ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আফতাব চৌধুরী : গোটা বিশ্বে আজ ‘সন্ত্রাস’ নামক আগুনের স্ফুলিঙ্গ হু হু করে বিস্তার লাভ করছে। সন্ত্রাসের আগুন দগদগ করছে সারাবিশ্বে। বিশ্ববাসী আজ সন্ত্রাসের আগুনের ভয়ে ভীত, কম্পিত ও শংকিত। সেই সন্ত্রাস আজ নিরীহ মানুষকে অশান্তির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। নিরীহ নিরপরাধ মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম সুচারু রূপে চালিয়ে যেতে সন্ত্রাসের অগ্নিকুন্ডে পড়ে দগ্ধ হচ্ছে। আজ বিশ্ববাসীর কাছে সবচেয়ে বড়ো দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সন্ত্রাস নামক আগুনটা। সন্ত্রাস মানুষের মনকে অশান্তি ও অস্বস্তির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। এই অগ্নিকুÐটি নির্বাপিত করতে পৃথিবীর নানা দেশে নানা আইন, নানা পরিকল্পনা হাতে নেয়া হচ্ছে। তবু গোটা বিশ্ব এই অগ্নিকুÐকে নির্বাপিত করতে অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্বের কোনো স্থান এ আগুনের কবলে পড়লে তদন্তের পূর্বে সেখানকার শিক্ষিত, জ্ঞানী, নেতা, মন্ত্রী, গোয়েন্দাকর্মীরা একমত হয়ে নির্দ্বিধায় এসব কাÐের নায়ক হিসেবে মুসলমানদের বেছে নিয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। মিডিয়াও যাচাই না করে এরূপ ঘটনার সম্পূর্ণ দোষ মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে মোটেই দ্বিধাবোধ করে না। এভাবে সুপরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দোষ যখন মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় তখন চতুর্দিকে মুসলমানদের উপর শুরু হয় নির্যাতন ও অত্যাচার। এসব অত্যাচার, নির্যাতনের মাধ্যমে নিরপরাধ মুসলিম যুবকদের মৃত্যুমুখে পতিত করা হয়। আবার অনেক সময় সন্দেহজনকভাবে তাদেরকে আটক করে মানসিক অত্যাচার করার এবং ঘরবাড়ি গুড়িয়ে দেয়ার নজির অসংখ্য রয়েছে। অতীব দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, এসব সন্ত্রাসী আক্রমণের পূর্ণ তদন্তের পর ঝুড়ি থেকে বিড়াল বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। তখন তথ্য ফাঁস হয় যে, এসব কাÐের নায়ক মুসলমানরা নয় বরং অন্য ধর্মাবলম্বী লোক। আক্রমণকারীরা পুলিশের জেরার মুখে পড়ে প্রকাশ করে যে, তারা এ-ধরনের হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে কথিত মুসলিম জঙ্গী সংগঠনগুলোর উপর চাপিয়ে দেয়। এভাবে তদন্তের পূর্বে মুসলমানদের দোষী সাব্যস্ত করে আর কতদিন হেনস্থা করা হবে? মিডিয়া কি সত্য-মিথ্যা যাচাই করে সংবাদ পরিবেশন করবে?
এবারে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল, সন্ত্রাসবাদের তালিকায় কাদের নাম শীর্ষস্থান দখল করতে পেরেছে এবং বর্তমানে মুসলমানদের অযথা কীভাবে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে হেনস্থা করা হচ্ছে তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। ‘সন্ত্রাস’ শব্দটা ১৭৯০-এ প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছিল। একজন ব্রিটিশ কূটনৈতিক এই শব্দটি দিয়ে তদানীন্তন ফ্রান্সে জ্যাকোবিন সরকারকে বুঝিয়েছিলেন। সেই সরকারের প্রধান ম্যাক্রমিলিয়ান রোবসপি ১৭৯৩-৯৪ সালের মধ্যে তিন হাজার মানুষকে হত্যা করেছিলেন গিলেটিনে চড়িয়ে। তাহলে বুঝা গেল সন্ত্রাস শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন অমুসলমানরা এবং এই সন্ত্রাসী যিনি ছিলেন তিনিও অমুসলমান।
১৮৮১ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে হত্যা করেছিল ইগনেসি নামক বুলবুস্ক থেকে আসা এক দল নৈরাজ্যবাদী। ১৮৮৬ সালে শিকাগো শহরে হে মার্কেট স্কোয়ারে শ্রমিকদের মিছিলের মধ্যে একটা বোমা বিস্ফোরণ হয়েছিল। সেখানে ১২ জন নিরীহ মানুষ ৭ জন পুলিশ এবং একজন পুলিশ অফিসার মারা গিয়েছিল। এ কাজটা মুসলমানরা করেনি। করেছিল নৈরাজ্যবাদী ৮ জন অমুসলমান। ১৯০১-এর ৬ ডিসেম্বর তৎকালীন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি উইলিয়াম ম্যাককিনলেকে ‘লিওন’ নামক এক অমুসলমান দু’বার গুলি করে হত্যা করেছিল। ১৯১৪-এর ২৮ জুন সারেজেভোতে অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের আর্ক ডিউক ফ্রাঞ্চ ফাসিন্যাস্ত এবং তার স্ত্রী নিহত হয়েছিলেন। এর জন্য দায়ী ছিল সার্বিয়ার অমুসলমানদের নিয়ে গড়া ইয়ং বসনিয়া দলটি। ১৯২৫-এর ১৬ এপ্রিল বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ারসেন্ট ন্যাভোলিয়া’চার্চে ২৫০ জনেরও বেশি নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছিল। এ কাজটা করেছিল বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৩৪ এর ৯ অক্টোবর যুগো¯øাভিয়ার রাজা প্রথম আলোকজান্ডারকে ‘ভলাদা জার্ডিয়’ নামক এক অমুসলমান হত্যা করেছিল।
১৯৪৬-এর ২২ জুলাইয়ে কিং ডেভিড হোটেল মেনাফেম বেগেনের নেতৃত্বে ইরগুন একটি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। সেখানে ৯৯ জন নিরীহ মানুষ মারা গিয়েছিল। এই ইরগুন আরবি পোশাক পরেছিল যাতে লোকজন মনে করে আরবরাই বিম্ফোরণ ঘটিয়েছে। সেই সময়ই মেনাফেম বেগেনকে ব্রিটিশ সরকার বিশ্বের ১ নম্বর সন্ত্রাসীবলে চিহ্নিত করেছিল। আশ্চর্যের বিষয়, কয়েক বছর পর দেখা গেল, মেনাফেমই ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তী পর্যায়ে কুখ্যাত এ সন্ত্রাসী নেতাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল। প্রশ্ন থেকে যায় বিশ্ববিখ্যাত এই জঙ্গি নেতা কী করে প্রধানমন্ত্রী হলেন, আর কীভাবে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন? পৃথিবীর মানচিত্রে ১৯৪৫ এর আগে ইসরাইল নামে কোনো দেশ ছিল না। ইহুদি এই জঙ্গি নেতার নেতৃত্বে জঙ্গিদল যুদ্ধ করে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিয়ে ইসরাইল নামক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল এবং পরে ঐ জঙ্গি নেতা ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
১৯৬৯-এ জাপানে গুয়াতেমালার রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করেছিল একজন অমুসলমান। ১৯৭৮-এ ইতালির রেগব্রিগেড তাদেরই প্রধানমন্ত্রী আলজোয়ারকে অপহরণ করে ৫৫ দিন পরে হত্যা করেছিল। ইংল্যান্ডে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি বিভিন্ন আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। এরা সবাই ক্যাথলিক। শুধু ১৯৭২ সালেই এরা তিনটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। ১৯৭৪ সাল গিরবোর্ড বারে তারা আরো দুটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে তার নিরাপত্তারক্ষী হত্যা করেছিল। সে ছিল শিখ ধর্মাবলম্বী। আমাদের পার্শ্ববতী দেশ শ্রীলঙ্কায় এলটিটিই নামক জঙ্গি সংগঠন অসংখ্য আত্মঘাতী বোমা হামলা ঘটিয়ে গোটা শ্রীলঙ্কাকে অশান্তির দ্বীপে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিল।
ভারতের আসামে উলফা সদস্যরা ১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ভারতের মাটিতে ৫ শতেরও বেশি আক্রমণ চালিয়েছে। এই উলফা নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। বহু আলোচনা ও বৈঠকের পরও সঠিক পথ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হচ্ছে রাজ্য তথা কেন্দ্র সরকার। মাওবাদীরা গোটা দেশকে তাদের আক্রমণে কাঁপিয়ে তুলছে। আসামের ডিমা-হাসাও জেলার সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কথা আলোচনার অপেক্ষাই রাখে না।
২০০১-এর সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কের ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টার ঘটে গেল এক প্রকার প্রলয়ংকারী দুর্ঘটনা। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডবøু বুশ তৎক্ষণাৎ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন এবং এর জন্য দায়ী করলেন আল কায়দাকে। তারপর আমরা দেখতে পেলাম মিডিয়ার মাধ্যমে গোটা বিশ্বে প্রচার চালানো হলÑএ দুর্ঘটনার নায়ক হচ্ছে ইসলামিক সন্ত্রাসীরা। কে বা কারা এ দুর্ঘটনার হোতা তা দেখতে আমরা যাচ্ছি না। তাদের দাবি মতে যদি মেনে নেই এই ঘটনার হোতা আল কায়দা আর এর জন্যই সারা বিশ্বে মুসলিমরা সন্ত্রাসী বলে প্রচারাভিযান চালানো হচ্ছে তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, ইহুদি, খ্রিস্টান, ক্যাথলিক, তামিলরা যখন এর চেয়ে অধিক ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে গোটা বিশ্বে অশান্তির দাবানল সৃষ্টি করল তখন ইহুদি, খ্রিস্টান, ক্যাথলিক, মাও, তামিল সন্ত্রাসবাদী বলে কেন প্রচারাভিযান চালানো হল না? যখন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার দুর্ঘটনা ঘটল তখন জর্জ বুশ আল কায়দার উপর সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়ে শান্তির দোহাই দিয়ে আফগানিস্তানে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিলেন তার হিংস্র সেনাবাহিনী দিয়ে। গোটা বিশ্ববাসী তার এহেন গর্হিত কাজ দেখল এবং অনেকে তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ ও নিন্দা জানালো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যখন বিশ্বের কুখ্যাত সন্ত্রাসী নেতা মেনাফেম বেগেন তার জঙ্গিদলের মাধ্যমে যুদ্ধ করে আলাদা ইসরাইল রাষ্ট্র গড়তে চাইল তখন এই আমেরিকা মেনাফেমের মতো বিশ্বসেরা সন্ত্রাসী নেতাকে সাহায্য করতে কোনো প্রকার কমতি করল না। আমেরিকার পূর্ণ সমর্থনে বিশ্বে ত্রাস সৃষ্টিকারী নেতা মেনাফেমকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল। আমেরিকা এই জঙ্গি নেতাকে আটক করে কেন শাস্তি দিল না? তাদের আইন কি শুধু সাদ্দাম আর লাদেনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? যে ব্রিটিশ সরকার মেনাফেমকে বিশ্বের ১ নম্বর সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করল সেই সরকার মেনাফেমের নোবেল লাভে কেন বাধা দিল না? এই ইহুদি মেনাফেমই আরবী পোশাক পরে হামলা চালাল যাতে লোকজন মনে করে এটা করেছে মুসলমানরা। এভাবে নানা কৌশল, নানা পন্থা অবলম্বন করে মুসলমানদের সন্ত্রাসবাদী তকমা দেওয়া আর কতদিন চলবে? যারা সন্ত্রাসের জন্মদাতা তাদের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে জোর করে মুসলমানদেরকে এর জন্মদাতা বলে আখ্যায়িত করা মানবতাবিরোধী নয় কি? প্রকৃত সন্ত্রাসবাদের ইতিহাসকে চেপে রেখে মুসলমানদেরকে বিশ্বসন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করার ধারা কি বন্ধ হবে?
আসুন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একমত হয়ে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান চালাই। নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে সন্ত্রাসবাদী তকমা না-দিয়ে প্রকৃত সন্ত্রাসবাদীদের চিহ্নিত করে তাদের সমূলে ধ্বংস করা এবং সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবী গড়ার জোর প্রয়াস চালাই। এ পৃথিবী যেন সন্ত্রাসমুক্ত হয়ে শান্তির রাজ্য হয়ে উঠে এই কামনা আমাদের।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।