Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ভেজাল পণ্যে বাজার সয়লাব

| প্রকাশের সময় : ৩ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সারা বছর খোঁজ-খবর নেই প্রতি বছর রমজান মাস এলেই টনক নড়ে সংশ্লিষ্টদের  ষ র‌্যাব পুলিশ এপিবিএন জেলাপ্রশাসক ও বিএসটিআইয়ের ভ্রামমান আদালতের অভিযানের পরেও থেমে নেই ভেজাল পণ্য উৎপাদন  ষ রাজধানীর সুপার শপগুলোতে বিক্রি হচ্ছে মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবারসহ পচা-বাসী, মাছ-মাংস
উমর ফারুক আলহাদী : ঈদকে সামনে রেখে তৈরি হচ্ছে ভেজাল সেমাই ঘিসহ নিত্য প্রয়োজনী খাবার সামগ্রী। রাজধানী ও এর আশপাশ এলাকায নতুন নতুন কারখানা গড়ে ময়লা আর্বজনা পরিবেশে তৈরী হচ্ছে নি¤œমানের এসব খাবার। রাজধানীর মধ্যেই শতাধিক সেমাই তৈরির কারখানার তালিকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। রমজানের প্রথম দিন থেকেই এসব ভেজাল সেমাই তৈরির প্রতিষ্ঠান ও মানহীন পানির ফ্যাক্টরিগুলো শনাক্ত করে অভিযান শুরু করেছে ভেজালবিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেমাইসহ ঈদের অত্যাবশকীয় পণ্যের ভেজাল রোধে মাঠে নেমেছে র‌্যাব, পুলিশ, এপিবিএন  জেলা প্রশাসক ও বিএসটিআইর ভ্রাম্যমান আদালত।   রমজানের শুরু থেকে ভ্রাম্যমান আদালত ভেজাল বিরোধী অভিযান শুরু করেছে। তারপরেও থেমে নেই ভেজাল পণ্যের কেনা বেচা। ভেজাল সেমাই ,ঘি ও মসলাসহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় ভেজাল খাবারেও এখন বাজার সয়লাব।  সেইসাথে রাজধানীর সুপারশপগুলোতে বিক্রি হচ্ছে মেয়াদ উর্ত্তীণ খাবারসহ পচা বাসী মাছ মাংস।
রমজানে ঘি, সেমাই, নুডলসের কারখানায় তৈরিকৃত ভেজাল ও নিুমানের ভোগ্যপণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা এসব ভেজাল পণ্যের বাণিজ্য করছে অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট। স্থানীয় থানা পুলিশ ও প্রভাবশালী মহলের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ভেজাল খাদ্যদ্রব্য তৈরি এবং বাজারজাতকরণের মাধ্যমে কয়েক শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ চক্রটি। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সদস্যরা প্রতি রমজান-ঈদ মৌসুমে অবৈধ বাণিজ্যকে জায়েজ করার জন্য স্থানীয় থানা পুলিশকে মোটা অংকের মাসোয়ারা প্রদান করার অভিযোগ রয়েছে।
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভেজাল উপাদানে তৈরিকৃত মানহীন সেমাই, নুডলস, ঘি এবং মরিচ, হলুদ, মশলার গুঁড়া বাজার দখল করে নিচ্ছে। এসব মানহীন খাদ্যদ্রব্য প্রস্ততের জন্য উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে মারাত্মক রাসায়নিক উপাদান। সেমাই ও নুডলস তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নষ্ট হয়ে যাওয়া ময়দা, পাম অয়েল, অ্যারারোট, সাবান তৈরির রাসায়নিক উপাদান তাল্লু ও এক ধরনের রাসায়নিক পাউডার। মরিচের গুঁড়া তৈরিতে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পচা মরিচ (পটকা), ধানের তুষ, ইটের গুঁড়া ও লাল রঙ। তেমনিভাবে হলুদ ও মশলার গুঁড়া তৈরিতে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নষ্ট হয়ে যাওয়া হলুদ ও মশলা, পচা চালের গুঁড়া ও রঙ। ঘি তৈরিতে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে অত্যধিকহারে পাম অয়েল, অতি নি¤œ মানের ডালডা, বেকারি ঘি ও রাসায়নিক রঙ। এছাড়া পটকা, ধানের তুষ, ইটের গুঁড়া, পচা চাল, পচা মশলা ও রঙ ব্যবহার করে বেনামে প্যাকেট করে নিুমানের মরিচের গুঁড়াসহ হলুদ মশলার গুঁড়া বাজারজাত করে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। আর এসব ভেজাল পণ্য অবাধে বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর নামী দামী সুপারসপ আগোরা, স্বপ্ন থেকে শূরু করে নগরীর অলি গলিতে। ভেজাল বিরোধী অভিযানের তোয়াক্কা করছে না। আগোরা, স্বপ্নর মতো প্রতিষ্টানগুলো।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রমজানের ঈদকে টার্গেট করে সবচেয়ে বেশি ভেজাল পণ্যের উৎপাদন হয়ে থাকে। এসব ভেজাল পণ্যের মধ্যে ঘি আর সেমাইয়ের নাম সবার আগে। রাজধানীর চকবাজার, বাবু বাজার, কামরাঙ্গীরচর শ্যামপুর, পোস্তগোলা ,গেন্ডারিয়া, ডেমরা, উত্তরার দক্ষিণখান, উত্তরখান, দিয়াবাড়ি এবং রাজধানীর পাশে টঙ্গী,গাজীপুর, সাভার কেরানীগঞ্জ এলাকায় রয়েছে শত শত ভেজাল পন্য উৎপাদনের কারখানা। এসব কারখানায় ময়লা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরী হচ্ছে ভেজাল সেমাই ও ঘি। এছাড়া রাজধানীর অলিগলিতে ছড়িয়ে আছে বেশকিছু ‘ভ্রাম্যমাণ’ ঘি কারখানা। পাকোয়ান, ডানোফা, এ সেভেন, এপি ওয়ান, রাজা, মীম, প্যারিস, গ্রিন মাউন্ট, কুইন কাউ, হোয়াইট কাউ, বিটা, টাটকা-১, মদিনা, ত্রিস্টার, রাজবাড়ি, আসল বাঘাবাড়ি, গোল্ডেন, ডায়মন্ডসহ হাজারো ঘিয়ে ভরে গেছে বাজার। এসব বেনামী ব্যান্ডের ঘি পুরো রাজধানীতে রমরমা ব্যবসা করছে। বাজার দখলকরা এসব ঘি উৎপাদনকারী কারখানার কোনটিরই অনুমোদন নেই। মাঝ মাঝে এসব কারখানায় অভিযান চালিয়ে মালামাল ধ্বংস করা হলেও মাঠেই থেকে যাচ্ছে তাদের ভেজাল পণ্য। বিএসটিআইএর অনুমোদন ছাড়াই এক  শ্রেণীর অসাধু মৌসুমি ব্যবসায়ী ওই সব কারখানা গড়ে তুলেছেন। সেগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই উৎপাদিত হচ্ছে ভেজাল ও নিম্নমানের লাচ্ছা এবং খিল সেমাই।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার চাল, ডাল, তেল, লবণ, আটা, ময়দা, মসলা, ফল ও পানীয় থেকে শুরু করে সব ধরনের খাদ্যপণ্যে রয়েছে ভেজালের ছড়াছড়ি। যার পরিমাণ ১০ ভাগ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত।
কিছুদিন আগে বড় দুটি ঘি তৈরির কারখানায় অভিযান চালানো হয়। এতে দুধ ছাড়া পাম অয়েল, মাস্টার গাম, ফ্লেভার, রং ও কেমিক্যাল দিয়ে ঘি তৈরির প্রমাণ পেয়েছে বিএসটিআই । শুধু ঘি তৈরীর কারখানা নয়, লাচ্ছা সেমাই, সরিষার তেল থেকে শুরু করে চাল-ডালেও ভেজাল হচ্ছে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, রমজান কেন্দ্রিক অভিযান হলেও সারা বছর এসব কারখানার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আর অভিযানে সামান্য জরিমানা দিয়ে আবারও ভেজাল পণ্য উৎপাদনের সুযোগ পায় এসব কারখানা মালিকরা। কিছু প্রতিষ্টান বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স না নিয়েও লোগো ব্যবহার করছে। তাছাড়া অনেক সময় একই ব্রান্ডর লেভেল হুবুহু নকল করে বাজারে পণ্য ছাড়ছে। বিভিন্ন সময় অভিযানের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। তারপরেও থেমে নেই ভেজাল পণ্য উৎপাদনকারী চক্র।
সা¤প্রতিক সময়ে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরি শাখায় ৪২ প্রকার খাদ্য দ্রব্যের নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে, গুটি কয়েক ছাড়া বাকি সব খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত ভেজাল রয়েছে। মিষ্টি ও মিষ্টি জাতীয় খাদ্যে পাওয়া গেছে প্রায় শতভাগ ভেজাল। চাল, ডাল, আটা ময়দায় পরিমাণ কম হলেও ভেজাল মুক্ত নয়। মিষ্টি জাতীয় খাবার মধু, রসগোল্লা, চমচম, ছানার মিষ্টি, ও আচারে ভেজালের পরিমান সর্বাধিক। ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, শিসা, পারদ, নিকেল, অ্যালোমেনিয়াম, লিথিয়ামের মতো বিষাক্ত উপাদান। উৎপাদনের সময় দুষিত পানি, মাটি ও পোকা দমনে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যাহারের মাধ্যমে খাদ্যে বিষাক্ত করা হচ্ছে।
ওই পরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঘিতে ভেজালের হার ৯৩ শতাংশ, সেমাইতে ৮৩ শতাংশ, সয়াবিন তেলে ৭৮ শতাংশ, সরিষার তেলে ৫৬ শতাংশ, বিস্কুটে ৪৬ শতাংশ, জিরায় ১৮ শতাংশ, আটায় ১১ শতাংশ, মরিচের গুড়ায় ৬০ শতাংশ, মসুরের ডালে ৬ শতাংশ, হুলদ গুঁড়ায় ৩১ শতাংশ, চিনিতে ৫ শতাংশ, চাঁ পাতায় ১০ শতাংশ, পামওয়েলে ৩২ শতাংশ, লবণে ৩৬ শতাংশ, ধনেগুঁড়ায় ৫৩ শতাংশ, খেজুরের গুড়ে ২৫ শতাংশ, মুগ ডালে ৯ শতাংশ, সুজিতে ২৭ শতাংশ, ব্যাসনে ৫২ শতাংশ, চাটনিতে ৮৩ শতাংশ, কেকে ৭০ শতাংশ, নারিকেল তেলে ২৫ শতাংশ, মিষ্টিতে ৯৮ শতাংশ, আখের গুড়ে ৫৭ শতাংশ, চিালে ৫ শতাংশ, ময়দায় ৯ শতাংশ, আচারে ৮৮ শতাংশ, জুসে ৯২ শতাংশ ভেজাল দ্রব্য মেশানো হয়েছে।
পুষ্টি বিজ্ঞানিদের মতে, এসব ভেজাল খাদ্য খাওয়ার ফলে ক্যানসার, কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস ও চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। শিশুদের মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভেজাল খাদ্যে প্রথমে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অর্গান কিডনিকে নষ্ট করে দেয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে, নানা ধরনের রোগ শরীরে বাসা বাধে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতি বছর রমজান মাস ও ঈদকে সামনে রেখেই অসাধূ ব্যবসায়ী চক্র ভেজাল ঘি এবং ভেজাল সেমাই তৈরী করে। পরর্বীতে কোন কোন ভেজাল ব্যবসায়ীই সারা বছরই এসব বিষাক্ত ও নি¤œমানের সেমাইসহ ভেজাল পণ্য বিক্রি করে। মাঝে মধ্যে ভেজাল বিরোধী অভিযানের ফলে কিছু দির ভেচা কেনা বন্ধ থাকলেও পরবর্তীতে তা বাজার সয়লাব হয়ে যায়। সাধারণ ক্রেতাদের আর বুঝার উপায় থাকে না কোনটা ভেজাল আর কোনটা আসল পণ্য।  
গত বৃহসপ্রতিবার দিন ধরেই ভ্রাম্যমান আদালত  বিভিন্ন এলাকায় এপিবিএন-৫ এর অভিযানে ভেজাল সেমাই তৈরি প্রতিষ্ঠান ও মানহীন পানির ফ্যাক্টরিকে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, ঢাকা জেলা প্রশাসন ও বিএসটিআই। বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স ও সনদপত্র ছাড়া নামী দামি ব্র্যান্ডের লোগো ব্যবহার করে মানহীন পণ্য তৈরি করে দীর্ঘদিন গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করায় একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক সমরেশ বর্মনকে এক লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে দুই মাসের কারাদন্ড প্রদানান করেন ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদ এলাহী।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের সহ-সভাপতি আল আমীন দেওয়ান বলেন, ভেজালবিরোধী অভিযান চালালেই হবে না ভেজাল সৃষ্টির কারণ অনুসন্ধান করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
সাধারন মানুষ বলছেন, প্রতি বছরই রমজান মাসে ভেজাল বিরোধী অভিযান চালানো হয়। রহস্যজনক কারণে পরর্বীতে আরো কোন ধরনের অভিজান হয় না। থাকে না সংিিশ্লষ্টদের নজরদারি। আর নজরদারির অভাবে খাদ্যে অধিকহারে ভেজাল দ্রব্য মিশিয়ে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। #



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভেজাল

৩ নভেম্বর, ২০২২
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২
১১ জানুয়ারি, ২০২২
১১ জানুয়ারি, ২০২২
২৩ অক্টোবর, ২০২১
২২ অক্টোবর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ