Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

আস্থার সঙ্কটে ব্যাংক

প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০১ এএম, ১৩ মার্চ, ২০১৬

হাসান সোহেল : অর্থ গচ্ছিত রাখা এবং বিনিয়োগের নিরাপদ মাধ্যম ব্যাংক। সঞ্চিত অর্থ নিরাপদে বিনিয়োগের জন্য এখনো মানুষের কাছে ব্যাংককই সর্বোত্তম হিসেবে বিবেচিত। বিনিয়োগ ছাড়াও অনেকে শুধু নিরাপত্তার জন্যই ব্যাংকে অর্থ ও সম্পদ গচ্ছিত রাখেন। নিজের ঘরের চেয়েও ব্যাংককে মানুষ নিরাপদ বিবেচনা করেন। আর বিশ্বাস ও আস্থার ভিত্তিতেই ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করে। ব্যাংকের অর্থের মূল উৎসও এই আমানত। এ অর্থ থেকেই ব্যাংকগুলো ঋণ লেনদেন করে। যা দেশের শিল্পায়ন, কৃষি ও সেবা খাতসহ সব খাতেই হয়। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে দেশের আর্থিক খাত অনেক দূর এগিয়ে গেলেও গত কয়েক বছর ধরে শেয়ারবাজার, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংকসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির ঘটনায় কিছুটা আস্থার সঙ্কটে পড়ে ব্যাংকিং খাত। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গ্রাহকের এটিএম বুথের টাকা খোয়া যাওয়ায় তা আরো ঘনীভূত হয়েছে। আর সে পালে হাওয়া দিয়েছে সবচেয়ে নিরাপদ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হাজার কোটি টাকা চুরির ঘটনা। গত সপ্তাহ থেকে এই ঘটনা চাউর হওয়ার পর নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছে গ্রাহক এবং বিভিন্ন ব্যাংক। দেশের ব্যাংকিং খাতে দেখা দিয়েছে চরম সঙ্কট। উল্লেখ্য ’৯০ দশকে ইস্টার্ন নামে একটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়। ওই ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা গ্রাহকদের ফেরত দেয়া হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট থেকে হাজার কোটি টাকা খোয়া যাওয়ার পর এক মাস তা গোপনে রাখার ঘটনা রহস্যজনক। প্রকৃত চিত্র জানার আগেই অর্থমন্ত্রীর লাগামহীন মন্তব্য ব্যাংক চেক্টরের প্রতি মানুষ বিশ্বাসহীনতায় পড়ে গেছে। প্রচারণা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের টাকা ফিলিপাইনের ক্যাসিনোতে উড়ছে। রিজার্ভের খোয়া যাওয়া অর্থের বিষয়ে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোয়েন্দা সংস্থা নিরাপদ মনে করে এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সফটওয়্যার পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্লিয়ারেন্স থাকাও দরকার। বিষয়টি এমন দিকে না গড়ায় যে, যাদের দিয়ে তদন্ত করানো হচ্ছে তারা বিতর্কিত কিংবা শর্ষের মধ্যে ভূত বাসা বেঁধে ফেলেছে। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকাল সার্ভার নিয়ে তদন্তের কথা বলেছেন। সেখানেই সব তথ্য লুকিয়ে আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কর্মকর্তাদের গাফিলতি বা যোগসাজশ আছে কি না তা ক্ষতিয়ে দেখা জরুরি। এ জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার।
রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার এক সপ্তাহেও এখনো এ ঘটনার সুস্পষ্ট কোনো তথ্য মেলেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হ্যাকাররা টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পাশাপাশি টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। তদন্তে নিয়োজিত বিশ্বব্যাংকের সাবেক আইটি বিশেষজ্ঞ রাকেশ আস্তানা বলেছেন, আমরা যতটুকু দেখেছি মনে হয়েছে এটা আনঅথোরাইজড ট্রান্সজেকশন। বাইরে থেকেই এ হ্যাকিং করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এই টাকা আদৌ কোনোদিন উদ্ধার নাও হতে পারে। কারণ ৮১ মিলিয়ন ডলারের অধিকাংশ অর্থ ফিলিপাইনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নেই। ওই অর্থ ক্যাসিনো হয়ে ব্ল্যাক মার্কেটে চলে গেছে। আর যদিও ফেরত পাওয়া যায় তা আনতে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে, যা প্রায় ৩ থেকে-১২ বছর লেগে যেতে পারে। অপরদিকে কম্পিউটারে ম্যালওয়ার বসিয়ে হ্যাকাররা আগে থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে নিউ ইয়র্কে তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ উত্তোলন করে, তা নজরদারি করেছিল। দুই ব্যাংক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে রিজার্ভের টাকা চুরির নেপথ্যে অসাধু ব্যাংকের কর্মকর্তাদের হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। কারণ চুরির সময়ে বন্ধ ছিল ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। একই সঙ্গে লেনদেনের লগ তথ্যও গায়েব হয়ে গেছে। আর এ জন্যই কারা কম্পিউটার ও সার্ভারে প্রবেশ করেছে কিংবা ব্যবহার করেছে সেসব তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র মতে, কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই গোপন পাসওয়ার্ডসহ সার্ভারের প্রয়োজনীয় তথ্য পাচার হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী চুরির কাজটি সম্পন্ন করে সংঘবদ্ধ চক্র। তবে চক্রটি লোকাল সার্ভারে কিছু ক্লু রেখে যেতে পারে বলে জানা গেছে। তাই তদন্তের ক্ষেত্রে লোকাল সার্ভারকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সেজন্য সন্দেহভাজন সার্ভার নিয়ে যুগোপযোগী তদন্ত করতে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘ফায়ারআই’ কাজ শুরু করেছে। জানা গেছে, জালিয়াতির ঘটনায় তিনটি আইডি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তবে পুরো লগ তথ্য এখনো উদ্ধার করা যায়নি। তবে জড়িত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে কিছু ফুটেজও গায়েব করেছে বলে জানা গেছে। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্র দাবি করেছে, ঘটনার সময়কার কিছু ফুটেজ পাওয়া না যাওয়ায় সন্দেহ আরো ঘনীভূত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও ভাবিয়ে তুলেছে।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, এখন তদন্তের মূল জায়গাটাই হচ্ছে লোকাল সার্ভার। সেখানেই লুকিয়ে আছে সব তথ্য। আর সবার দৃষ্টিও সেদিকেই। তিনি বলেন, প্রযুক্তির যুগে অপরাধ করে সবকিছু লুকানো যায় না। আর যারা অপরাধে জড়িত তারাও সে ধরনের ক্লু রেখে গেছে। এটাই এখন তদন্তের অন্যতম ভরসা। তিনি বলেন, এ পরিস্থতিতে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার। কারণ, সার্ভারের অনেক তথ্যই হ্যাকারদের হাতে রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিশেষজ্ঞ বলেন, অভ্যন্তরীণ সম্পৃক্ততা ছাড়া এভাবে টাকা চুরি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তারা বলেন, এখন পর্যন্ত সুইফট নেটওয়ার্ক হ্যাক হওয়ার কোনো নজির নেই। অথচ এখানে বলা হচ্ছে, সুইফট নেটওয়ার্ক হ্যাক করে টাকা চুরি করা হয়েছে। তারা মনে করেন, এখানে টাকা লেনদেনের অর্ডার পাস করার ক্ষেত্রে যেসব নির্দেশনা দেয়া হয় সেগুলো খুবই নিয়ন্ত্রিত। একটি নির্দেশনা দিতে গেলে কমপক্ষে তিনটি স্থান থেকে কনফার্মেশন নিতে হয়। তাই এই টাকা চুরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ জড়িত নন তা একেবারে অবিশ্বাস্য। একই সঙ্গে ওইসব নির্দেশনা দিতে যে কোড ব্যবহার করা হয় তা ওই কম্পিউটার ছাড়াও নেবে না।
তদন্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা জানান, ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে কিছু ফাইল মুছে ফেলা হয়েছে। এসব ফাইল থেকে তথ্য উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কম্পিউটারগুলোতে ম্যালওয়ারসহ বিভিন্ন ভাইরাস প্রতিরোধে ফায়ারওয়াল-ইউটিএমের মতো সিস্টেমও ছিল। কিন্তু সন্দেহভাজনরা যে পিসি ব্যবহার করেছে সেখানে ফায়ারওয়াল-ইউটিএম নিষ্ক্রিয় (ডিঅ্যাক্টিভেটেড) করা ছিল। আর এটাও কৌশল হিসেবে বেছে নেয় ব্যাংকের ভেতরের জালিয়াত চক্র। যদিও জিজ্ঞাসাবাদের শুরু থেকে তারা বলে আসছিল এখানে কোনো ফায়ারওয়াল ছিল না। তবে তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে ফায়ারওয়াল ছিল। কিন্তু ফায়ারওয়ালের কার্যকারিতা বন্ধ ছিল।
এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, লোকাল সার্ভারের তথ্য ও পাসওয়ার্ড জানা চারজনকে ঘিরেই সন্দেহ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। তবে এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। কিন্তু কৌশলগত কারণে সংশ্লিষ্ট এসব কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করছে না কোনো সূত্রই। সূত্র জানায়, সন্দেহভাজন চারজনসহ আরো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার ই-মেইল আইডি, ফেসবুক ও টুইটার স্ক্যান করে দেখা হচ্ছে। তথ্য পাচারের ক্ষেত্রে এসব মাধ্যম ছাড়াও ভিপিএন (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) বা অন্য কোনো অ্যাপস ব্যবহার করেছে কি না তাও তদন্ত করছেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকাসংক্রান্ত যে গোপন ফাইল সার্ভারে সংরক্ষিত ছিল সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আগে থেকে জানা আছে। এর ফলে তারাই এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দারা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানায়, বিশাল টাকা জালিয়াতির সূত্রপাত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই হয়েছে। আর এতে সন্দেহভাজন তিনটি আইডির তথ্য থেকে কিছুটা আঁচ করা গেছে। এছাড়া ঘটনাটি আরো আগে ঘটলেও কৌশলগত কারণে বিলম্বে তা ফাঁস করা হয়। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট বিদেশী ব্যাংকিং চ্যানেলে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে।
কিন্তু এভাবে সময়ক্ষেপণ করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের জড়িত জালিয়াতরা ক্লু মুছে ফেলার চেষ্টা করে। তবে তথ্য উদ্ধারের মতো যথেষ্ট ক্লু বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনটি আইডিতেই রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ডাটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রাথমিক নমুনা ধরেই এগোচ্ছেন গোয়েন্দারা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন সদস্য বলেন, এখন পর্যন্ত কিছু ডাটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভাইরাস আক্রমণ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর আগে থেকে ভাইরাস আক্রমণ হয়েছে বলে এক ধরনের প্রচার চালানো হয়। ওই কর্মকর্তা জানান, দায়িত্বশীল কেউ ছাড়া এ জালিয়াতি করার সাহস কারো হবে না। একই সঙ্গে কারো একার পক্ষেও সম্ভব নয়। ধারণা করা হচ্ছে, ধাপে ধাপে একাধিক স্তরে দায়িত্বশীলরা জড়িত ছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, র‌্যাবের কাছে পাঠানো ডাটাগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষায় কিছু ক্লু পাওয়া যেতে পারে। সে অনুযায়ী র‌্যাব ব্যবস্থা নেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সূত্র আরো জানায়, র‌্যাবের একটি দল বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার এরিয়ার সব তথ্য জানতে চেয়েছে। গত শুক্রবার গোয়েন্দাদের একটি দল সার্ভার এরিয়া পর্যবেক্ষণ করে। এ সময় তারা নির্দিষ্ট করে কয়েকজন কর্মকর্তার বিষয়ে তথ্য জানার চেষ্টা করে। একই সঙ্গে এখানে কর্মরত প্রত্যেকের প্রোফাইল চাওয়া হয়।
পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা দেশের বাইরে এফবিআই ও ইন্টারপোলের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সদস্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করার সক্ষমতা রাখেন। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে গোয়েন্দা পুলিশকে বিষয়টি জানানোই হয়নি।
তদন্তে সহায়তা করছে ফায়ারআই : বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ডলার চুরি যাওয়ার ঘটনা তদন্তে সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ফায়ারআই ম্যান্ডিয়েন্টের ফরেনসিক বিভাগ। ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক ফায়ারআই এর আগে বড় ধরনের বেশ কয়েকটি সাইবার চুরির ঘটনা তদন্ত করেছে। সংস্থাটির এ কাজে বিশেষ দক্ষতা আছে। আর এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির ঘটনা তদন্তে পরামর্শক হিসেবে কাজ করা ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকসের সঙ্গে যুক্ত করা হয় ফায়ারআইকে।
ভারতের ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকস ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য এবং প্রযুক্তিবিষয়ক সাবেক উপপ্রধান রাকেশ আস্তানা এ তদন্তে সহযোগিতা করতে ফায়ারআইকে নিয়োগ করেছেন বলে জানা গেছে। রাকেশ আস্তানা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক পরামর্শক। তার নেতৃত্বে ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকসের একটি ফরেনসিক তদন্ত দল এ ঘটনার তদন্ত করছে। তদন্ত করতে গিয়ে কিছু জায়গায় আটকে যাওয়ায় অধিকতর দক্ষতাসম্পন্ন ফায়ারআইকে যুক্ত করা হয়।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র জানায়, অর্থ পাচারসংক্রান্ত কাজে আবারো ফিলিপাইন সফরে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল। এতে একজন নির্বাহী পরিচালক নেতৃত্ব দেবেন। ওই টিমে একজন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ও একজন উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকবেন। কাল (সোমবার) প্রতিনিধিদল ম্যানিলার উদ্দেশে রওনা হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সূত্র জানায়, ম্যানিলায় যে টিম যাবে সেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারও যুক্ত হতে পারেন।
ফিলিপাইনের ব্যবসায়ীর জড়িত থাকার তথ্য অস্বীকার : এদিকে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এক ফিলিপিনো ব্যবসায়ী। ফিলিপাইনের অর্থ পাচারবিরোধী সংস্থা এ ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে ছয়জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। এ ছয়জনের একজন উইলিয়াম এস গো। তার দাবি, এ চুরির ঘটনায় তিনি জড়িত নন। তাই তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিতেও তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন। উইলিয়াম এস গোর আইনজীবী র‌্যামন এসগুয়েরা দেশটির গণমাধ্যমকে বলেন, ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) একটি শাখায় এস গো এবং তার কোম্পানি সেঞ্চুরিটেক্স ট্রেডিংয়ের নামে যেসব অ্যাকাউন্ট নিবন্ধিত রয়েছে, সেগুলো ভুয়া। এমনকি এসব অ্যাকাউন্টে উইলিয়াম গোর স্বাক্ষরও জালিয়াতি করা হয়েছে। উইলিয়াম গোর পক্ষে তার আইনজীবী র‌্যামন অন্য ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্টগুলো খুলে দিতে ফিলিপাইনের আপিল আদালতে আবেদন করেছেন। এদিকে, আরসিবিসির জুপিটার স্ট্রিটের শাখা ব্যবস্থাপক মাইয়া সান্তোস দেগুইতো জাপান যাওয়ার চেষ্টাকালে ফিলিপাইনের আইনশৃংখলা বাহিনী বাধা দেয়।
সূত্র মতে, এতদিন ব্যাংকিং খাতের অনিয়মের ঘটনায় গ্রাহকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলেও সম্প্রতি এটিএম বুথ থেকে গ্রাহকের টাকা খোয়া যাওয়া এবং আলোচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরি হওয়ার পর ব্যাংকিং সেক্টরের ঊর্ধ্বতনদের মধ্যেও এক ধরনের আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এটিএম বুথের টাকা চুরি হওয়ার পর ব্যাংকগুলোকে কঠোর নজরদারি ও নিরাপত্তার কথা বলা হলেও কর্তৃত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভই অনিরাপদ। তাদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক নামেই খবরদারি করছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের বেপরোয়া ভাব লক্ষ করা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের খবরদারিতে অন্য ব্যাংকগুলোকে সর্বদা ব্যস্ত থাকতে হয়। তিনি জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের থাকা-খাওয়ার ব্যয়ভারও বহন করতে হয় ব্যাংকগুলোকে। তিনি আরো বলেন, ওখানকার কোনো একজন কর্মকর্তা বাংলাদেশের মধ্যে ঘুরতে গেলেও বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ গাড়ি ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার জন্য বলে। ব্যাংকগুলোও বাধ্য হয়েই কর্মকর্তাদের এসব অন্যায় আবদার পূরণ করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংকিং খাত যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে গোটা অর্থনীতিই ফ্যাকাসে হয়ে যাবে। তাই এ খাতটিকে শক্তিশালী রাখতে হবে। এ জন্য আমানতকারীদের আস্থা অটুট ও অবিচল রাখার কোনো বিকল্প নেই। কারণ আমানতকারীদের অর্থ ছাড়া ব্যাংক একমুহূর্তও টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু মানুষের বিশ্বাসে যদি চিড় ধরে যায় তবে মানুষ ব্যাংকবিমুখ হয়ে পড়তে পারে। তাই অবিলম্বে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফেরানোর কথা বলেন তারা।
এদিকে কম্পিউটারে ম্যালওয়ার বসিয়ে হ্যাকাররা আগে থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে নিউ ইয়র্কে তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ উত্তোলন করে, তা নজরদারি করেছিল বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। দুই ব্যাংক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, সুইফট মেসেজিং সিস্টেমে জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ সরানো হয় ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার ব্যাংকে। শ্রীলঙ্কায় যাওয়া ২ কোটি ডলার মাঝপথে আটকানো গেলেও ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকের মাকাটি সিটির জুপিটার স্ট্রিট শাখার পাঁচটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে নেয়া ৮ কোটি ডলার ক্যাসিনো হয়ে হংকংয়ে পাচার হয়ে গেছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ফেব্রুয়ারি ৪ ও ৫ তারিখের মধ্যে হ্যাকিংয়ের ঘটনাটি ঘটেছে। এর কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেন গোপনে পর্যবেক্ষণের জন্য হ্যাকাররা ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে ম্যালওয়্যার ইনস্টল করতে সক্ষম হয়। প্রসঙ্গত, ম্যালওয়্যার হলো এক ধরনের সফটওয়্যার। এগুলো তৈরি করা হয় ব্যবহারকারীকে না জানিয়েই তার কম্পিউটার আক্রমণ করে তথ্য হাতিয়ে নিতে। প্রতিবেদনে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে যে ম্যালওয়্যার আক্রমণ করেছিল তার নমুনা সরবরাহ করা হবে, যাতে বোঝা যায়, এসব ম্যালওয়্যার কি সর্বাধুনিক ছিল নাকি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনলাইন নিরাপত্তা ব্যবস্থাই দুর্বল ছিল।
কাজ করছে সুইফট : বেলজিয়ামভিত্তিক আন্তঃব্যাংক আর্থিক লেনদেনের নেটওয়ার্ক-সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আন্তঃলেনদেনের বিষয়টি নিয়ে তারা কাজ করছে। এই সুইফট মেসেজিং সিস্টেম জালিয়াতির মাধ্যমেই বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ সরানো হয়েছিল। গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে সুইফটের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই হ্যাকিংয়ের ফলে সুইফটের মূল মেসেজিং সেবায় কোনো সমস্যা হবে না এবং স্বাভাবিকভাবেই কাজ চালিয়ে যাবে সুইফট। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ পাচারের বিষয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে সুইফট কাজ করবে, সে সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঞ্চিত অর্থ থেকে গত মাসে হ্যাকাররা ৮১ মিলিয়ন ডলার লোপাট করে। বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক নিরাপদ লেনদেন করতে এই সুইফট মেসেজিং সিস্টেম ব্যবহার করে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আস্থার সঙ্কটে ব্যাংক

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ