Inqilab Logo

সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ট্রাম্পকে টেক্কা দিতে পারেননি মোদি

| প্রকাশের সময় : ৭ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মেনাফন : করমর্দন ও ব্যতিক্রমধর্মী ঘনিষ্ঠতা প্রদর্শন করতে তিনবার প্রকাশ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আবেগভরা আলিঙ্গন করে নিজেকে বিরক্তিকর ভাবে তুলে ধরেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তা সত্তে¡ও সোমবার ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের সাথে বৈঠকে মোদির অর্জন সামান্যই, সাউথএশিয়ানমনিটর ডট কম-এ লিখেছেন পি কে বালাচন্দ্রন।
বিপরীতে ট্রাম্প ভারতের কাছে অস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে যা চেয়েছিলেন তাই পেয়েছেন এবং চীন ও আফগানিস্তানের ব্যাপারে তার ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যের ব্যাপারে মোদির অকুণ্ঠ অঙ্গীকার নিশ্চিত করেছেন। অর্থাৎ ট্রাম্পকে টেক্কা দিতে পারেননি মোদি, বরং ট্রাম্পই তাকে টেক্কা দিয়েছেন।
এদিকে অনুমানমতই ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ব্যাপারে (দক্ষিণ চীন সাগরসহ) মোদি-ট্রাম্প কৌশলগত সমঝোতা বেইজিংয়ের নেতাদের ভ্রুতে ভাঁজ ফেলেছে।
মোদির যেদিন ট্রাম্পের সাথে বৈঠকের কথা সেদিনই তিব্বত-সিকিম সীমান্তে ভারতীয় সৈন্যদের তিনটি বাংকার গুঁড়িয়ে দেয় চীনা সৈন্যরা। শুধু তাই নয়, তারা ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের নাথু লা পাস দিয়ে মানস সরোবর যাওয়া বন্ধ করে দেয়। হতাশ তীর্থযাত্রীদের ৫৪ কি মি পথ পাড়ি দিয়ে সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে ফিরে আসতে হয়। চীন রাস্তা নির্মাণে বাধা দিতে তার ভূখন্ডে ভারতীয় সৈন্যদের অনুপ্রবেশের অভিযোগ করেছে। ভারতীয় পক্ষ থেকে পাল্টা জবাবে বলা হয়েছে যে ভারতীয় ভূখন্ডে এ রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে।
এ বিষয়টির সমাধান হতে পারে যেমনটি অতীতে হয়েছে। এদিকে চীন ভারতকে ইঙ্গিত দিয়েছে যে আগ্রাসী পদক্ষেপের মাধ্যমে যে কোনো সময় সে দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ বাড়াতে পারে।
গুরুত্বপূর্র্ণ স্থানে আঘাত
সোমবারের পদক্ষেপের মাধ্যমে চীন দেখিয়েছে যে সে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভারতের স্বার্থে আঘাত হানতে পারে। যেমন সিকিম, ভুটান ও তিব্বতের মধ্যে ত্রিমুখী সংযোগস্থলে এবং শিলিগুড়ি করিডোরকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। শিলিগুড়ি করিডোর হচ্ছে চিকেন নেক বা মুরগির গলা যা পশ্চিমবঙ্গ ও আসামকে সংযুক্ত করেছে। এ দু’রাজ্যের সাথেই রয়েছে বাংলাদেশের বিরাট সীমান্ত।
উত্তরবঙ্গে স্বায়ত্তশাসিত গুর্খাল্যান্ডের জন্য গুর্খাদের সহিংস আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি এলাকা নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন।
তিব্বতের ব্যাপারে ভারতের সূঁচ ফোটানোর ঘটনায় চীন তার ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে নয়াদিল্লী সাবেক তিব্বতী ধর্মগুরু দালাইলামাকে ভারতে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালানোর অনুমতি দিয়েছে। নয়াদিল্লী ভারতে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড ভার্মাকে অরুণাচল সফরে যেতে দেয়। তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত অরুণাচলকে চীন তিব্বতের অংশ বলে দাবি করে।
শিলিগুড়ি করিডোরের প্রতি হুমকি এবং ঐতিহ্যবাহী সিকিম-তিব্বত বাণিজ্য বৃদ্ধিতে চীনের খোলাখুলি আগ্রহ নয়াদিল্লীর জন্য বাড়তি চিন্তা হয়ে উঠেছে।
ভারতের প্রকৃত অর্জন সামান্যই
ওয়াশিংটন আলোচনায় ভারতের জন্য স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে নিরেট কোনো অর্জন নেই, কিন্তু ট্রাম্প কিছু অর্জন করেছেন।
প্রতিরক্ষা ক্রয়ে ‘গো আমেরিকা’ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ট্রাম্প ভারতের বিপুল প্রশংসা করেন এবং আরো মার্কিন অস্ত্র কেনার জন্য মোদির প্রতি আহবান জানান। ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরঞ্জাম কেনার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অস্ত্র বিক্রি আমাদের মন ভালো করে দেয়। আমরা যে সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করি , আমাদের মত সামরিক সরঞ্জাম আর কেউ তৈরি করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে কেউ আমাদের কাছাকাছি নেই। আমরা আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
২০০৮ সাল থেকে ভারতে বিক্রি করা মার্কিন অস্ত্রের মূল্য ১৫ বিলিয়ন ডর্লা। যেহেতু ভারতের আছে অস্ত্রের বিপুল ক্ষুধা তাই যুক্তরাষ্ট্র তার কাছে আরো অস্ত্র বিক্রি করতে চায়। বিশে^ অস্ত্র ক্রয়ে ভারত সউদি আরবের পর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ভারত ৩৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয় করেছে। ২০১৪ সালে ভারতে একক অস্ত্র বিক্রেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে ছাড়িয়ে যায়। কূটনীতিকদের মতে, মার্কিন বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং একাই ভারতকে ১০টি সি-১৭ গেøাবমাস্টার-৩ কৌশলগত বিমানবাহী বিমান (৪.১ বিলিয়ন ডলার), ৭টি পি-৮১ মেরিটাইম টহল বিমান (২.১ বিলিয়ন ডলার), ২২টি এএইচ-৬৪ই অ্যাপাচি ও ১৫টি সিএইচ-৪৭এফ চিনুক হেলিকপ্টার (উভয় ধরনের হেলিকপ্টারের সম্মিলিত মূল্য ২.৫ বিলিয়ন) সরবরাহের আদেশ পেয়েছে।
হোয়াইট হাউস ভারতকে ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ২২টি অস্ত্রবিহীন গার্ডিয়ান ড্রোন বিক্রি অনুমোদন করেছে। তবে তা কংগ্রেসের অনুমোদন পায়নি। কারণ, ঘনিষ্ঠ মিত্রদেরই শুধু অত্যাধুনিক এ ড্রোন দেয়া হয়।
ভারত মহাসাগরে ক্রমবর্ধমান চীনা তৎপরতার কারণে দূর পাল্লার সমুদ্র নজরদারির জন্য ভারতের এ গার্ডিয়ান ড্রোন প্রয়োজন।
বৈশি^ক সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা
সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সহযোগিতার ব্যাপারে বলিষ্ঠ সমঝোতা রয়েছে যা ভারতের জন্য মঙ্গলজনক। ট্রাম্প বলেন, আমরা উগ্র ইসলামী সন্ত্রাস ধ্বংস করব। আমাদের দু’ দেশই সন্ত্রাসের অনিষ্ট দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা উভয়েই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো ও যে মতাদর্শ দ্বারা তারা পরিচালিত তা ধ¦ংস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
মোদি বলেন, আমরা সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা ও মৌলবাদ নিয়ে আলোচনা করেছি। এগুলো আজ বড় চ্যালেঞ্জ বিশ^ যার সম্মুখীন। আমরা এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়েছি। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়, অভয়াশ্রম ও আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া আমাদের সহযোগিতার অংশ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও আমার উভয়ের কাছেই সন্ত্রাসবাদের মত বৈশি^ক চ্যালেঞ্জ থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করা উচ্চ অগ্রাধিকার।
মোদির সাথে ট্রাম্পের সাক্ষাতের আগের দিন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর পাকিস্তানের হিজবুল মুজাহিদিনের নেতা সৈয়দ সালাহউদ্দিনকে বিশ^ সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করে। এ ব্যক্তি কাশ্মীরকে ‘ভারতীয় সৈন্যদের গোরস্তানে’ পরিণত করার হুমকি দিয়েছেন। তবে নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ ড. মনোজ যোশি এ ঘোষণাকে মূল্যহীন আখ্যায়িত করে বলেন, সালাহউদ্দিন এখন অতীত এবং পাকিস্তানের মদদকৃত সন্ত্রাসবাদে তিনি আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন।
হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ট্রাম্প ও মোদি পাকিস্তানকে তার ভূখন্ড অন্যদেশে সন্ত্রাসী হামলায় ব্যবহৃত হতে না দেয়ার আহবান জানান। চীনের নাম উল্লেখ না করে বিবৃতিতে বলা হয় যে সকল দেশেরই উচিত আঞ্চলিক ও সমুদ্র সীমা নিয়ে বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী নিষ্পন্ন করা।
আঞ্চলিক কৌশলগত সহযোগিতা
ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগর সমুদ্র বিরোধে ভারত সরাসরি জড়িত না হওয়া সত্তে¡ও এবং তা মূলত আমেরিকার সমস্যা হলেও মোদি বলেন, এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ভারতের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, আমাদের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনা আমাদের অংশীদারিত্বের মাত্রা নির্ধারণ অব্যাহত থাকবে। আমরা এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করে যাব।
এক যুক্ত বিবৃতিতে চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবর) বৈশি^ক অবকাঠামো নির্মাণ পরিকল্পনার প্রতি অননুমোদন মূলক পরোক্ষ ইঙ্গিত করা হয়, তবে কোনো প্রকল্পের বা দেশের নাম উল্লেখ করা হয়নি। বিবৃতিতে বলা হয়, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র অ-স্বচ্ছ ও অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পের বিরুদ্ধে, যার অর্থ ওবরের মত চীনা অর্থায়নকৃত প্রকল্পসমূহ।
প্রধান অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো অমীমাংসিত
বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যা অমীমাংসিত রয়ে গেছে। ভারত ভারতীয় পেশাজীবীদের জন্য দেয়া ওয়ার্ক ভিসার ক্ষেত্রে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংকোচন চায় না, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার অনুকূল কর্মী ভিসা ব্যবস্থার ব্যাপারে আগ্রহী। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে মোদি এ বিষয় নিয়ে চাপাচাপি করেননি যদিও এর ফলে প্রায় ৭০ হাজার ভারতীয় পেশাজীবী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে ভারতের সাথে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসে আমেরিকার পণ্য সেবার জন্য ভারতীয় বাজার উন্মুক্ত চায়। যুক্তরাষ্ট্র মার্কিন বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ভারতের ব্যবসা পরিবেশের ব্যাপক পরিবর্তন চায়। বর্তমানে ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ আমেরিকার বৈশি^ক এফডিআই-র ২ শতাংশ মাত্র।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে মোদির হাত বাঁধা। বিদেশীদের অনুকূলে ভারতের ব্যবসা পরিবেশের পরিবর্তন করতে গেলে বিরাট বাধা আসবে।
সর্বোপরি যা ঘটতে পারে তা হলঃ ভারত পাকিস্তান ও চীনের ক্রমবর্ধমান হুমকির মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরো অস্ত্র কিনবে এবং পাকিস্তান, চীন এমনকি আফগানিস্তানের তালিবানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সত্তে¡ও দক্ষিণ চীন সাগর ও আফগানিস্তানে মার্কিন কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করবে।
ভারতীয়দের জন্য এইচ-১বি ওয়ার্ক ভিসা বিষয়ে অনুকূল মার্কিন সিদ্ধান্ত অথবা অনুকূল ফলাফল আসার সামান্য সম্ভাবনা আছে, আর তা মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতিকে সফল করতে অধিক মার্কিন বিনিয়োগ পেতে ভারতের উদ্যোগের প্রেক্ষিতে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ট্রাম্প


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ