Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পানির জন্য কৃষকের হাহাকার

প্রকাশের সময় : ৬ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা/সাইদুল বিশ্বাস : নদীগুলো এখন পানিশুন্য। পানি না থাকায় চলতি মৌসুমে কৃষক সেচের জন্য পানি পাচ্ছে না। খাল-বিলের অবস্থা আরও করুণ। চৈত্র মাস শুরু না হতেই খাল-বিলের মাটি ফেটে চৌচির। পানি নিয়ে কৃষকের মাঝে চলছে হাহাকার। ভারতের সাথে ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি থাকলেও শর্ত অনুযায়ী পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এই শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রাপ্তির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ফলে সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক পানিও বাংলাদেশের ভাগ্যে জুটছে না।
পানি কম পাওয়া নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চিঠির মাধমে ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবাদও জানানো হয়েছে। জবাবে ভারত সাফ জানিয়ে দিয়েছেÑ উজানে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় তাদের পক্ষে এর চেয়ে বেশি পানি দেয়া সম্ভব নয়। ভারতের এমন জবাবে সন্তুষ্ট নয় বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, গঙ্গা চুক্তির ৮ নম্বর ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হচ্ছেÑ প্রয়োজনে পানির প্রবাহে বাড়াতে উভয় দেশ মিলে পদক্ষেপ নেবে। এক্ষেত্রে নেপালের কুশি ও গন্ধকী নদীতে জলাধার নির্মাণ করে গঙ্গায় পানি প্রবাহ বাড়ানোর একাধিক প্রস্তাব বাংলাদেশ দিয়েছে। কিন্তু ভারত নেপালে জলাধার নির্মাণে বাংলাদেশকে সাথে নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক নয়Ñ এ বিষয়টি আগেই জানিয়ে দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে গঙ্গার ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ বৃদ্ধির একমাত্র পন্থা হচ্ছে বৃষ্টিপাত। বাংলাদেশের মানুষ বৃষ্টির জন্য চাতক পাখীর মত তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। দেশের অনেক এলাকায় বৃষ্টির গান কৃষকের গলায় ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে....’। পানির অভাবে পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর মত তিস্তার অবস্থাও খুবই করুণ। পানি না পাওয়ায় মহুরি সেচ প্রকল্প, মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প, জিকে সেচ প্রকল্প, রাজশাহী সেচ প্রকল্প, তিস্তা সেচ প্রকল্প’র সিংহ ভাগ জমি সেচের আওতায় নেয়া সম্ভব হয়নি। অনেক সেচ প্রকল্পে রেশনিং করে পানি দেয়া হচ্ছে। পানি জন্য চলছে কৃষকের হাহাকার। বৃষ্টির দেখা না মিললে এবার বোরো আবাদ মার খাওয়ার আশঙ্কা কৃষকের মনে। আর কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কৃষক জমিতে ঠিকমত সেচের পানি না পেলে চলতি বোরো মৌসুমে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম।
অন্যদিকে, তিস্তার পানি এই শুষ্ক মৌসুমে এতটাই কমে গেছে যে, গতকাল শনিবার পানির প্রবাহ ছিল ৪শ’ কিউসেক। এই প্রবাহ আরও কমে যেগে পারে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়ায় কর্মরত নির্বাহী প্রকৌশলী জানান। তার মতে, তিস্তা সেচ প্রকল্পে পানির অভাবে আবাদি জমির পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
সরকার তিস্তার নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সাথে সব ধরনের আলোচনাই চালিয়ে গেছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যনার্জির কারণে এই তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটি চুক্তিতে উপণিত হওয়া সম্ভব হয়নি। এ ব্যপারে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছেন, তিস্তা চুক্তি সই নিয়ে খসড়া তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার। তাই এ বিষয়ে নতুন করে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী নয় বাংলাদেশ। তিনি আরও বলেন, তিস্তা চুক্তি সই নিয়ে বল এখন ভারতের কোর্টে। চুক্তি নিয়ে ইতিমধ্যে একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। চুক্তিটি নিয়ে নতুন করে কোনো আলোচনা হবে না। ওই খসড়ার ভিত্তিতেই দ্রুত চুক্তি সই হবে বলে আমরা আশা করছি।
এদিকে বছরের পর বছর পলি জমে ভরাট হয়ে সংঙ্কুচিত হচ্ছে বিল নদীর আয়তন। অন্যদিকে, শুষ্ক মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের দুই শতাধিক নদী, শাখা নদী, উপনদী ও সহস্রাধিক বিল ভরাট হয়ে আবাদী জমিতে পরিণত হচ্ছে। এতে নদী-বিলনির্ভর প্রায় পাঁচ লাখ হেক্টর বোরোর জমিতে সেচ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিল নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বিলুপ্তির পথে এ অঞ্চলের দেশি প্রজাতির মাছ।
মৎস বিভাগ সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের এক সময়ের খড়স্রোতা নন্দকুজা, ভদ্রাবতী, সরস্বতী, ইছামতি, গুমানী, আত্রাই, গুড়নদী, করতোয়া, ফুলঝোর, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, ঝরঝরিয়া, কাকন, কানেশ্বরী, মুক্তাহার, কাকেশ্বরী, সুতিখালি, গোহালা, গাড়াদহ, স্বতী, ভেটেশ্বর, ধরলা, দুধকুমার, সানিয়াজান, তিস্তা, ঘাঘট, ছোটযমুনা, নীলকুমার, বাঙালী, বড়াই, মানস, কুমলাই, সোনাভরা, হলহলিয়া, জিঞ্জিরাম, বুড়িতিস্তা, যমুনেশ্বরী, মহানন্দা, টাঙ্গান, কুমারী, রতœাই, পুনর্ভবা, ত্রিমোহনী, তালমা, ঢেপা, কুরুম, কুলফি, বালাম, ভেরসা, ঘোড়ামারা, মালদহ, চারালকাঁটা, পিছলাসহ দুই শতাধিক নদী, শাখা নদী ও উপনদী  নব্যতা হারিয়ে মরা নদীতে রূপান্তরিত হয়েছে।
এছাড়া পাবনা, নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী জেলার ঘুঘুদহ বিল, গাজনার বিল, শিকর বিল, কাজলকুড়ার বিলসহ সহস্রাধিক বিল শুকিয়ে জেগে উঠেছে সমতল ভূমি। এক সময় এসব বিলে সারা বছরই পানি থাকতো। আর এখন বছরের নয় মাসই পানি থাকে না। ফলে কৃষকরা নানা রকম ফসলের আবাদ করছেন। কুড়িগ্রামের ১৮২টি বিলের মধ্যে দীঘলাছড়ার বিল, বোছাগাড়ীর বিল, ইউসুফ খাঁর বিল, নাওখোয়া বিল, চুবাছরির বিল, কুশ্বার বিল, মেরমেরিয়ার বিল, চাছিয়ার বিল, হবিছরি বিল, পেদিখাওয়া বিল, কয়রার বিলসহ বেশিরভাগ বিলে ফসলের আবাদ হচ্ছে। অন্য বিলগুলোতে বছরের আট মাসের বেশি সময় পানি থাকে না। দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট জেলার বিলগুলোর একই অবস্থা। চলনবিলে এক হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে বেঁচে আছে ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে মাত্র ৮৬ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সারা বছর পানি থাকে। পানি সরে গেলে বিলগুলো ফসলী জমিতে রূপান্তরিত হয়।
নদী-বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় পাঁচ লাখ হেক্টর বোরোর জমিতে সেচ ব্যাহত হচ্ছে। কৃষিকাজ হয়ে পড়েছে গভীর-অগভীর নলকূপনির্ভর। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। খনন ও সংস্কারের অভাব, অপরিকল্পিত রক্ষণাবেক্ষণ, বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ ও বিল রক্ষায় পর্যাপ্ত উদ্যোগ না নেয়ায় উত্তরাঞ্চল থেকে নদী বিলের অস্তিত্ব এক এক করে মুছে যাচ্ছে। শুষ্ক মওসুমে নদী বিল শুকিয়ে জেগে ওঠেছে দিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠ। কৃষকরা মাঠে ধান, পাট, সরিষা, রসুন, পেঁয়াজসহ নানা প্রকারের ফসল আবাদ করছেন।
রাজশাহী ও রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলে দুই শতাধিক নদী ও সহস্রাধিক বিল শুকিয়ে যাওয়ায় ভূ-উপরিস্থ পানির অভাবে প্রায় ১২ লাখ হেক্টর এক ফসলী জমি তিন ফসলীতে পরিণত করা সম্ভব হচ্ছে না। এরমধ্যে পাবনা জেলায় এক লাখ ৩৪ হাজার হেক্টর, সিরাজগঞ্জে ৯১ হাজার হেক্টর, রাজশাহী জেলায় ৯০ হাজার হেক্টর, নওগাঁ জেলায় এক লাখ ২০ হাজার হেক্টর, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৮৭ হাজার হেক্টর, নাটোর জেলায় ৬৬ হাজার হেক্টর, বগুড়া জেলায় ৩১ হাজার হেক্টর, জয়পুরহাট জেলায় ১৪ হাজার হেক্টর, গাইবান্ধায় ৬৯ হাজার হেক্টর, রংপুর জেলায় ৬৭ হাজার হেক্টর, নীলফামারী জেলায় ৬৭ হাজার হেক্টর, লালমনিরহাট জেলায় ৫১ হাজার হেক্টর, কুড়িগ্রাম জেলায় এক লাখ হেক্টর, দিনাজপুর জেলায় এক লাখ ২৫ হাজার হেক্টর, ঠাকুরগাঁও জেলায় ৬৩ হাজার হেক্টর এবং পঞ্চগড় জেলায় ৭৯ হাজার হেক্টর এক ফসলী জমি সেচের পানির অভাবে তিন ফসলীতে রূপান্তর করা যাচ্ছে না।
বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা সমতার এক জরিপ প্রতিবেদনে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে বিলের সংখ্যা এক হাজার ৫৬১টি। এরমধ্যে সহস্রাধিক বিলের অস্তিত্ব হুমকীর মুখে পড়েছে। পলি জমে বিলের মুখ ভরাট হয়ে যাওয়া এবং পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময় এসব বিল শুকনা থাকে। বছরের পর বছর বিলগুলোতে পলি জমছে। গভীরতা হৃাস পাচ্ছে। পরিণত হচ্ছে নিচু সমতল ভূমিতে। দীর্ঘদিন সংস্কার ও খননের উদ্যোগ না নেয়ায় বিলের পানির নির্দিষ্ট ধারাটিও হারিয়ে যাচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মোঃ রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ২৬ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ১৬টি নদী, ৩৯টি বিল ও ২২টি খাড়িতে বছরজুড়েই ৬ থেকে ১২ ফুট পানির গভীরতা থাকতো। ফলে সারা বছরই নৌচলাচল করতো। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী, বিল ও খাড়ি ভরাট হয়ে গেছে।
ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ, ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে এবং ১৯৮০-এর দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়ালের (পদ্মা) উৎসমুখে সøুইসগেট নির্মাণের ফলে চলনবিলের বিভিন্ন নদী বিল জলাশয় ও খাড়িগুলোয় পলি জমে ক্রমে ভরাট হয়ে গেছে। তাছাড়া বিলের মাঝ দিয়ে যথেচ্ছভাবে সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, ভূমি দখল করে বসতি ও দোকাপাট স্থাপন করায় নদী, বিল ও খাড়িগুলো সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পানির জন্য কৃষকের হাহাকার
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ