পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : আমরা কবে মানুষ হবো? হিংসা বিদ্বেষ ভুলে গুণীজনের সন্মান করবো? অনেক বরেণ্য গুণীজনের জন্ম-মৃত্যু দিবস নীরবে আসে নীরবে চলে যায়। আবার অনেক অপরিচিত ব্যক্তিদের নিয়ে হৈ চৈ করা হয়। সাংস্কৃতি অঙ্গনের দলবাজীর কারণে দল নিরপেক্ষ অনেক গুণীজনকে স্মরণ করা ভুলতে বসেছি। বিখ্যাত অনেক গুণীজনকে নতুন প্রজন্ম চেনেই না। দলদাস মানসিকতার কারণে মিডিয়াগুলোও ভূমিকা প্রায় অভিন্ন? কেন এতো হিংসা বিদ্বেষ? অসুস্থতায় কেউ ধুকে ধুকে মরলেও কারো সহায়তা পায় না; আবার কেউ প্রচুর অর্থ পেয়ে যায়; কেন এই বৈপরীত্য? সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করা দলবাজী ও হিংসার কুৎসিত থাবা থেকে আমরা কি বের হয়ে আসতে পারবো না?
প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা শব্দগুলোর ব্যবহার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মারশাফি বিন মুর্তজা। চমৎকার পরামর্শ। টি-২০ বাংলাদেশ বনাম ভারতের ফাইনাল খেলার আগে সংবাদ সম্মেলন প্রশ্নকর্তা সাংবাদিক ক্রিকেটারের এ পরামর্শে লজ্জা পেয়েছেন কিনা জানা যায়নি। কিন্তু ক্রিকেটার মাশরাফি এই ‘বোধদয়ে’ শেখার আছে অনেক কিছু। হিংসা-বিদ্বেষ, আমার-তোমার, পক্ষ-বিপক্ষ, ওই পক্ষ-এই পক্ষ, কটাক্ষ, বিদ্রুপ, তোষামোদ, অশ্লীলতা, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ শব্দগুলো যেন আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। এই নেতিবাচক শব্দগুলোর ব্যবহার এতো বেশি হচ্ছে যে দেশের ক্ষণজন্মা, বিখ্যাত, আলোচিত, অনুসরণীয়, অনুকরণীয় মানুষগুলোকেও মূল্যায়ন করি দলীয় গ-িতে। বোধ-বুদ্ধি যেন লোভ পেয়ে গেছে। আমরা দলবাজীর কারণে পিয়াস করিমের লাশ শহীদ মিনারে নেয়া ঠেকিয়ে দেই; মুক্তিযোদ্ধা আল মাহমুদকে জামায়াতি কবির ‘তকমা’ দেই। অথচ পক্ষ্যে থাকায় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের মালিকানাধীন পত্রিকার সম্পাদকের চাকরি করা কবি শামসুর রাহমানকে ‘স্বাধীনতার কবি’ বলি। রাজনৈতিক দলের কাছে ‘বিবেক বন্ধক’ রাখায় স্বাধীন ভাবে চিন্তা ভাবনা করে প্রতিভাবান মানুষগুলোতে সম্মান শ্রোদ্ধা পর্যন্ত করতে যেন ভুলে গেছি। মানুষ মাত্রই মৃত্যুবরণ অবধারিত। অথচ গুণীজনের মৃত্যুতেও শ্রদ্ধা-সম্মানে দলবাজীর কপটতা করি।
প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ শব্দগুলো যেন জীবনের পরতে পরতে মিশে গেছে। তাই ক্রিকেট খেলায়ও প্রতিশোধ-প্রতিহিংসা, শত্রু-মিত্র শব্দগুলো উচ্চারণ করি। দলবাজীর কারণে অখ্যাত, অপরিচিত শিল্পী অভিনেতা, সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্বের জন্মদিন মৃত্যুদিন পালন নিয়ে হৈ চৈ করি এবং বিখ্যাত ব্যাক্তিদের অবলিলায় ভুলে যাই। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা ক্ষণজন্মা ব্যাক্তিত্ব প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, সৈয়দ আলী আহসান, আরিফুর রহমানের মতো ব্যাক্তিত্বদের জন্ম-মৃত্যু দিবস নীরবে আসে নীরবে চলে যায় কেন? অথচ ---।
রাজধানীর একটি কলেজে ২৭/২৮ বছর ধরে অধ্যাপনা করছেন এমন এক বন্ধুর হঠাৎ দেখা। সাক্ষাতের প্রারাম্ভে বললেন, শুধু রাজনীতি নিয়ে লেখেন; শিল্প সাহিত্যের অভ্যন্তরের কাহিনী লিখছেন না কেন? দলবাজীর কারণে সাংস্কৃতিক জগতের বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব রবিন ঘোষের ইন্তেকালের পর মিডিয়াগুলো নীরব। সাংস্কৃতির ব্যাক্তিত্বরা তাকে নিয়ে অনুষ্ঠানাদি দূরের কথা দেখতে যায়নি এবং স্মরণ পর্যন্ত করেনি। দেশের সাংস্কৃতি অঙ্গণের ব্যাক্তি ও মিডিয়াগুলো কি গণমাধ্যমের বদলে ‘দলমাধ্যম’ হয়ে গেল? ওই অধ্যাপক আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে নিয়মিত বিশ্লেষণধর্মী লেখা লেখেন ঢাকা থেকে প্রকাশিত অধিকাংশ পত্রিকায়। ‘আপনিওতো লিখতে পারেন?’ প্রশ্ন শুনেই বললেন, আপনার লেখার গভীরতা ---। ইত্যাদি ইত্যাদি।
সোমবার টিভি দেখে মনে পড়ে গেল ওই অধ্যাপকের কথা। ধানম-িতে দিনে দুপুরে গাছ ভেঙ্গে পড়ায় চিত্রশিল্পী ও সিনেমা পরিচালক খালিদ মাহমুদ মিঠু ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মিঠু একাধিক তথ্যচিত্র, দুটি চলচ্চিত্র এবং কয়েকটি নাটক নির্মাণ করেছেন। ‘গহীনে শব্দ’ সিনেমা নির্মাণ করে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তার অকাল মৃত্যুতে সব টিভিতে বিশেষ ভাবে খবর প্রচার করা হয়। চ্যানেল আই, এনটিভিসহ কিছু মিডিয়ার আর্কাইভ থেকে নেয়া সাক্ষাৎকার প্রচার করে; স্মরণ অনুষ্ঠান করে। তার স্ত্রী চিত্রশিল্পী কনক চাপা চাকমা, ছেলে-মেয়ের সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়। গান, চিত্রকলা, নাটক-সিনেমা সাংস্কৃতির অঙ্গনের বিখ্যাত ব্যাক্তিরা ছুটে যান এবং তার কর্মময় জীবনের মূল্যায়ন করেন। শিল্প-সাহিত্য ও অন্যান্য অঙ্গনে দেশের জন্য কাজ করে যারা ইন্তেকাল করেন সে গুণীজনদের এই সম্মানটুকুই প্রাপ্য। মিঠুর প্রতি মিডিয়া, সাংস্কৃতি ব্যাক্তিত্ব ও নায়ক-নায়িকা-সংগীত শিল্পীর সম্মান প্রদর্শন ন্যায় সংগত ও গৌরবের। রাজনীতি নিয়ে ধ্যান-জ্ঞান হওয়ায় দেশে খালিদ মাহমুদ মিঠু নামে যে সিনেমার পরিচালক আছেন জানতাম না। এ না জানা আমার ব্যর্থতা-অযোগ্যতা ও লজ্জার। গাছ দুর্ঘটনায় মিঠুর মৃত্যুতে যারা তার প্রতি শ্রোদ্ধা প্রদর্শন ও স্মরণ করছেন, যে সব মিডিয়া ব্যপক ভাবে তাকে নিয়ে ‘স্মরণ প্রচারণা’ চালাচ্ছে তাদের ধন্যবাদ। কিন্তু ওই অধ্যাপক বন্ধুর প্রশ্ন হলো এ শ্রদ্ধা দলগত না শিল্প সাহিত্যের বোদ্ধা ব্যাক্তির কারণে? গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বরেণ্য সংগীত পরিচালক রবীণ ঘোষ ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুর পরও তাকে চরম অবহেলা করা হয়। অথচ কেজি মুস্তফার লেখা এবং তালাত মাহমুদের কন্ঠে প্রখ্যাত ওই সংগীত শিল্পীর সুরারোপিত শবনম ও রাজ্জাক অভিনীত নাচের পুতুল ছবির ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ গান রেডিও-টিভিতে বেঁজে ওঠায় নিজের অজান্তেই ঠোঁট মেলাননি দেশে এমন মানুষ পাওয়া ভার। তার সুরারোপিত কালজয়ী হয়ে ওঠা ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো/ চাঁদ বুঝি তা জানে’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা/ রুপের যাদু এনেছি’, ‘পিচ ঢালা ওই পথটারে ভালোবেসেছি/ তার সাথে এই মনটাতে বেঁধে নিয়েছি’সহ শতাধিক গান এখনো শ্রোতা কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। এ গানের ধ্বনি কানে এলে এখনো থমকে দাঁড়ায় মানুষ। খৃস্টান ধর্মাবলম্বী এবং নায়িকা শবনমের স্বামী রবিন ঘোষের জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। বাবার চাকরিসূত্রে তার জন্ম হয় বাগদাদে ১৯৩৯ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবারের সঙ্গে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে তিনি ঢাকার রেডিওতে চাকরি নেন। ১৯৬১ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘রাজধানীর বুকে’ ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেন হৈ চৈ ফেলে দেন। তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে ধ্বনিত হয় তার সুরারোপিত গান। অতঃপর একের পর এক ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেন। অসংখ্য উর্দু-বাংলা গানে সুর দেন। ‘তালাশ’, ‘চকোরি’, ‘হারানো দিন, ‘পিচ ঢালা পথ’, ‘নতুন সুর’, ‘নাচের পুতুল’ ইত্যাদি দর্শকপ্রিয় সিনেমার গানে সুর দেন। তার সুরারোপিত গান গেয়ে তালাত মাহমুদ, ফেরদৌসী রহমান, মাহমুদুন নবী, আবদুল জব্বারসহ জনপ্রিয় শিল্পীরা শ্রোতার হৃদয় জয় করেন। তিনি তালাত, চাহাত, আয়না, আম্বার, দুরিয়া, তুম মেরে হো’সহ বিভিন্ন জনপ্রিয় উর্দু ছবির সংগীত পরিচালনা করেন। বিস্ময়কর সংগীত প্রতিভার অধিকারী এই গুণী মানুষটির যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়ার প্রয়োজনবোধ করিনি। দলবাজী না করলে কি গুণীজনের মূল্যায়ন হবে না? তিনি নাকি বাংলার চেয়ে উর্দু গানে বেশি সুরারোপ করেছেন। এটা কোনো অভিযোগ? আমরাতো এক সময় সবাই পাকিস্তানি ছিলাম; তার আগে ব্রিটিশের অধীনে। তাহলে? বাংলাদেশের আর কোনো পরিচালক উর্দুতে ছবি করেননি? রবীণ ঘোষের মৃত্যুর পর সাংস্কৃতির ব্যাক্তিত্বদের তার বাসায় ছুঁটে যেতে দেখা যায়নি। দু’একটি টিভি দায়সারা ভাবে খবর প্রচার করলেও টিভি মিডিয়াগুলোও তেমন অনুষ্ঠানাদি প্রচার করেনি। শুধু তাই নয়, গত বছর প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী রুনা লায়লাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘স্বাধীনতা পদক’ দেয়া হয়েছে। তাকে পদক দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কিছু বুদ্ধিজীবী। ওই বুদ্ধিজীবীদের ভাষায় রুনা লায়লা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ছিলেন। তার আত্মীয় পাকিস্তানের প্রভাবশালী নেতা জাভেদ কায়সার। তিনি উদর্ুু ভাষায় ‘দামা দাম মাসকালেন্দার’ গান গেয়েছেন। উর্দু ভাষায় গান করায় তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া নাকি অন্যায়। রবিণ ঘোষের মৃত্যুর পর খোঁজও নেননি এবং রুনা লায়লার স্বাধীনতা পুরস্কার নেয়া নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলেন তারাই রাজনৈতিক কারণে জিয়াউর রহমানকে বলেন পাকিস্তানের এজেন্ট। মুক্তিযু্েদ্ধর কাদেরিয়াবাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী, মুক্তিযুদ্ধে দ্বিতীয় সর্বাধিনায়ক এ কে খন্দকার মুক্তিযোদ্ধা কিনা তা নিয়ে সন্দেহের তীর ছোঁড়েন। নিজেদের মধ্যে বিরোধ করতে করতে যে দেশের শিল্প সাংস্কৃতি অপসাংস্কৃতির আগ্রাসনে হারিয়ে যেতে বসেছে; হিন্দীর কালচার দেশের শিশুদের মধ্যে থাবা বসাচ্ছে সে খেয়াল কি আছে? দলবাজীর উর্ধ্বে উঠে প্রকৃত গুণীজনদের সম্মান করবো কখন? ‘তোমাকে লেগেছে এতো যে ভাল’ গান হৃদয় থেকে বের হলেও তার শ্রষ্টাকে রাজনৈতিক কারণে চাপা দেই; অথচ যেনতেনকে নিয়ে মেতে উঠি? প্রশ্ন হলো আমরা কবে মানুষ হবো?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।