Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রমজানে বায়তুল্লাহ প্রতিমামুক্ত হয়

| প্রকাশের সময় : ১৬ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কে. এস. সিদ্দিকী
রমজান নুজুলে কোরআনের মহিমান্বিত মাস হওয়ার পাশাপাশি বহু ধর্মীয়, আধ্যত্মিক, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক ইত্যাদি দিক থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমÐিত দিকের অধিকারী। বিশেষভাবে কেবল যদি রাসূলুল্লাহ (স.) এর মাদানী জীবনের দশ বছরের হিসাব করা যায়, তাহলেও দেখা যাবে যে, ইসলামে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা এ নুজুলে কোরআনের বরকতময় মাসেই সংঘটিত হয়েছে। এখানে সব ঘটনা বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
ইতিহাসের দৃষ্টিতে রমজান বিজয়ের মাস নামেও সু-পরিচিত। কেননা এ মাসেই আরবের পৌত্তলিক কাফেরদের মোশরেকী আকীদা বিশ্বাসের অর্থাৎ অসত্য-বাতিলের বিরুদ্ধে হক ও সত্যের যুদ্ধে বিজয়ের সূচনা ও মহাবিজয় সূচিত হয়েছিল এ পবিত্র মাসে। হিজরী দ্বিতীয় সালের ১৭ রমজান বদর রনাঙ্গনে পৌত্তলিক কাফেরদের যে শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল মুসলমানদের সে সূচনা বিজয় পরিপূর্ণতা লাভ করে হিজরী ৮ম সালে রমজান মাসে রাসুলুল্লাহ (স.)এর বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ ও কাবায় স্থাপিত ৩৬০টি মূর্তি ধ্বংসের মাধ্যমে মহাবিজয়। এ সময় রাসূলুল্লাহ (স.) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে এক অতুলনীয় নজির স্থাপনা করেন। পরবর্তীদের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। মক্কা বিজয়ের এ তারিখটি ছিল ২০ রমজান।
খানা-ই কাবায় প্রবেশের পর রাসূলুল্লাহ (স.) আল্লাহর এ ঘর, যা বিশ্বের বুকে প্রথম এবাদতগাহ হিসেবে পরিচিত পবিত্র ও প্রতিমামুক্ত করার জন্য যে অভিযান পরিচালনা করেন তার বিস্তারিত বিবরণ সীরাতগ্রন্থগুলোতে বিদ্যমান। মক্কায় প্রবেশের বিবরণ মুসলিম শরীফে হযরত আবু হোরায়রা (রা.) এর বর্ণনা এইরূপ:
রাসুলাল্লাহ (স.) খালেদ ইবনে ওয়ালিদ ((রা.)কে মায়মানায় (সৈন্যবাহিনীর দক্ষিণ বাহু) এবং হযরত যোবায়ের (রা.)কে মায়মানার (সৈন্যবাহিনীর বাম বাহু) নিয়োগ করেন এবং অশস্ত্র বা নিরস্ত্র লোকদের নেতা নিয়োগ করেন। হযরত আবু উবায়দা(রা.)কে যিনি ‘বাতনেওয়াদী’ নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (স.) খোদ একটি আলাদা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অপরদিকে কোরেশরা দুষ্টু লম্পট ও তাদের অনুসারীদের একটি দলকে গোলযোগ ও বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্য সমবেত করেছিল। এসময় রাসুল (স.) হযরত আবু হোরায়রা (রা.)কে ডাকেন, তিনি ‘লাব্বাইক-সা’দাইক’ বলে হাজির হন। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, আনসারকে ডাকো এবং শুধু আনসারকে ডাকো, তারা ডাক শুনে দৌড়াতে দৌড়াতে আসেন এবং হুজুর (স.)এর পাশে সমবেত হন। হুজুর (স.) বললেন, তোমরা কোরেশদের দুষ্টুমি দেখতে পাচ্ছো? তারা বলেন, হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। তিনি স্বীয় একটি হস্ত মোবারক প্রসারিত করে তাতে অপর হস্ত রেখে ইশারা করেন যে, সকলকে খতম করে দাও এবং এর পর ছাফা পর্বতে আমার সাথে মিলিত হবে।
হযরত আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, আমরা যাত্রা করি এবং আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি যে কাফেরকে হত্যা করতে চাইতো, সে তাকে হত্যা করতো, কিন্তু শত্রæ পক্ষের কোনো লোকই আমাদের দিকে তাকানোর সাহস করতো না। আবু সুফিয়ান এ অবস্থা দেখে রাসুলুল্লাহ (স.) এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কোরেশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এখন কোরেশের নাম আর দুনিয়াতে থাকবে না। হুজর (স.) বলেন, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ, যে ব্যক্তি অস্ত্র ত্যাগ করবে সেও নিরাপদ, যে ব্যক্তি স্বীয় গৃহের দরজা বন্ধ রাখবে সেও নিরাপদ।
রাসুলুল্লাহ (স.) এর ঝান্ডা স্থাপন করা হয় ‘হাজুন’ নামক স্থানে যাকে জান্নাতুল মোআল্লা বলা হয়। এটি মসজিদে ফাতহের নিকটবর্তী স্থান। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (স.) বায়তুল্লাহর দিকে রওয়ানা হন, তাঁর অগ্র-পশ্চাত ও দুই পাশে মোহাজেরীন ও আনসারগণের বিশিষ্ট জনেরা ছিলেন। হুজুর (স.) মসজিদে হারামে প্রবেশ করে প্রথমে হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) চুম্বন করেন। এরপর সোয়ারীর ওপর তাওয়াফ করেন এবং এ সময় তিনি এহরাম অবস্থায় ছিলেন। তাই শুধু তাওয়াফকেই যথেষ্ট মনে করেন। তাওয়াফ অবস্থায় তাঁর হাতে ছিল তীর। আর বায়তুল্লাহর চতুর্দিকে স্থাপিত ছিল তিনশ ষাটটি (৩৬০) মূর্তি । তিনি তীর দ্বারা মূর্তির দিকে ইশারা করতেন আর বলতেন ‘জাআল হাক্কু ওয়া যাহাকাল বাতিলু, ইন্নাল বাতিলা কানা যাহুকা’। অর্থাৎ সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে এবং বাতিল অপসারিত হয়েছে, নিশ্চয় বাতিল অপসারিত হওয়ারই বস্তু।
হুজুর (স.) তীর যখন মূর্তির পৃষ্ঠদেশের দিতে তাক করতেন, তখন তা মুখ থুবড়ে পড়ে যেতো এবং যখন মূর্তির সম্মুখের দিকে তাক করতেন, তখন উহা পিছনের দিকে পতিত হতো।
বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী সেদিন মক্কায় বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত বৃহদাকারের মূর্তিগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ছাফা পর্বতে ‘এসাফ’ ও ‘নায়েল’ নামক দুটি প্রাচীন মূর্তি ছিল। এ দুটি মূর্তি সম্পর্কে কোরেশদের বিশ্বাস ছিল এই যে, এ দুটি জুরহুম গোত্রের দুই নারী পুরুষের মূর্তি ছিল, ওরা দুইজন বায়তুল্লাহে যিনা-ব্যভিচার অপকর্মে লিপ্ত থাকতো। তাই ওদের আকার-আকৃতি বিকৃতি করে দেওয়া হয়, তথাপি এ বিশ্বাস থাকা সত্তে¡ও মূর্তি দুইটির পূজা করা হতো।
মক্কায় ‘হাবল’ নামক একটি বিরাট মূর্তি ছিল। এটি যখন ধ্বংস করা হয়, তখন হযরত যোবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.) আবু সুফিয়ানের উদ্দেশ্যে বলেন, এটি সেই মাবুদ, যার প্রতি তোমার গর্ব ছিল এবং ওহুদ যুদ্ধের সময় তুমি বলতে ‘উলু হোবল’। আবু সুফিয়ান বলেন, সে কাহিনীর কথা বাদ দাও এবং এ ধারণার জন্য এখন তিরস্কার করো না। আমরা বুঝতে পেরেছি, যদি মোহাম্মদ (স.) এর খোদা ব্যতীত অপর কোনো মাবুদ থাকতো, তাহলে সে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতো এবং আমাদের অবস্থা হতো ভিন্ন।
কাবার প্রাচীরের উঁচুতে যে মূর্তিটি স্থাপিত ছিল এবং সেখানে হাত পৌঁছত না, সেজন্য রাসুলুল্লাহ (স.) হযরত আলী (রা.)কে নিজের কাধে উঠান। এভাবে হযরত আলী (রা.) ঐসব মূর্তি ভাঙ্গেন এবং নীচে পতিত করেন।
যখন হুজুর (স.) তাওয়াফ শেষ করেন, উসমান ইবনে তালহা(রা.)কে ডাকেন এবং তাঁর কাছ থেকে কাবার চাবি নিয়ে দরজা খোলেন এবং ভেতরে প্রবেশ করেন, দেখতে পান, হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.) এর ছবি বানিয়ে রাখা হয়েছে এবং তাদের হাতে জুয়ার তীর। হুজুর (স.) বলেন, খোদা ঐসব কাফেরকে ধ্বংস করুন, এ দুইজন মহান নবী, তারা কখনো জুয়া খেলেননি। হুজুর (স.) আরো দেখতে পান যে, দুটি কাঠের কবুতর, তিনি সে দুইটি স্বহস্তে ভেঙ্গে ফেলেন এবং ছবিগুলো অপসারণের নির্দেশ প্রদান করেন। সুতরাং ছবিগুলো মুছে ফেলা হয়।
বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী হুজুর (স.) ৮ম হিজরী সালের দশ রমজান বুধবার আসরের পর মদীনা হতে মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং মতান্তরে ২০ রমজান মক্কায় প্রবেশ করেন এবং একই দিন মক্কা বিজিত হয় এবং একই দিন খানা-ই কাবায় প্রবেশ করে তা প্রতিমা মুক্ত করেন, যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। বলা যায়, এটি ছিল কাবা মূর্তি- প্রতিমা মুক্ত করার হুজুর (স.) এর প্রথম ও স্বশরীরে সরাসরি প্রথম অভিযান অর্থাৎ ২০ রমজানে। অতঃপর ভীড়ের মধ্যে কাবার দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভেতরে তাঁর সঙ্গে হযরত বেলাল (রা.) ও হযরত ওসামা (রা.) থেকে যান। এরপর তিনি দরজার সামনের দেয়ালের দিকে গমন করেন। যখন দেয়াল তিন গজ পর্যন্ত দূরত্ব থেকে যায়, তখন থেমে যান এবং সেখানে নামাজ পড়েন। এরপর বায়তুল্লাহর চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করেন এবং প্রত্যেক দিকে তাওহীদ ও তাকবীরের আওয়াজ বুলন্দ করেন। অতঃপর দরজা খোলা হয়। কোরেশদের দ্বারা মসজিদ ভরে যায় এবং তারা কাতার বন্দি হয়ে হুজুর (স.) এর প্রতীক্ষায় থাকে। হুজুর (স.) দরজায় দাঁড়ান এবং দরজার উভয় পাশ ধরে বলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, ছাদাকা ওয়াদাহু, ওয়া নাছারা আবদাহু, ওয়া হাজেমাল আহযাবা ওয়াহদাহু’ অর্থাৎ একক আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই, তার কোনো শরিক নেই, তার ওয়াদা সত্য হয়েছে, তার বান্দাকে তিনি সাহায্য করেছেন এবং এককভাবে তিনি শত্রæ দলগুলোকে পরাজিত করেছেন।
এরপর হুজুর (স.) খোতবা প্রদান করেন এবং জাহেলী যুগের কোনো কোনো কু-প্রথা সম্পর্কে বলেন যে, এসব আজ বাতিল এবং আমার পদতলে। অবশেষে বলেন, হে কোরেশ জাতি! তোমাদের জাহেলী যুগের গর্ব-অহংকার পিতৃ-পুরুষদের বংশের শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ আল্লাহ তা’আলা তোমাদের থেকে মিটিয়ে দিয়েছেন।
অতঃপর হুজুর (স.) জিজ্ঞাসা করেন, হে কোরেশ জাতি! তোমাদের কি ধারণা? আমি তোমাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করবো? সকলে বলে উঠলো- ভালো, উত্তম, আপনি করিম, করিমের বংশ, তাই আপনার নিকট শুধু ভালোই আমাদের প্রত্যাশা। হুজুর (স.) বললেন, আমি তোমাদেরকে সেই কথাই বলবো, যা হযরত ইউসুফ (আ.) তার ভ্রাতাদেরকে বলেছিলেন, লা তাছরীবা আলাইকুমুল ইয়াওম অর্থাৎ আজ তোমাদের প্রতি কোনো অনুযোগ নেই, তোমরা সবাই মুক্ত (আনতুমু তোলাকাউ)।
এরপর রাসুলুল্লাহ (স.) বেশ কিছু জরুরি ঘোষণা প্রদান করেন এবং হযরত বেলাল (রা.)কে কাবায় আজান দিতে নির্দেশ প্রদান করেন। হযরত বেলাল (রা.) কাবায় ইসলামের প্রথম আজান দেন। মক্কায় বিজয় সমাপ্ত হওয়ার পর যখন স্বস্তি শান্তি ফিরে আসে, তখন রাসুলুল্লাহ (স.) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, কিন্তু কয়েকজন পুরুষ ও নারীকে এ সাধারণ ক্ষমার আওতা হতে বাদ দেন এবং নির্দেশ প্রদান করেন যে, ওদেরকে যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানেই হত্যা করতে হবে। এমনকি কাবার গিলাফ ধরা অবস্থায় পাওয়া গেলেও। কেউ কেউ তাদের সংখ্যা ৯ জন, কেউ কেউ আরো অধিক লিখেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে হত্যা করা হয় এবং কেউ কেউ ইসলাম গ্রহণ করায় তাদেরকে ক্ষমা করা হয়।
(আগামী বারে সমাপ্য)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রমজান


আরও
আরও পড়ুন