Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রবাসী আয় হ্রাসে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ -দ্য ইকোনমিস্ট

| প্রকাশের সময় : ১১ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম


অর্থনৈতিক রিপোর্টার : এটা রহস্যজনক। গত বছর বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণ ৭ লাখ যুক্ত হয়ে ৮০ লাখে পৌঁছায়। এই শ্রমিকেরা তাঁদের পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু এখন পরিসংখ্যান নির্দেশ করছে, তাঁরা এখন বাড়িতে কম অর্থ প্রেরণ করছেন। চলতি অর্থবছর, যা এ মাসে শেষ হচ্ছে, তাতে এটা পরিষ্কার যে একাদিক্রমে দ্বিতীয় অর্থবছরে বিদেশ থেকে প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণ (রেমিটেন্স) হ্রাস পাবে।
এবারে এটা দশ ভাগের বেশি হ্রাস পেয়ে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ধাঁধার ব্যাখ্যা পেতে হলে এই শ্রমিকেরা কোথায় কাজ করেন, সেসব স্থানের দিকে নজর দিতে হবে। চোখ রাখতে হবে প্রযুক্তির দিকে। এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের ব্যবহৃত ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ভুল হিসাবপত্র তৈরির দিকে নজর দিতে হবে। গত নভেম্বরে ভারত সরকার বেশির ভাগ ব্যাংক নোট আকস্মিকভাবে বাতিলের ঘটনা অন্যতম এক বিষয়। ভারতে কর্মরত লাখ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক নগদ অর্থের সংকটজনিত ফাঁদে আটকা পড়েন। এর ফলে মাসিক অর্থের অভ্যন্তরমুখী প্রবাহের ভয়ানক পতন ঘটে। অন্যদিকে, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল, যা বাংলাদেশি প্রবাসী আয়ের ৬০ ভাগের উৎস, সেখানে অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
তবে এসব আঘাত ছাড়াও প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণ নিম্নমুখী হওয়ার জন্য দায়ী কারণগুলোর মধ্যে অল্পসংখ্যকই বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। অবশ্য অর্থ প্রেরণে মন্থরগতি বাংলাদেশের জন্য কোনো অনন্য নজির নয়। বিশ্বব্যাংকের মতে, গত তিন দশকের মধ্যে এই প্রথম ২০১৫ ও ২০১৬ সালে উন্নয়নশীল দেশসমূহে রেমিটেন্সের পতন ঘটেছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টসে এ ঘটনা একটি গহŸর তৈরি করেছে। গত অর্থবছরে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট বা চলতি হিসাবে থাকা ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন (জিডিপির ১ দশমিক ৭ ভাগ) ডলারের উদ্বৃত্ব চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতিতে নেমে এসেছে। এ ঘটনা অবশ্য কোনো আশু হুমকি বয়ে আনেনি। কিন্তু প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি দেখতে অভ্যস্ত সরকারকে সেটা হুঁশিয়ার করেছে।
এটা বিশেষ করে মোবাইল অ্যাপসের ব্যবহারকে বিপদে ফেলেছে। কারণ এই মোবাইল অ্যাপস হুন্ডির মাধ্যমে টাকা লেনদেনকে সহায়ক করেছে। হুন্ডি হলো একধরনের অনানুষ্ঠানিক টাকা হস্তান্তর-ব্যবস্থা। যার মাধ্যমে প্রবাসী শ্রমিক একজন এজেন্ট-তার অবস্থান বিশ্বের যে প্রান্তেই হোক না কেন-তার মাধ্যমে সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশে টাকায় পরিশোধ করতে পারেন। ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণের মতোই প্রবাসী আয় হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো চলে। তবে তা আরও বেশি সস্তা ও দ্রæত কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার কখনো সীমান্ত পেরোতে হয় না।
বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষসমূহ ১৫টি অবৈধ মোবাইল অ্যাপস চিহ্নিত করেছে। হুন্ডি ডিজিটাল হয়ে যাওয়ার করণে ক্রমবর্ধমান হারে মানুষ এখন বিকাশের মতো অনুমোদিত মোবাইলে অর্থ প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। শুধু বিকাশেরই ২৮ মিলিয়ন অ্যাকাউন্ট এবং ১ লাখ ৭০ হাজার এজেন্ট রয়েছে। ফেব্রæয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মোবাইলে দৈনন্দিন জামানতের অর্থ ১৫ হাজার টাকা এবং উত্তোলনের পরিমাণ ১০ হাজার টাকায় সীমিত করে দিয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে ইতিপূর্বে এই টাকার পরিমাণ ২৫ হাজার টাকা ছিল। ১ জুন বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী প্রবাসী আয় স্থানান্তরে ব্যাংক ফি বিলোপের প্রতিশ্রæতি এবং যাতে সরকারি চ্যানেলে ওই অর্থের প্রবাহ ঘটে সে লক্ষ্যে আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের ইঙ্গিত দেন। সরকার-নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হারের কারণে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় প্রেরণকে অনাকর্ষণীয় করে রেখেছে। ব্যাংক ও হুন্ডির মধ্যকার এই ব্যবধান প্রতি ডলারে পাঁচ টাকা।
ঢাকাভিত্তিক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের আহসান মনসুর অবশ্য প্রবাসী আয় প্রেরণের হার পতনের সঙ্গে বাংলাদেশিদের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে জমানোর ক্রমবর্ধমান চাহিদার যোগসূত্র উল্লেখ করেছেন। ২০১৮-এর শেষের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের একান্ত সহচর, ব্যবসায়ী এবং বর্ধিষ্ণু মধ্যবর্তী শ্রেণি ইতিমধ্যে বিচলিত বোধ করছেন এবং তারা দূরবর্তী গন্তব্যে অর্থ জমাতে চাইছেন।
মার্কিন গবেষণা এবং অ্যাডভোকেসি গ্রুপ গেøাবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির মতে, বাংলাদেশ থেকে ২০০৫ ও ২০১৪ সালের মধ্যে হিসাবের বাইরে অর্থ প্রেরণের পরিমাণ ৬১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই গ্রুপটি প্রাক্কলিত ৯০ শতাংশ অর্থ এভাবে প্রেরণের জন্য বাণিজ্যের ভুল চালানকে (মিসইনভয়েসিং) দায়ী করেছে। ২০০২ সাল থেকে আট গুণ বৃদ্ধি পাওয়া বাংলাদেশের বার্ষিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের প্রায় ৪০ শতাংশ আসে চীন ও হংকং থেকে। আর এ দুটি দেশেই ‘আন্ডার ইনভয়েসের’ (পণ্যের দাম কম দেখানো) ঘটনা সুবিস্তুৃত। সাধারণত একজন চীনা রপ্তানিকারক একজন বাংলাদেশি ক্রেতার কাছে ১০ ডলারের পরিবর্তে মাত্র এক ডলার দাম দেখিয়ে চালান তৈরি করেন। এর মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের বেশির ভাগ আয়ের ওপর চীনা বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে থাকেন। আমদানিকারক আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে এক ডলার পরিশোধ করে থাকেন। আর শুল্ক ফাঁকি দেওয়া বাকি ৯ ডলার রপ্তানিকারকের কাছে পৌঁছে যায় হুন্ডির মাধ্যমে।
সুতরাং হুন্ডি নেটওয়ার্কে টাকার মূল্যে ডলার ক্রয়ের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঞ্চয় অবশ্যই একটি অপরিহার্য উৎস। এবং এই মুহূর্তে দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশের আমদানির অর্থ পরিশোধে তারা সহায়তা দিচ্ছে। আর সেটাও সরকারিভাবে অর্থ  প্রেরণকে সংকুচিত করছে। বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতি বছরে ৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সেখানে এ ধরনের অর্থ নিয়ে এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা বিধিবিধান এড়াতে ধূর্ত পথ অনুসরণে উদগ্রীব থাকছেন। (সূত্র দ্য ইকোনমিস্ট ও প্রথম আলো)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দ্য ইকোনমিস্ট
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ