স্বতন্ত্র উৎসব ঈদ
এল ঈদুল ফিতর, এল ঈদ ঈদ ঈদসারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল নাক’ নিদ। হ্যাঁ, সুদীর্ঘ
অনুবাদ : হোসেন মাহমুদ
নাবিলা এক তরুণকে আসতে দেখল। শিস দিচ্ছে; শিস দেয়া থামিয়ে আবার গুনগুন করে গানও গাইছে। একটু পরই তরুণ তার একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। বাধ্য হয়ে থেমে পড়ে নাবিলা। তরুণ অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তাকে জিজ্ঞেস করল-
ঃ আচ্ছা, পপি স্ট্রিটটা কোথায় বলতে পারেন?
মুহূর্তের জন্য অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিল নাবিলা। চোখের পলকে তার গলার হারটা ছিনিয়ে নেয় তরুণ। দৌড় দেয়, তার পায়ে তখন বিশে^র সেরা দৌড়বিদের গতি।
নাবিলা নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে হাঁটছিল। তরুণটাকে দেখে তার কোনো সন্দেহ হয়নি বা সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। এক নজর দেখে তাকে মোটেই চোর-ছিনতাইকারী, এমনকি অভাবী বলেও মনে হয়নি। তরুণের একহাতে যখন তার গলায় সাপের মত ছোবল দিয়ে হারটা ছিনিয়ে নিল তখন সে ভীষণভাবে কেঁপে উঠেছিল। এক মুহূর্তের জন্য হলেও নিশ্চল হয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু পর মুহূর্তেই নিজের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে ফিরে আসে, পলায়নপর হার ছিনতাইকারীর পিছনে ছুটতে ছুটতে তারে দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে গলার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করতে থাকে- ধরুন, ঐ লোকটিকে ধরুন, সে আমার হার ছিনতাই করে পালাচ্ছে।
নাবিলা ছিনতাইকারীর পিছনে যতই দৌড়াচ্ছিল ততই তার রাগ বাড়ছিল। সে এক সেকেন্ডের জন্যও তার চিৎকার থামায়নি। তার চিৎকার শুনে রাস্তার দু’পাশের সব বাড়ি, দোকান, কারখানা থেকে লোকজন বেরিয়ে আসে। কিন্তু সবাই দাঁড়িয়ে ব্যাপার দেখতে থাকে, একটি মানুষও এগিয়ে আসে না।
তরুণ বোধ হয় ভাবতে পারেনি যে নাবিলা এমন নাছোড়বান্দা মেয়ে হবে। নাবিলা একটু পরই তাকে ধরে ফেলে। ছিনতাইকারী তরুণের দু’চোখে তখন ভয় আর অবিশ্বাস বাসা বেঁধেছে। একটি মেয়ে কিনা তাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলল! সে স্বপ্নেও ভাবেনি এ রকম কিছু ঘটতে পারে। সে নাবিলার কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে শরীর মোচড়াতে থাকে। মাথার উপর কড়া রোদে শরীর থেকে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে। তরুণের ঘামে ভেজা মুখ চকচক করছে সূর্যের আলোয়। তার মুঠো করা আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে হারের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছে। হারটিতে একটি সোনার দোলক ছিল। তার এক পিঠে ছিল টাওয়ার অব বাবেল আরেক পিঠে ডোম অব রক-এর খোদাই করা চিত্র। সারাজীবন ধরে সে বারবার তার অলংকার হারিয়েছে, কিন্ত সে জন্য দুঃখ হয়নি বা দামি জিনিস হারিয়েছে বলে আফসোসও করেনি। কিন্তু এবার তার মনে হল, তার শরীর থেকে তার আত্মাকে কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে।
দাঁতে দাঁত চেপে সে ছিনতাইকারীকে ধরে রাখল। দু’হাতে সে ধরে আছে তাকে। ছিনতাইকারী তার দিকে ঘুরল, শরীরে মোচড় দিচ্ছে সে। কিন্তু তার একটি পা আরেকটি পা’র পিছনে পড়ে যাওয়ার ফলে সে শক্তি পাচ্ছিল না। নাবিলা এক হাতে তার শার্টের কলার খামচে ধরে। ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করেও ছিনতাইকারী ব্যর্থ হয়।
তাদের চারপাশে মানুষের ভিড় জমে। মনে হচ্ছিল চাকভাঙা মৌমাছির দল তাদের ঘিরে ধরেছে। তবে তারা দাঁড়িয়েই রইল, তার সাহায্যে কেউ এগিয়ে এলো না। তাদের চেহারা বলছিল তারা মজা দেখছে। নাবিলা তাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল-
ঃ এ একটা চোর, ছিনতাইকারী। ও আমার নেকলেস ছিনতাই করেছে।
ছিনতাইকারী হঠাৎ তার ট্রাউজারের গোপন পকেট থেকে একটি ছুরি বের করে। সে নাবিলার মুখের সামনে ছুরিটি নাচাতে থাকে যেন তাকে আঘাত করবে। নাবিলা সতর্ক হয়ে ওঠে। ছিনতাইকারী যদি তার নাগাল পায় তাহলে বিপদ হয়ে যাবে। এ সময় জনতার মধ্য থেকে কেউ একজন বলে ওঠে-
ঃ এই মেয়ে! সরে এসো, তার হাতে ছুরি আছে।
আরেকজন বলে-
ঃ গাধা নাকি! ও তোমার গলা ফাঁক করে দেবে।
অন্য একজন বলে-
ঃ তুমি তো মেয়ে মানুষ। সাহস দেখাতে যেও না।
আরেকটি গলা শোনা যায়-
ঃ জেদি মহিলা।
নাবিলার মুখের রেখা আরো কঠিন হয়ে ওঠে। তার মনে হয়, এক শক্তিশালী দানবের সম্মুখীন হয়েছে সে অথচ নিজে এক শান্ত স্বভাবের তরুণী ছাড়া কিছু নয়। সে নিজের মধ্যে সাহস অনুভব করল। একবারও ভয় তার মধ্যে বাসা বাঁধল না, সে পিছিয়েও গেল না। এ সময় একটি ওয়ার্কশপ থেকে এক তরুণ এগিয়ে আসে তাকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু নাবিলার কাছে পৌঁছনোর আগেই লোকজন ধরে ফেলে তাকে। কেউ একজন বলে-
ঃ আরে পাগল নাকি! তুমি কি মরতে চাও? তরুণীটির ব্যাপারে নাক গলিও না। তার একগুঁয়েমির জন্য সেই দায়ী, আর কেউ নয়।
সবার বাধার কারণে এই তরুণটি এগোতে পারে না। কিন্তু সে জন্য নয়, উপস্থিত লোকদের এ ধরনের মন্তব্য, ভীতি, আচরণ দেখে নাবিলা ক্ষুব্ধ হয়, আহত বোধ করে। সে তার চারদিকে পাখির মত ঘিরে থাকা মানুষগুলোকে দেখে। এরা সবাই ভীতু। এ সময় একজন ভয় পাওয়া গলায় বলে -
ঃ ছিনতাইকারীকে কেউ বাধা দিতে যেও না, তার হাতে ছুরি আছে।
লোকগুলোর কাপুরুষতা নাবিলার জেদ আরো বাড়িয়ে দেয়। তার ভিতরে এক অন্ধ সাহস বিস্ফোরিত হয়। সে তার একটি হাতের আঙ্গুল একত্রিত করে তার সামনে ছিনতাইকারীর নাচাতে থাকা ছুরির বিরুদ্ধে একটি অস্ত্রের মত হাতটি প্রসারিত করে। হাতটিকে চারপাশে ঘোরাতে থাকে সে। তার মুখে আঘাত করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। সে সাথে সে বিড়বিড় করে শপথ বাক্য উচ্চারণ করে চলে, পৃথিবীর সকল অস্ত্র আনলেও আমি আমার হার দেব না।
এ সময় ছিনতাইকারী তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়, তার চোখ জ¦লজ¦ল করছে, ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে এক টুকরো শয়তানি হাসি। নাবিলা তার হলুদ চোখের তারায় নিজের উত্তেজিত মুখের প্রতিফলন দেখতে পায়। এবার সে দাঁত-মুখ খিঁচে নাবিলার দিকে তেড়ে আসে-
ঃ গোঁয়ার মেয়ে কোথাকার! দাঁড়া দেখাচ্ছি তোকে।
নাবিলা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছিনতাইকারী তার মুখে ও কপালের পাশে কয়েকটি ঘুঁষি লাগিয়ে দেয়। হতভম্ব নাবিলা সে ঘুঁষি ঠেকাতে পারে না। ঘুঁষির কারণে ভারসাম্য হারিয়ে সে মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু ছিনতাইকারী তাকে ঘুঁষি মেরেই চলে। নাবিলা দুর্বল হয়ে পড়ে, ছিনতাইকারীর জামার কলার আঁকড়ে থাকা তার আঙ্গুলগুলো শিথিল হয়ে আসে। শেষপর্যন্ত ছিনতাইকারী তার কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সফল হয়। শয়তানটা এবার সবার সামনে শরীরের সব শক্তি দিয়ে লাথি মারে নাবিলাকে। এ দৃশ্য দেখে সমবেত লোকগুলো ভীত হয়ে ওঠে, তাদের কাপুরুষতা তাদেরকে স্থবির করে রাখে। ছিনতাইকারী নাবিলার দুর্বল হয়ে পড়া ও লোকগুলোর নির্লিপ্ততা দেখে আরো সাহসী হয়ে ওঠে। সে নাবিলাকে আবার লাথি মারে, তারপর সেখান থেকে দৌড় দেয়।
ছিনতাইকারী পালিয়ে যাচ্ছে। নাবিলা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ও তাকে পিছনে দৌড়াতে থাকে। বাতাসে তার চুল উড়ছে, নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। তার জামা-কাপড়ে ধুলো লেগে আছে।
শরীরের সব শক্তি দিয়ে নাবিলা ছিনতাইকারীর পিছনে দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে- ও আমার হার নিয়ে পালাচ্ছে! এদিকে ছিনতাইকারী তার সহযোগির কাছে পৌঁছে গেছে। তার দুষ্কর্মের সহযোগী রাস্তার কোণে মোটরবাইক নিয়ে তার অপেক্ষা করছিল। ছিনতাইকারী লাফ দিয়ে চালকের পিছনে বসে পড়তেই চালক লোকজনকে পাশ কাটিয়ে চলতে শুরু করে। সে মুহূর্তে নাবিলা উপলব্ধি করে যে সবকিছুই ছিল পরিকল্পিত।
ক্ষোভে, হতাশায় রাস্তার উপর হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে নাবিলা। তার দেহ ও মনের সব শক্তি নিঃশেষিত। তার শরীরের উপর দিয়ে যেন লজ্জা ও ব্যর্থতার প্রচন্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। এই রাস্তাতেই তার বাড়ি। সবাই তাকে চেনে ও জানে। ছিনতাইকারী তার হার ছিনিয়ে নেয়ার আঘাতের চেয়েও এ মুহূর্তে তার জন্য বড় আঘাত ছিল তার প্রতিবেশীদের কাপুরুষতা। এ দুঃখ তাকে এমনভাবে গ্রাস করে যে তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। সে মুহূর্তে তার মনে পড়ে যে কায়রোর একটি রাস্তায় একটি তরুণীকে কয়েকজন যুবক মিলে ধর্ষণ করে। কিন্তু কোনো পথচারী মেয়েটির সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। তারা ছিল হৃদয়হীন মানুষ। তাদের কাছে মেয়েটির সম্ভ্রম হানির ব্যাপারটি কোনো বিনোদন বা সিনেমার উত্তেজনাপূর্ণ দৃশ্যের মতই ছিল।
তার মন অতীতে চলে যায়। মনে পড়ে একটি ঘটনার কথা। একটি উটনিকে আঘাত করাকে কেন্দ্র করে দু’টি আরব গোত্রের মধ্যে মরণপণ লড়াই শুরু হয় যা চল্লিশ বছর ধরে চলেছিল। নাবিলা মানুষের কাছে তার মুখ দেখাতে লজ্জা পাচ্ছিল। এ সময় তার বুকের গভীর থেকে কষ্ট ও যন্ত্রণাদীর্ণ এক দীর্ঘশ^াস উঠে আসে। কঠিন ও ঠান্ডা। যেন অনেক বছর ধরে তা সেখানে জমেছিল। এ সময় মসজিদের মাইকে মুয়াজ্জিনের গলায় জোহরের নামাজের আযান ধ্বনিত হয়। তার বুকের ভেতরের কষ্টগুলোর সাথে আযানের সুর মিশে যেতে থাকে। আশ্চর্য, একটু একটু করে তার সব কষ্ট যেন কোথায় মিলিয়ে যায়।
নাবিলার চারপাশে লোকের ভিড় জমে ওঠে। তবে কেউই তার চোখের দিকে তাকায় না। কারো কারো গলায় সান্ত¡নার বাণী শোনা যায়-
ঃ যা ঘটে গেল তার জন্য আমরা দুঃখিত।
ঃ তোমার নিজেকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়া উচিত হয়নি।
ঃ তুমি এভাবে গোঁয়ারের মত নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে চাইছিলে কেন?
ঃ বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছ, এখন ভালো কিছু করার চেষ্টা কর।
ঃ তোমার অলংকার এভাবে প্রদর্শন না করে তা গোপন রাখবে।
নাবিলা তার আহত গর্ব নিয়ে লোকগুলোর মুখের দিকে তাকায়। সে অনুভব করে, তার ও এ সব লোকের মাঝে একটি নীরব দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। সে উঠে দাঁড়ায়। জামা-কাপড়ের ধুলো ঝাড়ে। এ সময় একটি শান্ত কিন্তু ঘৃণাজড়ানো কন্ঠ শোনা যায়-
ঃ লজ্জা, কি লজ্জা! তুমি নিজেকে একট হাস্যকর প্রাণিতে পরিণত করেছ। হতভাগী নারী কোথাকার!
কে বলল? তাকে ঘিরে থাকা লোকজনের মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে লোকটিকে বের করার চেষ্টা করে নাবিলা। পারে না। এবার সে চিৎকার করে বলে-
ঃ ভীরু! মেরুদন্ডহীন কাপুরুষ সব! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে খুব ভালোলাগে, তাই না? আপনাদের লজ্জা করে না নিজেদের পুরুষ মানুষ ভাবতে?
তার কথাগুলো চাবুকের কাঁটার মত সমবেত লোকদের গায়ে আঘাত করে। কারো কারো কাছে নাবিলার কথাগুলো আগুনের হলকার মত মনে হয় যেন শরীর পুড়িয়ে দিচ্ছে।
নাবিলা রাস্তার শেষে তাদের বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। তার মনে হয় এতক্ষণ সে দুঃস্বপ্ন দেখছিল। আগুন ঝরানো সূূর্যের উত্তাপ উপেক্ষা করে দৃঢ়পায়ে বাড়ির দিকে হেঁটে চলে সে।
*রাশিদা আল-শারনি : ১৯৬৭ সালে তিউনিসে রাশিদা আল-শারনির জন্ম। অল্প বয়সেই ছোট গল্প লেখা শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় এবং তা সেন্টার অব আরব উইমেন ফর ট্রেনিং অ্যন্ড রিসার্চ ইন তিউনিস পুরস্কার লাভ করে। ২০০০ সালে তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থও আরব উইমেন ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর প্রথম পুরস্কার পায়। ২০১১ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘তারাতিল লি-আলামিহা’ প্রকাশিত হয়। রাশিদা তিউনিসিয়ার একজন প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত। তিনি তিউনিসে বাস করেন। তার বর্তমান গল্পটি আরবিতে ‘তারিক দার আল-আজায়েব’ নামে প্রকাশিত ও ইংরেজিতে তা পায়ার্স আমোদিয়া কর্তৃক ‘দি ওয়ে টু পপি স্ট্রিট’ নামে অনূদিত হয়। এটি ২০১২ সালে গ্রান্টা প্রকাশিত ‘গ্রান্টা বুক অব দি আফ্রিকান শর্ট স্টোরি’-তে অন্তর্ভুক্ত হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।