Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলাহে নফসের গুরুত্ব ও পন্থা

| প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৩। অসুস্থ অন্তর ঃ অসুস্থ অন্তর (নফসে লাওয়ামা) হচ্ছে এ ধরনের অন্তর পূর্ণ মৃত নয়। সুস্থতা আর অসুস্থতার মাঝখানে তার অবস্থান। এমতাবস্থায় নিজেকে শুধরে নিয়ে তার সুস্থতা অর্জনের যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি নিজেকে না শুধরে চরম কলুষতার অতল গহŸরে তলিয়ে গিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার আশংকাও রয়েছে। যা দ্বারা অন্তর মরে যায় ঃ অন্তর রোগাক্রান্ত হয় এবং পর্যায়ক্রমে তার মৃত্যু ঘটে যে সমস্ত কারণে, তার মধ্যে অন্যতম হলো জেনে বুঝে হক প্রত্যাখ্যান করা। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- ‘‘যখন তারা বক্রপথে চলে গেলো, আল্লাহ তাদের অন্তরকে বক্র করে দিলেন। আর আল্লাহ দুষ্কৃতকারীদেরকে হিদায়াত প্রদান করেন না।’’ (সূরাহ সফ, আয়াত নং-৫) এ ধরনের মৃত অন্তরগুলো আল্লাহর দৃষ্টিতে চতুষ্পদ জানোয়ারের চেয়েও অধম। জাহান্নামই হচ্ছে তাদের প্রতিফল। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন ‘জ্বিন ও ইনসানের অনেককেই আমি জাহান্নামের জন্য নির্ধারিত করেছি- যাদের হৃদয় থাকলেও তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করেনা, চক্ষু রয়েছে, অথচ তা দিয়ে তারা অবলোকন করে না। তাদের কর্ণ রয়েছে, তা দিয়ে তারা শ্রবণ করে না। এরা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়। বরং তার চেয়েও অধম। এরাই হচ্ছে গাফিল।’’ (সূরাহ আ’রাফ, আয়াত নং-১৭৯)
অন্তর রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণসমূহ ঃ প্রথমতঃ হারাম রুজি রোজগার এবং হারাম খাদ্য গ্রহণ ও হারাম জিনিসের ব্যবহারের দ্বারা অন্তর রোগাক্রান্ত হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হারাম খাদ্য খেয়ে হারাম পোশাক পরে ও হারাম উপাদান গ্রহণ করে হাত উঁচু করে দোয়া করে- ইয়া রব! ইয়া রব! তার দোয়া কিভাবে কবুল হবে?-(সহীহ মুসলিম)
দ্বিতীয় ঃ গুনাহ করতে করতে অন্তরের মধ্যে কালো দাগের মরিচা পড়ে যায়। যদ্দরুণ অন্তর ভয়ানকভাবে রোগগ্রস্থ হয়। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, “কখনো নয়, তারা যা কামাই করছিলো (অপকর্ম) তার কারণে তাদের অন্তরের মধ্যে মরিচা ধরে গিয়েছে’’-(আল মুতাফ্ফিকুন: ১৪)। রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেন ‘‘বান্দাহ যখন গুনাহ করে, তার অন্তরে সাথে সাথে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। তাওবা করলে সে দাগটি মুছে যায়। আর তা না হলে কালো দাগ বাড়তে বাড়তে পরো অন্তরকে সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করে দেয়’’-(মুসলিম, আহমদ, ইবন মাজাহ)
তৃতীয়তঃ হারাম দৃষ্টি অন্তরকে অসুস্থ করে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন, “হারাম দৃষ্টিতে শয়তানের একটি বিষধর তীর’’-(মুসনদে আহমদ)
চতুর্থত ঃ গান-বাজনা ও যাবতীয় অশ্লীল সিনেমা, ভিডিও, টিভি প্রোগ্রাম অশ্লীল পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন বই পুস্তক ইত্যাদির মাধ্যম ব্যবহার করে শয়তান মানুষের মনে কামনা-বাসনার প্রবাহ সৃষ্টি করে অন্তরকে অসুস্থ ও কলুষিত করে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেন-“নিশ্চয়ই গান অন্তরে নিফাক পয়দা করে- যেমন কর পানি শস্য জন্ম দেয়।’’
অন্তরের ইসলাহ অর্জনের উপায় ঃ বস্তুত অন্তরের সুস্থতা বা অসুস্থতা নির্ভর করে মানুষের এ ব্যাপারে চেষ্টা-তদবীর করা না করার উপর। এক্ষেত্রে অন্তরকে কলুষতামুক্ত করতে বা রাখতে হলে, যে ধরনের কাজ করতে হয়, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-
ক) বেশী বেশী করে কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর যিকর ইত্যাদিতে নিজেকে লিপ্ত রাখা। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-“জেনে রেখো, শুধু আল্লাহর স্মরণ ও যিকর দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্তি পেতে পারে।’’ (সূরাহ আ’রাফ : আয়াত-২৮) অপর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-“প্রকৃত মুমিন তো তারাই, আল্লাহর নাম উচ্চারিত হলে যাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার হয় এবং তাদের নিকট (আল্লাহর) আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হলে, তাদের ঈমান বেড়ে যায়। আর তাদের রবের উপর তারা তাওয়াক্কুল করে।’’ (সূরা আনফাল, আয়াত নং-২) এ জন্যই হক্কানী পীর-মাশায়িখগণ সালিকীনদের ইসলাহের জন্য যিকির ও তিলাওয়াতের নুসখাহ দিয়ে থাকেন। আর তারা সেই অনুযায়ী আমল করে ইসলাহে নফস-এর মুজাহাদা করেন।
খ) দ্বীনী ইলম ও তরবিয়্যাত হাসিল করা। এজন্য কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান হক্কানী উলামায়ে কিরামের বই-পুস্তক ও দ্বীনী কিতাবাদি অধ্যয়ন করা এবং সেই অনুযায়ী দ্বীনদারী গ্রহণ করা কর্তব্য।
গ) হক্কানী উলামা-মাশায়িখগণের দ্বীনী মাহফিলে অংশগ্রহণ করা, তাঁদের ইসলাহী বয়ান শ্রবণ করা এবং তাদের নির্দেশনানুযায়ী আত্মশুদ্ধি অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। এভাবে মুজাহাদা করার মাধ্যমেই অন্তরের রোগ দূর হয়ে দিলে হিদায়াতের নূর পয়দা হয়। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- “আপনি তাদেরকে নসীহত করুন। নিশ্চয়ই নসীহত মু’মিনদেরকে ফায়দা দান করে। (সূরাহ যারিযাত, আয়াত নং-৫৫)
ঘ) নেক্কার ও আল্লাহওয়ালাগণের সাহচর্য গ্রহণ করা। এতে অন্তরে জীবনীশক্তির সঞ্চার হয়, নেক কাজে উৎসাহ সৃষ্টি হয় এবং গুনাহ বর্জনের দীক্ষা পাওয়া যায়। এর জন্য হক্কানী পীর-মাশায়িখগণের সাথে ইসলামী তা’আল্লুক স্থাপন ও বাই’আত গ্রহণের মাধ্যমে যুলুমের পথে চলার প্রয়োজন হয়।
ঙ) আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শন সমূহের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব, তার কুদরত ও ক্ষমতা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে হৃদয়ে আল্লাহর অনুভ‚তি জাগ্রত করা। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-“নিশ্চয়ই আকাশ-যমিনের সৃষ্টি, রাত দিনের আগমন ও প্রস্থানে জ্ঞানী ও বিবেকবানদের জন্য শিক্ষণীয় নিদর্শনাবী রয়েছে।’ (সূরাহ আলে ইমরান, আয়াত নং-১৯০)
চ) অভিশপ্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের উত্থান-পতনের ইতিহাস অধ্যয়ন করে আল্লাহর নাফরমানীর পরিণতি সম্পর্কে উপলব্ধি করা। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- “কত যে জনপদ পড়ে আছে যেগুলোকে আমি ধ্বংস করেছি তাদের জুলুম ও অন্যায়ের কারণে। সেগুলো বিরান হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ক‚পগুলো পানিশূন্যভাবে পরিত্যক্ত হয়ে আছে। বিরান হয়ে আছে প্রাসাদোপম ভবনগুলো। তারা কি ধরণীতে পরিভ্রমণ করে না? অন্তরগুলো দিয়ে কি তারা অনুভব করে না? কর্ণ দিয়ে কি শ্রবণ করতে পারে না? আসল কথা হলো, এ অন্ধত্ব চক্ষু না থাকার অন্ধত্ব নয়, এ অন্ধত্ব হলো রক্তের অভ্যন্তরে রক্ষিত হৃদয়ের অন্ধত্ব।’’ (সূরাহ হজ্ব, আয়াত নং-৪৫) বস্তুত অন্তরের রোগের চিকিৎসা কুরআন-হাদীস ছাড়া অন্য কোন বিদ্যায় নেই।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- “হে মানুষ! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভ‚র কাছ থেকে এসেছে সৎ উপদেশ এবং তোমাদের অন্তরস্থলের রোগমুক্তি।’’ (সূরাহ ইউনুস, আয়াত নং-৫৭) আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন “আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করেছি, যেটা হচ্ছে শিফা (অন্তরের রোগমুক্তি) ও মুমিনদের জন্য রহমত।’’ (সূরাহ বনী ইসমাঈল, আয়াত নং-৮২)
তাই পবিত্র কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা গ্রহণ করে যাবতীয় পাপাচার ছেড়ে নেকের পথ অবলম্বন করতে হবে এবং প্রয়োজনে কোন কামিল শাইকের সাহচর্য গ্রহণ করে তার ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী আত্মার চিকিৎসা করে অন্তরের পরিশুদ্ধতা অর্জন করতে হবে। এভাবে আত্মশুদ্ধির সাধনা ও রিয়াজত-মুজাহাদার মাধ্যমে ইসলাহে নফসের প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হলে, এর মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করে জীবন পরিশুদ্ধ করা সম্ভব হবে। আর এর মাধ্যমেই অর্জিত হবে ইহ ও পরকালীন কাঙ্খিত সাফল্য।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ