Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চাপে ব্যর্থ উদ্ধার অভিযান

প্রকাশের সময় : ১০ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : ঢাকায় রেলওয়ের বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করা যাচ্ছে না। দফায় দফায় অভিযান চালিয়েও কাজ হচ্ছে না। স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না অবৈধ দখলদারদের। রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীদের চাপের কাছে বরাবরই হেরে যাচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ের এস্টেট বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীর গে-ারিয়া বস্তি থেকে টঙ্গী সেতু পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রেললাইনজুড়ে গজিয়ে উঠেছে প্রায় ১২শ’ স্থাপনা। এর মধ্যে ছোট-বড় ২৬টি বস্তিতে ঘরবাড়ি আছে ৯শ’। আছে পাকা-আধাপাকা আরও আড়াইশ’ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। রেলওয়ের জায়গা দখল করে দখলবাজরাই রেলওয়ে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উল্টো মামলা দায়ের করে থাকে। একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়েরের মাধ্যমে রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানির ফাঁকে ফাঁকে রেলজমিতেই স্থায়ী ভিত্তি গড়ে তোলে দখলবাজরা। রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চল) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হলেও দখলবাজরা দুই-চার দিন সটকে থাকে, আবার পুরনো স্টাইলে একের পর এক জায়গা জমি গ্রাস করতে থাকে। এসব দখলদারদের নেপথ্যে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছে প্রভাবশালী রাজনীতিক এবং তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ডাবল ট্র্যাক নির্মাণের অংশ হিসাবে জুরাইন থেকে গেন্ডারিয়া পর্যন্ত বাজার ও বস্তি উচ্ছেদ কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে স্থানীয় দুই এমপির পরোক্ষ বাধার মুখে। কয়েকবার অভিযান চালিয়েও রেল কর্তৃপক্ষ সফল হতে পারেনি। স্থানীয় এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার সমর্থকদের অভিযোগ সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি অ্যাডভোকেট সানজিদা খানমের লোকজন উচ্ছেদ করা হবে না Ñ এমন গ্যারান্টি দিয়ে অবৈধ দখলদারদের কাছে থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আবার সানজিদার সমর্থকদের অভিযোগ এমপি বাবলার লোকজন উচ্ছেদকৃত জায়গায় নতুন করে বরাদ্দ দেয়ার নাম করে ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। মুখে বিরোধিতা না করলেও এই দুই এমপির কেউই উচ্ছেদের পক্ষে নয়। রেল কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ করতে গেলেই দুই এমপির সমর্থকরা পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল মিটিং করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারদলীয় রাজনীতিবিদ, স্থানীয় মাস্তান ও প্রভাবশালীরা রেললাইনের জায়গা বস্তিবাসী ও দোকানদারদের মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া দেয়। ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশনের আশপাশের কিছু জায়গা মোটা অঙ্কের বিনিময়ে এককালীন বরাদ্দ দেয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি মাসে সপ্তাহব্যাপী টানা অভিযান চালিয়ে ৮ শতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। জবরদখলকৃত জায়গা কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরাও দিয়ে রেলওয়ের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হলেও তা বেশিদিন বহাল থাকেনি। এক মাসের মধ্যে কাঁটাতারের ঘেরাওয়ের ভেতরেই বস্তি, ওয়ার্কশপ, গ্যারেজ ও দোকানপাট গড়ে ওঠে বিনা বাধায়।
সূত্র জানায়, তেজগাঁও এফডিসি সংলগ্ন রেললাইনের পাশে ঘেরাও দেয়া কাঁটাতারের বেড়া কেটে বস্তিতে প্রবেশের রাস্তা বানানো হয়েছে। মালিবাগ রেলগেট থেকে মগবাজার রেলগেট পর্যন্ত রেল বিভাগের হিসাবেই ১২৩টি অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৪১টি গ্রিলের দোকান, ১৮টি মোটর ওয়ার্কশপ, ৮টি গাড়ি গ্যারেজ এবং বাকিগুলো অন্য দোকানপাট। খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় ঠিক রেললাইনের ওপরই বসেছে কাঁচাবাজার। শাক-সবজি, মাছ, ডিম, মুরগি, মাংস বিক্রেতারা অস্থায়ী শেড বানিয়ে গত ৮/১০ বছর ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে আসছে। ট্রেনের হুইসেলের শব্দে ক্রেতা-বিক্রেতারা একটু সরে দাঁড়ায় এবং ট্রেন চলে যেতেই আবার জমে ওঠে হাট-বাজার। সেখানে অবৈধভাবে দোকান বসানো শতাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ‘লাইনম্যান’ নামে পরিচিত জয়নাল ও ফারুক দৈনিক চাঁদা আদায় করে। প্রতি দোকান থেকে ৩০ টাকা হারে আদায় করা চাঁদার ভাগ পায় খিলগাঁও থানা পুলিশ ও রেলওয়ের সিগনাল বিভাগের এক কর্মচারী।
তেজগাঁও এফডিসি ক্রসিং থেকে মহাখালী ক্রসিং পর্যন্ত রেললাইনের উভয়পাশে রয়েছে ঘিঞ্জি বস্তি। কাওরান বাজার সংলগ্ন রেললাইনের পাশেই গড়ে উঠেছে ৫ শতাধিক বস্তিঘর। সেখানে বাংলা মদ, হেরোইন ও গাঁজা বেচাকেনার ৪টি জমজমাট স্পটও চালু আছে। কাওরান বাজারের দু’টি ক্লাব এবং মাসুদ-তুহিন গ্রুপের নামে প্রতি মাসে চাঁদা ওঠে দেড় লক্ষাধিক টাকা। তেজগাঁও স্টেশন সংলগ্ন রেললাইনের জমিতে বসানো হয়েছে বড় আকারের ৬টি কলার আড়ত। কর্মচারী সমিতির সেক্রেটারি পরিচয়ে কামরুল ইসলাম প্রতিটি কলার আড়ত থেকে ৪ হাজার করে মাসিক ২৪ হাজার টাকা ভাড়া তোলে বলে জানা গেছে। তেজগাঁও স্টেশনের উত্তর পাশ থেকে তিব্বত আলকাতরা ফ্যাক্টরি পর্যন্ত বস্তির বাসিন্দারা রেললাইন ঘেঁষেই সারি সারি টয়লেট বানিয়েছে। এসব কাঁচা ও খোলা টয়লেটের দুর্গন্ধে এ জায়গা অতিক্রমকালে ট্রেনযাত্রীদের দম বন্ধের উপক্রম হয়।
মহাখালী পুলিশ বক্সের অদূরে রেললাইনের জায়গা জুড়ে বড় আকারের কাঁচা বাজার প্রাইভেট গাড়ি রাখার তিনটি গ্যারেজ, ৫টি গ্রিল ওয়ার্কশপ এবং দু’টি রেস্টুরেন্ট বানানো হয়েছে। বিমানবন্দর রেলস্টেশনের একাধিক কর্মচারী অভিযোগ করে জানান, একটি যুব সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে স্থানীয় আলতাফ, কুদ্দুস মোল্লা, মোতাহার বাবু রেলের জায়গা মেপে মেপে ব্যবসায়ীদের কাছে বরাদ্দ দিচ্ছে। ১০ ফুট বাই ১০ ফুট জায়গা অলিখিত বরাদ্দ নিতে এককালীন ৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। কিন্তু পাল্টা অভিযোগ তুলে মোতাহার বাবু ও আলতাফ জানায়, সেখানে গরিব ব্যবসায়ীরা ঝুপড়ি দোকান তুলতে চাইলেও স্টেশনের কর্মচারীরা চাঁদা দাবি করে বসে। লাকড়ির দোকানদার বাদশা, রাজু ও ছবেদ আলীর কাছ থেকে রেল কর্মচারী রহমান প্রতিদিন ১০০ টাকা করে চাঁদা নেয় বলেও সূর্যসেনা ক্লাবের এক নেতা অভিযোগ করেন।
রেলের জায়গা জবরদখল ও বেচাকেনার ব্যাপারে রেল বিভাগের পরিচালক (ভূমি) জানান, যেকোন মুহূর্তে আবার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। এখন থেকে অবৈধ দখলদারদের সতর্ক নোটিশও আর দেয়া হবে না। তিনি জানান, কিছুসংখ্যক কুচক্রীমহল রেলের জায়গার জাল দলিলপত্র বানিয়ে জবরদখলের পাঁয়তারা চালায়। উচ্ছেদ অভিযানের তোড়জোড় শুরু হলেই কুচক্রীরা আদালতে মামলা ঠুকে এবং উচ্ছেদ কাজে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চাপে ব্যর্থ উদ্ধার অভিযান
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ