Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বয়লার বিষ্ফোরণে আর কত মানুষ মরবে

| প্রকাশের সময় : ১০ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মাকসুদ আলম মিলন : বাংলাদেশের পোশাক কারখানার দুর্ঘটনাগুলো এখনও পর্যন্ত কেবল মৃত শ্রমিকের সারিই বড় করছে। বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিয়ে কর্মরত সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৬ সালে বয়লার বিস্ফোরণের ৩৩টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪১ জন। আর ২০১৭ সালের প্রথমার্ধেই পাঁচটি ভয়াবহ বয়লার বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন শ্রমিক। সেই হিসাবে গত সাড়ে পাঁচ বছরে নিহতের সংখ্যা ৮৪। এ বছরের প্রথম মাসেই ২৬ জানুয়ারি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের পূবাইল এলাকায় গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার গলিয়ে কেমিক্যাল তৈরির কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় সাত শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হয় আরও সাত জন। জানুয়ারিতেই সিরাজগঞ্জের একটি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে তিন জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া, এপ্রিলে কুষ্টিয়াতে দুই জন ও একই মাসে দিনাজপুরের গোপালগঞ্জে মৃত্যু হয় ১৮ জন শ্রমিকের। সর্বশেষ, গত সোমবার (৩ জুলাই) গাজীপুরের কোনাবাড়ী নয়াপড়া এলাকায় মাল্টিফ্যাব লিমিটেড পোশাক কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৫০ জনেরও বেশি। তাদের মধ্যে কয়েকজন গুরুতর আহত হওয়ায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে বিলসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে সারাদেশে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে ৭টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন আট জন শ্রমিক, আহত হয়েছেন ৩৫ জন। এছাড়া, ২০১৩ সালে বয়লার বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন ছয় জন, আহত ২৫ জন; ২০১৪ সালে নিহত হয়েছেন পাঁচ জন, আহত ৮১ জন; ২০১৫ সালে নিহত হয়েছেন ছয় জন, আহত ৮৩ জন এবং ২০১৬ সালে সাতটি বয়লার বিস্ফোরণে নিহত শ্রমিকের সংখ্যা ১৬ জন, আহত ১৩ জন। সব মিলিয়ে এই পাঁচ বছরে ৩৩টি বয়লার বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন মোট ৪১ জন শ্রমিক, আহত হয়েছেন ২৩৭ জন। আহতদের অনেককেই পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের শিল্প কারখানাগুলোতে প্রধানত শক্তি উৎপাদনের জন্য বয়লার ব্যবহার করা হয়। এই প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় পানিকে বাষ্পে পরিণত করার জন্য। রাইস মিল, ডাইয়িং মিল, পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহৃত হয় বয়লার। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে কল-কারখানা পরিদর্শন অধিদফতর থেকে এসব বয়লারের অনুমোদন দেওয়া হয়। বয়লারের জন্য আলাদা পরিদর্শন অধিদফতরও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রায় তিন হাজার কারখানায় ব্যবহারের জন্য নিবন্ধিত বয়লারের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজার। এর বাইরেও অনিবন্ধিত বয়লারও রয়েছে। অবাক করার মতো তথ্য হলোÍ দেশের সাড়ে পাঁচ হাজার নিবন্ধিত বয়লারের জন্য পরিদর্শন অধিদফতরের জনবল মাত্র আট জন। এদের মধ্যে একজন প্রধান পরিদর্শক, দুই জন উপ-প্রধান পরিদর্শক এবং বাকি পাঁচ জন পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। শিল্প এলাকাগুলো ভাগ করে দায়িত্ব পালন করেন এই পাঁচ জন পরিদর্শক। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক ৫ ধরনের পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকেন এর মধ্যে শারীরিক, মানসিক, কর্মপরিবেশ, রাসায়নিক, জীবাণুঘটিত। একজন শ্রমিক জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটান তার কর্মস্থলে। কাজের প্রয়োজনে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ যন্ত্রপাতি চালাতে হয়। তবে কর্মক্ষেত্রে কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব থাকে মালিকের। এক্ষেত্রে শ্রমিককেও থাকতে হবে যথেষ্ট সতর্ক। নিরাপদ কর্মস্থল শ্রমিকের অধিকার।
প্রতিটি কারখানাতেই অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, নিরাপদ নির্গমনের পথ না থাকা, ফ্লোরে ফ্লোরে তালা, অলিতে গলিতে কারখানা, ত্রæটিপূর্ণ ও অপরিকল্পিত ভবন, শিশুশ্রম কর্তৃপক্ষের তদারিক না থাকা, বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন তৈরি, ডোবা-জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ, সংকীর্ণ সিঁড়ি, পানির পাম্প না থাকা, কারখানার স্টোওে বৈদ্যুতিক লাইন টানিয়ে এসব ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার নেপথ্য হিসেবে রয়েছে, অবহেলাজনিত দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না হওয়া, শ্রমিকের নামমাত্র ক্ষতিপূরণ, অতীতে ঘটে যাওয়া বড় দুর্ঘটনাগুলোর তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ ও শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও আইন অনুযায়ী কারখানা তৈরি না হওয়া।
গণমাধ্যমে এসব খবর প্রচার/স¤প্রচার করলেও দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। দুর্ঘটনা ঘটলেই মালিক বা মালিকপক্ষের লোকজন গা ঢাকা দেয়। কয়েকদিন যেতে না যেতে তারা আবার কারখানায় আসে। তদন্ত, ক্ষতিপূরণ প্রদান প্রভৃতি বিষয় চাপা পড়তে থাকে। গরিব শ্রমিকেরা কারখানায় কাজ করে দারিদ্র্য পহটাতে এসে নিজেরাই পরিণত হলো লাশের পহটাতে। মালিকদের উদাসীনতা, গাফিলতি ও অতি মুনাফালোভী অনিয়মের আচরণ, বেআইন পন্থায় কারখানা তৈরি আর কতকাল চলবে? এগুলো কি থামবে না?
লেখক : শিক্ষার্থী, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন