Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কর্মসংস্থান নেই হাজার হাজার প্রশিক্ষিত বেকার নার্সের

প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ নার্স নিয়োগ

প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্যসেবায় গতি বাড়াতে এবং নার্স সঙ্কট দূরীকরণে ১০ হাজার নার্স নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২ বছর হয়েছে। বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণা দেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিকে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য খাতের সফলতা তুলে ধরছেন। অথচ দীর্ঘদিন থেকে হাজার হাজার নার্স প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নিয়োগের আবেদন জানিয়ে আসছেন। হাসপাতালে রোগীদের সেবার পরিবর্তে তারা রাস্তায় কাটাচ্ছেন নিয়োগের দাবিতে। তারপরও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
দেশের চিকিৎসাসেবার একটি বড় সমস্যা নার্স সঙ্কট। যা দেশের চিকিৎসাসেবার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও চিকিৎসাসেবায় পিছিয়ে থাকার নেপথ্যে নার্স সঙ্কটকেই দায়ী করছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবাও কার্যত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছাতে বড় বাধা ব্যাপক নার্স সঙ্কট। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসকদের পাশপাশি নার্সদের অধিক গুরুত্বারোপ করলেও বাংলাদেশে উল্টো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ইনকিলাবকে বলেন, সুষ্ঠু চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে দেশে নার্সের সংখ্যা বাড়াতেই হবে। বেড অনুসারে কিংবা ডাক্তার অনুসারে নার্স না থাকা বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার বড় ঘাটতি।
সূত্রমতে, প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত নার্স নিয়োগ। গত দুই বছর থেকে নিয়োগের দাবিতে মানববন্ধন, র‌্যালি, প্রশাসনের সাথে আলোচনা করলেও কোন কাজ না হওয়ায় গত মঙ্গলবার থেকে ব্যাচ, মেধা, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেকার নার্সরা। গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল অবস্থান ধর্মঘটের তৃতীয় দিন। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সুভাষ চন্দ্র সরকারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করে তাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলেছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ডিপ্লোমা বেকার নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএনএ) মহাসচিব ফারুক হোসাইন। তিনি জানান, প্রতিনিধিদল তাদের বলেছে, তারা বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু আন্দোলনকারী নার্সরা বলেছেন, লিখিত কাগজ চাই। আমাদেরকে আগের মতো ব্যাচ, মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। জানা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার রাতেও শত শত নার্সরা সেখানে অবস্থান করেন। অবস্থান কর্মসূচি থেকে তারা সরকারকে আগামী ২৩শে জানুয়ারি পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে তাদের দাবি পূরণ না হলে সরকারি পর্যারের সর্বস্তরের নার্সদের নিয়ে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ারও ঘোষণা দেন তারা।
অবস্থান ধর্মঘটে অংশ নেয়া নার্সরা জানান, ‘হয় চাকরি; নয় বিষ’। তারা বলেন, অমাদের কোন উপায় নেই। দীর্ঘদিন থেকে বেকার জীবন পার করছি। প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে নার্স নেতৃবৃন্দ বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নার্সবান্ধব। নার্সিং পেশার মানোন্নয়নের সব সময় কাজ করে যাচ্ছেন। নার্সদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ৩৭শ’ শূন্য পদসহ ১০ হাজার নার্স নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কোন একটি মহল নার্সদের নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির ২ বছর পার হলেও নার্স নিয়োগ বাস্তবায়ন করছে না। তারা নার্স নিয়োগে আবারও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।  
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী, সুষ্ঠু চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের জন্য পর্যাপ্ত নার্সের প্রয়োজন। সে হিসেবে বিশ্বের প্রায় সব দেশে চিকিৎসকদের চেয়ে নার্সের সংখ্যা বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে এই চিত্র একেবারে উল্টো। ফলে দেশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে রোগীদের উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা বিঘিœত হচ্ছে।   
বাংলাদেশ ডিপ্লোমা বেকার নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রিনা আক্তার জানান, পূর্বের চলমান নিয়ম ব্যতিরেকে বিপিএসসির মাধ্যমে নার্স নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১০ নার্সের পদ সৃষ্টি করে পূর্বের ন্যায় ব্যাচ, মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে দ্রুত নিয়োগ বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশে ১৮ হাজার ডিপ্লোমা বেকার নার্স রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রায় চার হাজার নার্স সমাবেশে অংশ নিয়ে আন্দোলন করছেন।
আন্দোরত বেকার নার্সরা জানান, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে প্রায় ৪ হাজার বেকার নার্সের সরকারি চাকরির বয়স চলে গেছে। প্রশিক্ষিত ১০ হাজারের বেশি নার্স রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। অথচ সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রায়ই বলেন, নার্সের অভাবে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য সেবায় গতি বাড়াতে এবং দেশের নার্স সঙ্কট দূরীকরণে বর্তমান সরকার ২০১৩ সালে একসঙ্গে ৪ হাজার ১০০ জন নার্স নিয়োগ দেয়। ২০১৪ সালে বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে আন্তর্জাতিক মাতৃদুগ্ধ দিবসে ৩৭শ’ শূন্য পদসহ ১০ হাজার নার্স নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর স্বাস্থ্য খাতের সকল অনুষ্ঠানে প্রধামন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নতুন করে নার্স নিয়োগের কথা জানান। কিন্তু কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে নার্স নিয়োগ।   
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, দেশে সরকারি নার্সের সংখ্যা ২৭ হাজার এবং বেসরকারি নার্সের সংখ্যা ১৩ হাজার ৪৭২ জন। যদিও বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল (বিএনসি) সূত্র জানায়, প্রয়োজনের তুলনায় এখনো প্রায় দুই লাখ নার্স কম রয়েছে বাংলাদেশে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকতে হয়। এ অনুপাতে দেশে বর্তমানে আরো ৪০ হাজার নার্স প্রয়োজন। তেমনি হাসপাতালের প্রতি চারটি বেডের জন্য একজন নার্স দায়িত্ব পালন করার নিয়ম। সে অনুযায়ী ৬০ হাজার নার্স সঙ্কট রয়েছে; রোগীর সংখ্যা অনুযায়ী নার্স দরকার ৮০ হাজার। একই সঙ্গে জনসংখ্যার অনুপাতে দেশে নার্স দরকার আড়াই লাখের উপর। কিন্তু বাংলাদেশে এ অনুপাত কার্যকর হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে একজন নার্সের বিপরীতে সেবাপ্রার্থীর সংখ্যা আট হাজারের বেশি। এ সঙ্কট দূর করতে না পারার কারণেই নার্সের ওপর নানাভাবে কাজের চাপ বেড়ে যায়। যা একপর্যায়ে মানসিক চাপ বা নিপীড়নে পরিণত হয়। রোগী সেবায় সেবিকাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোগীদের অধিকাংশ সময় থাকতে হয় সেবিকাদের তত্ত্বাবধানে। মায়া-মমতা মাখানো সেবা দিয়ে একজন রোগীর সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে তারা। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেবা শুশ্রƒষার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, শুধু চিকিৎসা দ্বারা রোগীকে সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সেবিকার ভূমিকা অপরিসীম, যা কেবল শিক্ষিত ও দক্ষ সেবিকা দ্বারাই প্রদান করা সম্ভব।
দেশের সর্বশেষ প্রকাশিত হেলথ ওয়াচ রিপোর্ট অনুসারে দেশে প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ২ লাখ নার্সের ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নার্সের (মিডওয়াইফসহ) সংখ্যা ২৮ হাজার ৭৯৩ জন। এর মধ্যে ১৭ হাজার ৭৯৪ জন নার্স (রেজিস্টার্ড নার্স-মিডওয়াইফ) সরকারি নার্সিং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত এবং প্রায় ১৩ হাজার নার্স দেশে অবস্থিত বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওতে কর্মরত। এ ছাড়া সরকারি লিয়েনসহ মোট ১ হাজার ১০০ জন নার্স বিদেশে কর্মরত আছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বাসুদেব গাঙ্গুলী ইনকিলাবকে বলেন, শিগগিরই নতুন করে নার্সদের নিয়োগ দেয়া হবে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার নার্সদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা দিয়েছে। এ কারণে কিছু নিয়ম দেখা দিয়েছে। আর সে কারণেই নিয়োগে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে খুব শিগগিরই সমস্যার সমাধান হবে বলে উল্লেখ করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কর্মসংস্থান নেই হাজার হাজার প্রশিক্ষিত বেকার নার্সের
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ