকিম আবু আবদুল্লাহ র. যমযম পান করেন উৎকৃষ্ট রচনা সংকলনের নিয়তে। ফলে তিনি ছিলেন স্বীয় যুগের সবচেয়ে ভালো মানের লেখক ও সংকলক। (ফাতহুল কাদির, ২য় খÐ, পৃ.-৩৯৮-৪০০)
কখনও আলেমগণ অন্যান্য বড় বড় উদ্দেশ্য সামনে রেখে যমযম পান করতেন। যেমন- হাফিজ ইবনে হাজার র. বর্ণনা করেন, ইমাম শাফিয়ী র. তীর নিক্ষেপে পারদর্শিতা অর্জনের নিয়তে যমযম পান করেন। ফলে প্রতি দশটি তীরের নয়টিই তিনি লক্ষ্যস্থলে পৌঁছিয়ে দিতে পারতেন। (ফায়জুল কাদির, ২য় খÐ, পৃ.-৫০৭)
হাফিজ সাখাবী র. ইবনুল জাযারি র. এর জীবনালোচনায় লিখেন, তার পিতা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। চল্লিশ বছর পর্যন্ত কোনো সন্তান লাভ করেন নি। এরপর তিনি হজে গেলেন এবং পূণ্যবান সন্তান পাওয়ার নিয়তে যমযম পান করলেন। পরে একরাতে সালাতুত তারাবিহের পর মুহাম্মাদ আল জাযারির জন্ম হয়। আর জ্ঞান-গরিমায়, বিশেষত কেরাত শাস্ত্রে ইবনুল জাযারি র. এর যে শীর্ষ অবস্থান ছিল, তা তো বিজ্ঞজনের জানাই আছে। (আল গায়াহ, ১ম খÐ, পৃ.-৫৮)
আল্লাহ তাআলা আমাদের হজ্জের ও যিয়ারতের উসিলায় বারবার যমযম দেখার সুযোগ দান করুন এবং তৃপ্তিসহ যমযমের পানি পান করার তাওফিক দিন। আর সকলের নেক উদ্দেশ্যকে কবুল করুন যেমন কবুল করেছেন মাকবুল বান্দাদের থেকে।
আমিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।