Inqilab Logo

শনিবার, ০১ জুন ২০২৪, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কালো দিন আজ

| প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আজ ভয়াল ২১ আগস্ট। ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় দিন। ২০০৪ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। তবে ওই ঘটনায় বেঁচে যান শেখ হাসিনা। ন্যক্কারজনক ওই ঘটনায় প্রাণ হারান মরহুম প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শরীরে স্পিন্টারের ভয়াবহ যন্ত্রণা নিয়ে আহতবস্থায় এখনও বেঁচে আছেন দলটির নেতাকর্মী, সাংবাদিকসহ শতাধিক ব্যক্তি। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।
প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রেনেড হামলা দিবস উপলক্ষে গতকাল পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি পালনের জন্য আওয়ামী লীগ আজ রাজধানীর ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এ আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকবেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে জানা যায়, সেদিন বিকালে ওই সমাবেশে একটি ট্রাকের উপর অস্থায়ী মঞ্চে যখন শেখ হাসিনা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন আকস্মিক এই হামলা চালানো হয়। একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে মারাত্মক বিশৃংখলা ও ধোয়াচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এসময় ঢাকার তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এবং ব্যক্তিগত দেহরক্ষীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাৎক্ষণিকভাবে একটি মানব বলয় তৈরি করে নিজেরা আঘাত সহ্য করে দলীয় সভানেত্রীকে গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা করেন। গ্রেনেডের আঘাত থেকে বেঁচে গেলেও শেখ হাসিনার শ্রবণ শক্তির ক্ষতি হয়।
এই বর্বরোচিত হামলায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন: আইভি রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুন্সী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন, ইসাহাক মিয়া।
ওই সময় সরকারে ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ইন্ধনে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি) ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। ওই ঘটনার পর জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে ঘটনাটিকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই দফা তদন্তে বেরিয়ে আসে ঘটনার আদ্যপান্ত। প্রমাণিত হয় ষড়যন্ত্রের নীলনকশা। মামলার অভিযোগপত্রে নাম আসে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরীসহ অনেকের। ঐতিহাসিক এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ বলেছেন, প্রথম দফা চার্জশিটে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের নাম এলেও কিছু ঘটনা অজানা ছিল। সম্পূরক চার্জশিটে বেরিয়ে আসে গ্রেনেডের উৎস, পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারীদের নাম।
মামলার তদন্ত : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর মতিঝিল থানার এসআই ফারুক হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আবদুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেন। পরে ওই মামলার তদন্ত শুরু করে পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় মোট ৬ জন তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে। তদন্তের শুরুতে আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোল ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর সহায়তা নেয়া হয়। গ্রেনেড হামলার আট দিন পর ২০০৪ সালের ২৯ আগস্ট ইন্টারপোলের দুই কর্মকর্তা মিস জ্যাকুলিন ও জেফ্রি আইলস ঢাকায় আসেন। একই বছরের ১ সেপ্টেম্বর আসেন ইন্টারপোলের কর্মকর্তা এইচ ডবিøউ সিন, মারাস ভুসিনাস ও উইসন গিবসন। ইন্টারপোল ছাড়াও এসেছিলেন এফবিআই সদস্যরা। ওই সময় এফবিআই সদস্যরা কিছু আলামত সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। পরে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সে আলামত ফিরিয়ে দেয় এফবিআই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোতে জানা যায়, গ্রেনেড হামলার মোট তিন দফা তদন্ত হয়েছে। ২০০৪ সালে ঘটনার পর প্রথম তদন্ত হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। কিন্তু ওই সময় তদন্ত শুরু হলেও কোনো প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি। বরং ওই সময় তদন্ত কর্মকর্তারা মামলাটিকে ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করেন। সাজানোর চেষ্টা করেন ‘জজ মিয়া’ নাটক। ওই ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে ২০০৭ সালে তত্ত¡াবধায়ক সরকার আমলে নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। দ্বিতীয় দফার ওই তদন্তের পর ২০০৮ সালের ১১ জুন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ২২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে।
প্রথম চার্জশিটে আসামি যারা : প্রথম চার্জশিটে ২২ জনকে আসামি করা হয়। তারা হলেন জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মুফতি আবদুল হান্নান মুন্সী ওরফে আবুল কালাম ওরফে আবদুল মান্নান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, শাহাদৎউল্লাহ ওরফে জুয়েল, হোসাইন আহমেদ তামিম, মঈন্ উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন ওরফে খাজা ওরফে আবু জানদাল, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ, উজ্জ্বল ওরফে রতন, মো. তাজউদ্দিন, মো. খলিল, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিছুল মুরসালিন, আবুবকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার ও মাওলানা লিটন।
তবে ওই তদন্তে গ্রেনেডের উৎস ও হামলার পরিকল্পনার নেপথ্যে কারা জড়িত তা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। পরে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে সিআইডি পুনঃতদন্ত শুরু করে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে সিআইডি ২০১১ সালের ৩ জুলাই আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করে। এতে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ৩০ জনকে আসামি করে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়ার পর মোট আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২।
সম্পূরক চার্জশিটে অভিযুক্ত যারা : সম্পূরক চার্জশিটে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তারা হলেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, পুলিশের সাবেক আইজি আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হক, পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বকস, ডিএমপির তৎকালীন উপকমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক উপকমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, হুজির আমীর মাওলানা শেখ ফরিদ, নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মাওলানা আবদুর রউফ, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার (বরখাস্ত), বিএনপির ঢাকা মহানগর নেতা আরিফুর রহমান, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির আহŸায়ক মাওলানা আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ, সিআইডির সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, বাবু ওরফে রাতুল বাবু, মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন। অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর ২০১২ সালের ১৯ মার্চ হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের দুটি মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
মামলার আসামিরা কে কোথায় : দুটি মামলায় ৫২ আসামির মধ্যে গ্রেফতারের পর বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন জোট সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ মোট ২৫ জন। অন্যদিকে এ মামলায় পুলিশের সাবেক তিন আইজিপি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বকসসহ আটজন বর্তমানে জামিনে আছেন। গ্রেফতার সাবেক মন্ত্রী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ যুদ্ধাপরাধ মামলায় সাজা প্রাপ্ত হয়ে ইতোমধ্যে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। অপর গ্রেফতার আসামী জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানও অন্য মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় ইতোমধ্যে তারও ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে পলাতক রয়েছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের তৎকালীন রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মাওলানা তাজউদ্দিনসহ মোট ১৯ জন।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) দেয়া তথ্যমতে পলাতক আসামিদের মধ্যে বর্তমানে তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে, বিএনপি চেয়ারপারসনের তৎকালীন রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী যুক্তরাজ্যে, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হানিফ পাকিস্তান, জোট সরকারের আমলে সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ সৌদি আরব, জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই রাতুল বাবু আফ্রিকায়, অপর ভাই মওলানা তাজউদ্দিন দক্ষিণ আফ্রিকায় ও জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর দুবাইয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে ২১ আগস্ট মামলার অন্যতম আসামি দুই সহোদর মোস্তাকিন ও মোরছালিন ভারতের তিহার জেলে আটক রয়েছেন। পলাতক বাকি আসামি ইকবাল, মাওলানা আবু বকর, খলিলুর রহমান, মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার কোথায় আছেন সে তথ্য নেই সিআইডির কাছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ২১ আগস্ট

২২ আগস্ট, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ