Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিচারপতিদের কটাক্ষের এখতিয়ার এমপিদের নেই

সুজনের সেমিনারে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অভিমত

| প্রকাশের সময় : ১২ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার :ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় নিয়ে জাতীয় সংসদে ‘সর্বচ্চো আদালত’ নিয়ে সংসদ সদস্যদের কটাক্ষপূর্ণ বক্তব্যে দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে এমপিদের বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও করণীয় গোলটেবিলে আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর বিচারপতিদের কটাক্ষ করে সংসদে যে আলোচনা হয়েছে, তাতে সংসদ সদস্যরা নিজেদের করা আইনই ভঙ্গ করেছেন। এটা দুঃখজনক। এ ধরনের বক্তব্য রাখার এখতিয়ার তাঁদের নেই। উচ্চ আদালত সংসদে পাশ করা যেকোনো আইনকে বেআইনি ঘোষণা করতেই পারেন সংবিধান আদালতকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে। বিচার বিভাগ স্বাধীন, কিন্তু মোটেও চাপমুক্ত নয়। বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত রায়কে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক বলে মন্তব্য করেন তারা। দেশে গণতন্ত্র যখন কম থাকে আর কর্তৃত্ববাদী সরকার বেশি থাকে, তখন ন্যায়বিচার ও বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সবাই সচেষ্ট হতে থাকে বলে মন্তব্য করেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবেরর ভিআইপি লাউঞ্জে ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারে অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, ড. সি আর আবরার, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়–য়া এবং অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী প্রমুখ। গোলটেবিল বৈঠকে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন নির্বাহী সদস্য ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক।
দেশে গণতন্ত্র যখন কম থাকে আর কর্তৃত্ববাদী সরকার বেশি থাকে, তখন ন্যায়বিচার ও বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সবাই সচেষ্ট হতে থাকে। এই অবস্থায় বিচার বিভাগকে আরও স্বাধীন, আরও সুদৃঢ় ও আরও কার্যকর করার জন্য বিচার বিভাগের পাশে ও পক্ষে সবার দাঁড়ানো দরকার’ বলে মন্তব্য করেছেন আলোচকবৃন্দ।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, মাননীয় প্রধান বিচারপতির মতে, এখন বিচার বিভাগ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি স্বাধীন এবং বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা বেড়েছে। কথাগুলো সত্য, কিন্তু এতে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা চাই বিচার বিভাগের আরও বেশি স্বাধীনতা আর জনগণের আরও বেশি আস্থা। কারণ এই স্বাধীনতা এবং আস্থাই কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গুাংত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। তিনি বলেন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সময়কাল বাদ দিলে, এখন নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে টানাপোড়েন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। এই ধাক্কাধাক্কিতে ইদানিং যুক্ত হয়েছে সংসদও। ষোড়শ সংশোধনী প্রবর্তন এবং পরবর্তীতে আদালতের দ্বারা বাতিলের ঘটনায় নিকট ভবিষ্যতে একদিকে বিচার বিভাগ ও অন্যদিকে নির্বাহী ও আইন বিভাগের মধ্যে টানাপোড়েন বাড়াতে পারে। অর্থাৎ বিচার বিভাগ স্বাধীন, কিন্তু মোটেও চাপমুক্ত নয়।
ড. শাহদীন বলেন, ক্ষমতার বিভাজনের নীতি অনুসরণে আমাদের সংবিধানে আইনসভাকে আইন প্রণয়নের, নির্বাহী বিভাগকে আইন প্রয়োগের এবং বিচার বিভাগকে বিচারিক পর্যালোচনার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বিচার বিভাগের বিচারিক ক্ষমতার মধ্যে সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদান অন্তর্ভুক্ত। তাই বিচারিক পর্যালোচনার এবং সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে উচ্চ আদালত সংসদে পাশ করা যেকোনো আইনকে অসাংবিধানিক বা বেআইনি ঘোষণা করতেই পারেন সংবিধান আদালতকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, সঠিক ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করে। এজন্য পুলিশ ও বিচারকের সাথে সাথে দরকার দক্ষ ক্যাডারভিত্তিক সরকারি প্রসিকিউশন অথবা অ্যাটর্নি সার্ভিস। সংবিধান অনুযায়ী, বিচারপতি নিয়োগের স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য আইন প্রণয়ন করতে হবে। সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল করে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ প্রতিস্থাপন করে বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরো বলেন, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে রায়ের আলোচনার এখতিয়ার সংসদ সদস্যদের নেই। এটি নিয়ে আলোচনা করে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের নিয়মকানুন ভঙ্গ করেছেন। তিনি সংসদের ওই আলোচনা ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করে সংসদ সদস্যদের দেখার জন্য অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, তাহলে উপলব্ধি হবে, তাঁরা আসলে কী করেছেন।
এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, আমরা বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও কার্যকর দেখতে চাই। কিন্তু কলুষিত রাজনীতি বিরাজমান থাকলে বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে না। এ অবস্থায় দুর্নীতি রোধ করা এবং রাজনৈতিক সংস্কার দরকার, যাতে বিচার বিভাগকেও স্বাধীন করা যায় এবং মানুষ ন্যায়বিচার পায়। বিচার বিভাগকে স্বাধীন করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নাগরিকের অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির ভিত্তিতে সরকারি ক্ষমতাকে তিনটি বিভাগে - আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগে -বিভাজন করা হয়। এই তিনটি বিভাগকে সম কিন্তু ভিন্ন ক্ষমতা দেয়া হয়। তিনি বলেন, সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ৫৩, ৬৩, ও ১৩৩ ধারা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে সংসদে আলোচনা করা যাবে না। এই বিধি সংসদপ্রণীত একটি আইন। সংসদ সদস্যরা নিজেরাই তাঁদের করা এই আইন মানেন না। এটা দুঃখজনক।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বলেন, বিচার নিষ্পত্তি হতে দেরি হওয়ায় বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা কম। বর্তমানে উচ্চ আদালতে প্রায় তিন লাখ মামলা ঝুলে আছে। নিম্ন আদালতেও ২০ জন বিচারপতির বদলে ১০ জন দিয়ে বিচার কার্য চালানো হচ্ছে। তাই দ্রæততম সময়ের দলীয় বিবেচনার বদলে দক্ষ লোকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া দরকার।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, কোনো দেশের বিচারব্যবস্থা সে দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বাইরে নয়। এটা সব আমলেই যা ছিল এখনো তা-ই। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা এ জন্যই বারবার বলা হয়, যাতে রাষ্ট্রের শক্তিশালী ব্যক্তিটির সঙ্গে সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটিও ন্যায়বিচার পায়। স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিচার বিভাগের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, নিন্ম আদালতের স্বাধীনতা নিয়ে আমরা অনেক কথা বলি। কিন্তু উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা নিয়ে আমাদের বেশি সোচ্চার হওয়া দরকার। কারণ এটি মানবাধিকার রক্ষার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত রায়কে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ড. সি আর আবরার বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় বের হওয়ার আগেই সংসদে এ নিয়ে উত্তেজনাকর বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। সংসদ সদস্যরা বলছেন, সংসদ সার্বভৌম। এটি ঠিক নয়। বরং জনগণ সার্বভৌম।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, স্বাধীন দেশে সবাই কেন নিজ নিজ স্বাধীনতা নিয়ে আজকে চিন্তিত তা গণতান্ত্রিক সরকারকে ভাবতে হবে। বিচারপতি নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।



 

Show all comments
  • তাসমী ১২ জুলাই, ২০১৭, ১:২৩ এএম says : 0
    আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুক।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Hafizur Rahim ১২ জুলাই, ২০১৭, ৩:১২ এএম says : 0
    Sovereignty belongs to the people of Bangladesh, Legislative (parliament),Judicial (courts) and Administration are three different organs to defend this sovereignty. None of the three organs are under anyone, together they are supreme. Every organ has different function and they work independently in their own jurisdiction. In Bangladesh people consider parliament is over every other organ. It is not correct. This knowledge is wrong and it has developed for high handedness of parliament. This needs clarification.
    Total Reply(0) Reply
  • albayan ১২ জুলাই, ২০১৭, ১:০৩ পিএম says : 0
    sorkare dol onek valo bole dos vni
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিচারপতি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ