Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বাড়তি ভাড়া বহাল

গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছেই : ঈদকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চাঁদাবাজি

| প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : ঈদকে কেন্দ্র করে এবারও বেশি লাভের আশায় ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছিলেন পরিবহন মালিকরা। ভাড়া বাড়ানোর দৌড়ে পিছিয়ে ছিল না সরকারি সড়ক পরিবহন সংস্থা বিআরটিসিও। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর কড়া হুঁশিয়ারির পরেও বিআরটিসিও বাড়তি ভাড়া আদায় করতে দ্বিধা করেনি। ঈদকে কেন্দ্র করে সেই বাড়তি ভাড়া এখনও বহাল আছে কোনো কোনো পরিবহনে। বিশেষ করে শহরতলীর বাসগুলোতে এখনও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-নরসিংদী, ঢাকা-গাজীপুর, ঢাকা-দাউদকান্দি, ঢাকা-মাওয়া রুটে অনেক বাসেই বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
সারাদেশে গণপরিবহনে নৈরাজ্য চললেও এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই। পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা নেই বলেলেই চলে। ভাড়া আদায়ে স্বেচ্ছাচারিতা, সিটিং, গেইটলট, স্পেশাল সার্ভিসের নামে প্রতারণা, যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, ফিটনেসবিহীন গাড়ির ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে গণপরিবহন এখন যাত্রী দুর্ভোগের বাহন হয়ে উঠেছে। পরিবহন মালিক শ্রমিকদের স্বার্থের সিন্ডিকেটের কারণে পদে পদে লাঞ্ছনা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। অন্যদিকে, ঈদকে কেন্দ্র করে সড়কে-মহাসড়কে যুক্ত হয়েছে নতুন করে চাঁদাবাজি। প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁওয়ের মুগড়া পাড়ার চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ বাস মালিকরা। বাস মালিক সমিতির নেতারা বলেছেন, এই চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সবক’টি রুটের বাস ধর্মঘট ডাকা হতে পারে।
ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকার সবগুলো বাস টার্মিনালে দুরপাল্লার বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। মালিকপক্ষ বাড়তি এই ভাড়ার কথা স্বীকার না করলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। অগ্রিম টিকিট থেকে শুরু করে ঈদযাত্রায় যেকোনো বাসের টিকিটের দাম রাখা হয়েছে বেশি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে বরিশাল, যশোর, খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের সবক’টি জেলায় যাওয়ার দুরপাল্লার বাসগুলোতে বাড়তি বাড়া আদায় করা হয়েছে। ঈদ শেষে ঢাকায় ফেরার পথেও গাড়ির সঙ্কট দেখিয়ে আরও বেশি ভাড়া আদায় করা হয়েছে বলে ভুক্তভোগিরা জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, গাবতলী টার্মিনাল থেকে হানিফ, সাকুরা, নাবিল, রোজিনা, গোল্ডেন লাইন, দ্রুতিসহ উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো বাসেই বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। আবুল হোসেন নামে যশোরের এক যাত্রী বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে সেই বাড়তি ভাড়া এখনও বহাল রেখেছে কোনো কোনো বাস কোম্পানী। বরিশাল থেকে ঢাকার ভাড়া ৪৫০ টাকার স্থলে ৫১০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। একইভাবে এসি বাসে টিকিট প্রতি ৩শ’ টাকা অতিরিক্ত নেয়া হচ্ছে।
গত ৭ জুলাই শুক্রবার চাকরির পরীক্ষা দিতে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন রফিকুল ও মিনহাজ নামে দুই যুবক। কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় বাসে আসতে এই দুই যুবককে ৮শ’ করে ১৬শ’ টাকা গুনতে হয়েছে। অথচ ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামের ভাড়া ৫শ’ টাকা। ঈদকে কেন্দ্র করে সেই ভাড়া ৩শ’ টাকা বেড়ে ৮শ’ টাকা হয়েছিল। ঢাকা-কুড়িগ্রাম রুটে চলাচলকারী হানিফ ও নাবিল পরিবহনে বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগিরা। এ বিষয়ে রফিকুল বলেন, বাড়তি ভাড়ার বিষয়ে তারা প্রশ্ন করলে কাউন্টার থেকে তাদেরকে জানানো হয়, ঢাকা থেকে বাসগুলো আসছে যাত্রী ছাড়াই। এজন্য ফিরতি যাত্রীদের কাছে থেকে ‘একটু বেশি’ নেয়া হচ্ছে। জানতে চাইলে গাবতলী টার্মিনালের সাকুরা পরিবহনের ম্যানেজার জানান, স্বাভাবিক সময়ে উভয় পাশ থেকে যাত্রী হয়। তখন ৪০ সিটের গাড়ীতে ত্রিশ জন করে যাত্রী হলেই চলে। এছাড়া তখন প্রতিযোগিতা থাকায় ভাড়া কমিয়ে ৪৫০ বা তারও কম টাকা করে নেওয়া হয়। এখন এক দিক থেকে যাত্রী হওয়াতে সরকার নির্ধারিত ভাড়াই নেওয়া হচ্ছে।
সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে চলাচলরত চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফেনী রুটে চলাচলকারী সবগুলো বাসের ভাড়া ঈদকে কেন্দ্র করে বেড়েছিল। নোয়াখালী রুটের এক বাস মালিক বাড়তি টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, ঈদের আগে ও পরে ৪/৫দিন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে। কিন্তু এখন আগের মতোই স্বাভাবিক ভাড়া নেয়া হচ্ছে। সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যাওয়া তিশা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, ঈদের সময় একদিক থেকে যাত্রী হয়। সে কারনে জ্বালানী ও স্টাফ খরচ উঠাতে কিছু বাড়তি ভাড়া নেয়া হয়। তবে সেটা অবশ্যই ওই কয়েক দিনের জন্য। তিনি বলেন, ঈদের তিন দিন পর থেকে আমাদের পরিবহনের ভাড়া স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, ঈদের বাড়তি ভাড়া এখন বহাল রাখার প্রশ্নই ওঠে না। কেউ নিয়ে থাকলে প্রমাণসাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। শহরতলীর বাসগুলোতে বাড়তি ভাড়া নেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়টি জানি না। ভুক্তভোগিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের পর পর নড়াইল থেকে আসার ভাড়া ৫০০ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। এখনও সেই ভাড়াই বহাল আছে। নীলফামারী থেকে ঢাকার ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ৭শ’ টাকা। ঢাকা থেকে নরসিংদী, গাজীপুর, দাউদকান্দি, মাওয়া, নারায়ণগঞ্জের ভাড়াও অতিরিক্ত ১০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত আদায় অব্যাহত রয়েছে। রাজধানী ঢাকায়ও এ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। গুলিস্তান থেকে শনিরআখড়ার ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ১৫ টাকা। অথচ এই ভাড়া কোনোভাবেই ১০ টাকা অধিক হতে পারে না।
ভুক্তভোগিদের মতে, নগর পরিবহনে সিটিং, ডাইরেক্ট, গেটলক ও স্পেশাল সার্ভিসের নামে নজিরবিহীন নৈরাজ্য চলছে। মোটরযান আইন, সরকার নির্ধারিত ভাড়া সবকিছু উপেক্ষা করে যথেচ্ছ হয়রানিতে লিপ্ত পরিবহন মালিক শ্রমিকরা। এতে করে যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে মালিকদের নির্ধারিত অতিরিক্ত ভাড়া। সেটাও কিলোমিটার হিসাবে নয়, কোম্পানীভেদে চাপিয়ে দেয়া অতিরিক্ত ভাড়া। নগরীর প্রায় প্রতিটি রুটেই অল্প দূরত্বের যাত্রীকে গুনতে হচ্ছে পুরো পথের ভাড়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অল্প দূরত্বের যাত্রীদের বাসেও তোলা হচ্ছে না। রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে মতিঝিলে অফিস করেন বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী আবদুর রহিম। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে অফিসে যেতে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। সকালে মিরপুর-পল্লবী থেকে যেসব বাস ছেড়ে আসে সেগুলোর প্রায় সবই ‘সিটিং’, ‘গেটলক’ হিসেবে দরজা বন্ধ করে মাঝপথের হাজার হাজার যাত্রীর সামনে দিয়ে গন্তব্যের দিকে চলে যায়। আমরা তখন অসহায়। তালতলা, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়ার যাত্রীরা এ সময় বাসে উঠতে পারেন না। এ জন্য তাদের সকাল ৯টায় অফিস ধরতে ৭টার আগেই রাস্তায় নামতে হয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকালে অফিস যাত্রার সময়ে প্রায় সব এলাকার চিত্র একই। আবার অনেক বাস আছে যেগুলোতে উঠলেই ‘ডাইরেক্ট’ হিসাবে ভাড়া দিতে হয়। অথচ বাসগুলো লোকালের মতো সবখানে দাঁড়ায়। মজার বিষয় হলো, গোটা রাজধানীতে লোকাল বলে কোনো বাস নেই। লোকাল বাসগুলো পিক আওয়ারে ডাইরেক্ট হয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, এসব অনিয়ম দূর করার দায়িত্ব যাদের, তাদের নাকের ডগায় এভাবে অনিয়ম ঘটেই চলেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএতে যাত্রীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। বিআরটিএ-এর একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা মাঝে মাঝে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার উদ্যোগ নিলেও পুলিশি সহযোগিতার অভাবে সেটা কার্যকর হয় না। ভুক্তভোগিদের অভিযোগ, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে বেপরোয়া। পুলিশও প্রায় সব ক্ষেত্রেই নির্বিকার থাকে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ঈদে সারাদেশের যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে। কোনো কোনো রুটে এখনও তা বহাল আছে। তিনি বলেন, আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু রুটের ভাড়া আদায়ের বিষয়টি মনিটরিং করা হয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, নগর পরিবহনের নৈরাজ্য রোধে যাত্রীদের অভিযোগ করার জায়গা নাই। ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটিতে যাত্রীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। এজন্যই মালিকপক্ষ স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ পাচ্ছে।



 

Show all comments
  • kasem ১১ জুলাই, ২০১৭, ১:৪২ এএম says : 0
    আমাদের প্রশাসন ও মন্ত্রী মহোদয় কী এর খোঁজ খবর রাখেন না?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চাঁদাবাজি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ