Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

সন্ত্রাসীদের অভয়াশ্রম চনপাড়া বস্তি

তালিকাভুক্ত অপরাধী ৫ হাজার : রাতভর চলে মদ নারী ও জুয়ার আসর : অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি

প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : পেশাদার সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল চনপাড়া বস্তি। পেশাদার কিলার, ডাকাত, চোরাচালানি, ছিনতাইকারী, অজ্ঞানপার্টি, অপহরণকারী, প্রতারক, মাদক ব্যবসায়ী, নারী ও শিশু পাচারকারীসহ বিভিন্ন অপরাধী চক্রের একাধিক গ্রুপ রয়েছে এই বস্তিতে। রয়েছে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। রাতভর চলে মদ, নারী ও জুয়ার আসর। রাজধানী থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটারের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানায় এই বস্তির অবস্থান। রাজধানীসহ দেশের যেকোনো স্থানে অপরাধ কর্মকা- ঘটিয়ে অপরাধীরা এখানে নির্বিঘেœ দিনের পর দিন পালিয়ে থাকতে পারে। প্রায় এক লাখ বাসিন্দার মধ্যে এই বস্তিতে কেবল থানা পুলিশের তালিকাভুক্ত অপরাধীই রয়েছে পাঁচ হাজার। বস্তিতে বিদ্যুৎ, পানি ও অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে মাসে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেট।  
জানা গেছে, ১৯৭৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের বিভিন্ন এলাকার নদীভাঙা, ভূমিহীন ও দুর্ভিক্ষকবলিত মানুষদের রূপগঞ্জের চনপাড়ায় পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন। এজন্য ওয়াসার ১২৬ একর জমির ওপর ঘরবাড়ি স্থাপন করে পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু করা হয়। সেই পুনর্বাসন কেন্দ্র একপর্যায়ে চনপাড়া বস্তি নামে পরিচিত লাভ করে। এখানে রয়েছে ২০ হাজার ঝুপড়ি ঘর। ঢাকার উপকণ্ঠে বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীঘেঁষা এই বস্তি ভৌগলিক কারণেই অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। নানা রঙের মানুষ নিয়ে গড়ে ওঠা চনপাড়া বস্তির অভ্যন্তরে শান্তি নেই বললেই চলে। প্রতিনিয়ত লেগে থাকে সংঘর্ষ-সংঘাত।
স্থানীয় বাসিন্দা ও বস্তিবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার অপরাধী চক্রের বেশিরভাগই চনপাড়া বস্তিতে বাস করে। এর মধ্যে পেশাদার খুনি, ডাকাত, ছিনতাইকারী, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি, অপহরণকারী, নারী ব্যবসায়ী, ভ--প্রতারকসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধী রয়েছে। অপরাধীদের কেউ কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করে, কেউবা অপরাধ করে এখানে নিরাপদে পালিয়ে থাকে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভয়ঙ্কর খুনিদের আস্থাভাজনদের আস্তানাও এই বস্তিতে। শরীফ, খলিল, শাহাবুদ্দিন, শমসের, কামালসহ পেশাদার কিলার রয়েছে কমপক্ষে ২০জন। ছিনতাইকারীর কয়েকটা গ্রুপ রয়েছে এই বস্তিতে। এদের নিয়ন্ত্রণ করে ৪, ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রভাবশালী কয়েকজন। ছিনতাইকারী গ্রুপগুলো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়ে সড়ক বা নদীপথে খুব অল্প সময়েই বস্তিতে ফিরে আসে। ছিনতাই করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রও ভাড়া পাওয়া যায় বস্তিতেই। এর আগে যৌথ বাহিনী ও র‌্যাবের অভিযানে বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে এই বস্তি থেকেই।  
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় মাদক সরবরাহ করা হয় এই বস্তি থেকে। টেকনাফ ও কুমিল্লার সীমান্ত এলাকা দিয়ে ইয়াবার বড় বড় চালান প্রথম চনপাড়া বস্তিতে আসে। এখান থেকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সরবরাহ করা হয়। এছাড়া বস্তির অভ্যন্তরে মাদক ব্যবসাতো আছেই। এখানকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে শমসের, শাহাবুদ্দিন, কুলসুম, দীপু, সিরাজ, মোড়ল, রাজা ও তার স্ত্রী রাহি, ছাত্তার, পাগলা পাখি, আতিক ও তার স্ত্রী পারভীনসহ আরো অনেকে। মলম পার্টিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে সুমন ও ফিরোজ। বস্তিবাসীরা জানায়, ঢাকার যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, মহাখালী, গাবতলী, গুলিস্তান, সদরঘাট এলাকার অজ্ঞানপার্টির সদস্যদের বেশিরভাগই সুমনের দলের।
চনপাড়া বস্তির একাংশ হচ্ছে বেদে বহর। রতœপাথর ব্যবসা থেকে শুরু করে চোরাচালানী করে বেদে পরিবারের কমপক্ষে ১০ জন এখন কোটিপতি। বিভিন্ন অপরাধের সাথেও জড়িত রয়েছে কেউ কেউ। বস্তিতে পেশাদার পতিতা রয়েছে অর্ধশতাধিক। জানা গেছে, সরকার দলীয় স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার নেতৃত্বে প্রতি রাতেই বস্তিতে জমজমাট জুয়ার আসর বসে। চলে নারী ও মদ নিয়ে ফুর্তি। এজন্য থানা পুলিশকে মোটা অংকের মাসোহারা দিতে হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ থানা পুলিশ বস্তির সব ধরণের অপরাধ কর্মকান্ডেরই খোঁজ রাখে। অনেকের মতে, পুলিশকে টাকা না দিয়ে এখানে কেউ থাকতেও পারে না।
জানা গেছে, এই বস্তিতে রয়েছে ১০টির মতো মাদক সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত ২ শতাধিক দালাল। আছে র‌্যাব পুলিশের অর্ধশত সোর্স। এরা বস্তি থেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মাদক সরবরাহ করে। এমনকি হোম ডেলিভারীও দিয়ে থাকে। থানা সূত্র জানায়, বস্তিতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী অভিযান চালাতে গেলে সন্ত্রাসী, অপরাধী ও মাদক ব্যবসায়ীরা মিলে পাল্টা আক্রমণ করে বসে। গত পাঁচ বছরে তাদের হামলায় অন্তত: ৫০ জন পুলিশ আহত হয়েছে। সে কারনে যৌথ বাহিনী ছাড়া বস্তিতে অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। যৌথ বাহিনী ও র‌্যাবের অভিযানে মাদক স¤্রাট আনোয়ারসহ বেশ কয়েকজন তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী বস্তি থেকে গ্রেফতার হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে বহু অবৈধ অস্ত্র। এ প্রসঙ্গে রুপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুল ইসলাম বলেন, চনপাড়া বস্তিতে বিভিন্ন দল, মত পেশার মানুষ বসবাস করে। এখানে শিক্ষিত মানুষও আছে, আবার অপরাধীও আছে। তবে আমরা স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগীতায় সেই সব অপরাধীদের চিহ্নিত করেছি। তাদের সবাইকে গ্রেফতারও করেছি। অনেকের সাজা হয়ে গেছে। বাকি যারা আছে তাদেরকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ওসি বলেন, এই নজরদারি বাড়ানোর জন্য বস্তির কাছেই একটা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সন্ত্রাসীদের অভয়াশ্রম চনপাড়া বস্তি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ