Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

সমন্বয়হীন সীমিত রফতানি বাজার

| প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমার ভারত নেপাল চীন ভূটান মধ্যপ্রাচ্যে মানসম্পন্ন পণ্যের চাহিদা ব্যাপক : উল্টো চোরাচালানে বাজার সয়লাব
শফিউল আলম : চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বিভিন্ন দেশে সরাসরি রফতানি করা হচ্ছে শিল্প ও কৃষিজ পণ্যসামগ্রী। তবে প্রকৃত বাজার চাহিদার তুলনায় তা খুবই সীমিত রয়ে গেছে। চট্টগ্রামের শিল্পে উৎপাদিত অল্প কিছু পণ্য যাচ্ছে ত্রিপুরা, মিজোরাম প্রদেশ হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারত এবং টেকনাফ হয়ে মিয়ানমারে। আর দক্ষিণ চট্টগ্রামের চাষীদের আবাদ করা ক্ষেতের সীমিত সবজি রফতানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে।
অথচ চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমার, ভারত, নেপাল, চীন, ভূটান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের উৎপাদিত মানসম্পন্ন হরেক ধরনের খাদ্যপণ্য, নিত্য ও ভোগ্যপণ্য এবং শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত সামগ্রীর চাহিদা অনেক ব্যাপক, বিস্তৃত পরিসরে রয়ে গেছে। চেম্বারসহ ব্যবসায়ী সংগঠনসমূহ, কূটনৈতিক মিশন, রফতানি-সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যকার মূলত পারস্পরিক যোগাযোগ সমন্বয়হীনতার কারণেই সীমিত রফতানি বাজার থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অভিজ্ঞ বাজার পর্যবেক্ষকরা এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া সুদূর ইউরোপ-আমেরিকা-আফ্রিকার দেশগুলোতে যতটা গুরুত্ব দিয়ে বেশিহারে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিনিধি দল ঘন ঘন সফর করে থাকে সেই তুলনায় প্রতিবেশী দেশসমূহের দিকে যেন ফিরে তাকানোর সময়ই মিলছে না। যা অনেকটা বলতে গেলে ‘বাড়ীর কাছে আরশীনগর সেথা এক পড়শী বসত করে- আমি একদিনও না দেখিলাম তারে’।       
বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন দিকজুড়েই রয়েছে বিস্তীর্ণ বাজার সুবিধা নিয়ে সুবিশাল পশ্চাদভূমি। চট্টগ্রামে দেশের প্রধান বন্দর হচ্ছে ব্যাপক রফতানি বাজারের গেটওয়ে। অথচ সময়োচিত উদ্যোগ আর সমন্বয়ের অভাবেই বছরে হাজার কোটি টাকা মূল্যের অন্তত ৫০ ধরনের ভোগ্যপণ্য, সেবাখাতের পণ্য, শিল্প-কারখানা ও কৃষি-খামারের পণ্যসামগ্রী রফতানির সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে আছে। অবারিত এই পশ্চাদভূমিতে পণ্য রফতানির একচেটিয়া সুযোগ গ্রহণ করছে ভারত ও চীন। তবে ভারতের বিশেষত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের উৎপাদিত অনেক পণ্যসামগ্রীর ব্যাপক ভোক্তা চাহিদা বা কদর থাকলেও দেশটির শুল্ক ও অশুল্ক (ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ) বাধার কারণে রফতানি আটকে আছে।  
এদিকে নিকটতম প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে পণ্যসামগ্রী আমদানি ও রফতানি করা হচ্ছে অনেক দীর্ঘ ঘুরপথে সিঙ্গাপুর বন্দরের মাধ্যমে। অথচ দেশটির ইয়াঙ্গুন ও আকিয়াব (সিটুই) সমুদ্র বন্দরের সাথে সরাসরি নৌ চলাচলের জন্য ‘কোস্টাল এন্ড মেরিটাইম শিপিং’ এবং ‘নন-কনভেনশনাল ভেসেল শিপিং’ চুক্তি নবায়ন ও সম্পাদন করা হলে বাংলাদেশে উৎপাদিত অনেক পণ্যসামগ্রীর বাজার স¤প্রসারণ ঘটবে নিশ্চিতভাবেই। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনুন্নত ৭টি রাজ্য (দি সেভেন সিস্টার), নেপাল, চীন ও  ভূটানেও ব্যাপক পরিসরে পণ্যসামগ্রী রফতানির চাহিদা প্রস্তুত হয়েই আছে। নিকট প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের মানসম্পন্ন পণ্যসামগ্রী ও সেবাপণ্য অনেকটা সুলভে ক্রয়-বিক্রয় সেসব দেশের ভোক্তাসাধারণের জন্য সহজতর এবং তাদের মাঝে স্থায়ী বাজার চাহিদা তৈরির সুযোগ রয়েছে অবারিত। সময়োচিত উদ্যোগের মাধ্যমে তা কাজে লাগানো হলে অধিকহারে রফতানিতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক কর্মকান্ড আরো বিস্তার লাভ করবে।
চট্টগ্রামের রফতানিকারক-ব্যবসায়ীরা জানান, সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে প্রতিবেশী অঞ্চলগুলোর ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের আগ্রহ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ ও পেটেন্ট সামগ্রী, ভেষজ দ্রব্য, শাড়ী, লুঙ্গি, বস্ত্র ও তৈরি পোশাক, ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক পণ্যসামগ্রী, আইটি সামগ্রী, লেদার পণ্য, পাটজাত সামগ্রী, হস্ত ও কূটির শিল্পপণ্য, সিরামিকস পণ্য, প্লাস্টিক দ্রব্যাদি, আসবাবপত্র, কৃত্রিম অলংকার-গহনা, আসবাবপত্র, সিমেন্ট, হরেক রাসায়নিক দ্রব্য, হালকা ও মাঝারি আকৃতির কার্গো কোস্টার নৌযান, হালকা যন্ত্রপাতি, কেবলস, লোহা ও স্টিলস সামগ্রী, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও বেকার্স খাদ্যদ্রব্য, খেলনা প্রভৃতি পণ্যের ব্যাপক ভোক্তা চাহিদা প্রতিবেশী অঞ্চলসমূহে রয়েছে। এ অঞ্চলে আন্তঃবাণিজ্য প্রসারে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। এরজন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের যুগোপযোগী আধুনিকায়ন বিশেষত বে-টার্মিনাল নির্মাণ কাজ দ্রæত শুরু করা, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার-ঘুনধুম পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ সম্পন্ন করা, আঞ্চলিক নৌ-বন্দরসমূহেরর সাথে পণ্যসামগ্রী পরিবহন নেটওয়ার্কের উন্নয়ন অপরিহার্য। তাহলেই শিপিং ও পরিবহন খাতে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুলে যাবে।      
এ প্রসঙ্গে চিটাগাং চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, আঞ্চলিক বাণিজ্য জোরদার করা হলে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর আঞ্চলিক গুরুত্ব সহকারে ‘হাব পোর্ট’ হয়ে উঠবে। চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, চীন, ভূটান এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অনেক ধরনের পণ্য রফতানির সুযোগ রয়েছে। সেখানে আমাদের মানসম্পন্ন অনেক পণ্যের কদর রয়েছে। তাই বিশাল বাজার সম্ভাবনাও রয়েছে। একে পরিকল্পিতভাবেই জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
পোর্ট-শিপিং সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বন্দর সম্পদই সর্ববৃহৎ একটি সম্পদ। সমুদ্র বন্দরের রয়েছে বিশাল হিন্টারল্যান্ড অর্থাৎ পশ্চাদভূমি। ভারত ও চীনের একাংশ, ভূটান, নেপাল নিয়ে এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বিশাল ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ডলক্ড) অঞ্চল। দেশ ও জাতির ভাগ্যেন্নয়নে বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ধারক এবং প্রবেশদ্বার হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। বর্তমানে বন্দর বা অনুকূল প্রাকৃতিক সুবিধাসম্পন্ন পোতাশ্রয়ের আংশিক কাজে লাগানো হচ্ছে। এ কারণে এগিয়ে যেতে পারছে না দেশ। অথচ চট্টগ্রাম জেলার সমান ছোট্ট একটি দেশ, এককালের ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠির জেলেপল্লী উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গিয়ে হয়েছে আজকের সিঙ্গাপুর মহা-সমুদ্রবন্দর বা মাদার ট্রানজিশনাল পোর্ট। বন্দর-সম্পদের ধারক দেশ হিসেবে সেই মহাসুযোগ বাংলাদেশেরও হাতের মুঠোয়। বন্দর-সম্পদকে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করলে দেশ ও জাতি নিশ্চিতভাবে লাভবান হবে। লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে।   
উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘দ্য সেভেন সিস্টার’ হিসেবে পরিচিত ৭টি রাজ্য বিশেষত ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম, মনিপুর, নাগাল্যাান্ড এবং নেপাল ও ভূটান, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশসহ দক্ষিণ-পশ্চিম মিয়ানমার, কুনমিং প্রদেশসহ দক্ষিণ চীন মিলিয়ে বিরাট এক অঞ্চলের জন্য চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ‘আঞ্চলিক হাব-পোর্ট’ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এরজন্য সড়ক, রেল ও নৌপথ সংস্কারসহ কিছু অবকাঠামো সুবিধা প্রসারিত করা অপরিহার্য। প্রস্তাবিত বে-টার্মিনাল নির্মিত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো সুবিধা তথা সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের তিনদিকে স্থলপথ ও নৌপথে পণ্য রফতানির তুলনায় চোরাচালান হচ্ছে দেদারছে। হরেক চোরাচালানের পণ্যে বাজার সয়লাব। ভারত, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড থেকে চোরাপথে কাপড়, জুতো-স্যান্ডেল, ছাতা, আচার, ব্যাগ থেকে শুরু করে হরেক রকম ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স, ভোগ্যপণ্য, গৃহস্থালী পণ্যসামগ্রী বাজারে হু হু করে ঢুকে পড়ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রফতানি

৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ