Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাহাজ চলাচলে ঝুঁকি

| প্রকাশের সময় : ১৭ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রাম বন্দরে তলদেশে ৪৬ নৌ-যান : জমছে পলি-বালি : নেই প্রযুক্তি : কর্তৃপক্ষের উদ্ধার অভিযান ব্যয়বহুল

শফিউল আলম : চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল, চ্যানেলের মুখে ও বহির্নোঙ্গরের তলদেশে ডুবে আছে অন্তত ৪৬টি লাইটারেজ কার্গোজাহাজ কোস্টার নৌযান ও জাহাজের র‌্যাক (ভগ্নাংশ)। বন্দরে স্বাভাবিক জাহাজ চলাচলে প্রতিনিয়তই ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে নিমজ্জিত এসব জাহাজ, কোস্টার বা নৌযান। তলদেশের বিভিন্ন স্থানে ইতস্তত-বিক্ষিপ্তভাবে ডুবে থাকা জাহাজ-নৌযানগুলোকে ঘিরে অবিরাম জমছে পলি-বালি, জঞ্জাল। এতে করে বন্দরের নাব্যতা ব্যাহত হচ্ছে। তলদেশে পড়ে থাকা এসব জাহাজ, নৌযান, র‌্যাকের সাথে কোনো কোনো সময় তলায় ধাক্কা লেগে ফের জাহাজ দুর্ঘটনাও ঘটছে। এদিকে নিমজ্জিত কার্গো জাহাজসমূহ উদ্ধারের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন বৃহাদাকার টাগ-জাহাজ নেই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। তাছাড়া সিঙ্গাপুর থেকে অথবা অন্যকোনো দেশের সক্ষমতা সম্পন্ন বিদেশি স্যালভেজ প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করে তলদেশের এসব জাহাজ উদ্ধার প্রক্রিয়া জটিল ও ব্যয়বহুল বলে জানায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে লাইটার কার্গোজাহাজ-নৌযানগুলো যেসব স্থানে ডুবেছে তা এড়িয়ে জাহাজ চলাচলের জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছে কর্তৃপক্ষ। সেই সাথে বিভিন্ন স্থান চিহ্নিত করে মার্কিং বয়া স্থাপন করা হয়েছে।    
এদিকে প্রধান সমুদ্র বন্দরের নিজস্ব বড় আকারের টাগ না থাকা এবং বিদেশি স্যালভেজ প্রতিষ্ঠানকে এনে উদ্ধার ব্যয় বেশি হওয়া- উভয় কারণে নিমজ্জিত জাহাজ-কোস্টারগুলো অপসারনের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে। তলদেশে পড়ে থাকা জাহাজগুলো অপসারনে আগে বিভিন্ন ধরনের ‘ফর্মুলা’র কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এর কোনটিই বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমানে এ বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও নৌ-পরিবহন দপ্তর অনেকটা নির্বিকার। সিদ্ধান্তহীনতায় উদ্ধার প্রক্রিয়া অনিশ্চিত। নিমজ্জিত ছোট ও মাঝারি আকারের জাহাজ, কোস্টার, নৌযানগুলো অপসারনে যতই সময় গড়াচ্ছে ততই বন্দর নেভিগেশনাল চ্যানেল, বহির্নোঙ্গরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে জাহাজ চলাচলে ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। নিমজ্জিত জাহাজের সাথে তলায় ধাক্কা লেগে মাঝেমধ্যে ছোট-বড় দুর্ঘটনা এমনকি আবারও জাহাজডুবির ঘটনা ঘটছে মাঝেমধ্যে। তাছাড়া নিমজ্জিত এসব জাহাজ, নৌযান, র‌্যাককে ঘিরে তলদেশে অবিরাম পলি-বালি জমে উঠছে। এতে করে চ্যানেলে ও আশপাশে নাব্যতা হ্রাসের আশঙ্কা রয়েছে। আপাতত মার্কিং বয়া দিয়ে নিমজ্জিত এসব জাহাজের কিছু কিছু স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে কোনো কোনোটির পাশে বয়াও দেয়া হয়নি।   
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মোঃ জাফর আলম ইনকিলাবকে বলেন, নিমজ্জিত লাইটার জাহাজ, নৌযান বা র‌্যাকগুলোর কারণে বন্দর চ্যানেলে জাহাজ চলাচলে সমস্যা হচ্ছে না। তাছাড়া এগুলোর উদ্ধার প্রক্রিয়া খুবই ব্যয়বহুল। সেই প্রযুক্তির উদ্ধারকারী জাহাজও বন্দরের নেই। চট্টগ্রাম বন্দরের পরিকল্পনা অনুসারে বে-টার্মিনাল নির্মিত হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো সমস্যাও হবে না। বর্তমান অবস্থায় তলদেশে থাকা জাহাজ, র‌্যাকের স্থানগুলো এড়িয়ে জাহাজ চলাচলই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তা করা হচ্ছে। তাছাড়া অনেক স্থানে বয়া দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। নিমজ্জিত এসব জাহাজের সাথে তলায় ধাক্কা লেগে ফের দুর্ঘটনা বা জাহাজডুবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাহাজের মাস্টারের ভুলে ও অদক্ষতার কারণে এমনটি হয়েছে।   
এদিকে নিমজ্জিত লাইটার জাহাজ, নৌযানগুলো অপসারনে বন্দর ছাড়াও দেশীয় অন্য কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেনি। তবে ডুবে থাকা এসব জাহাজের স্ক্র্যাপমূল্য থাকার ফলে ইতোপূর্বে ভিন্ন আরেকটি ‘ফর্মুলা’য় বন্দর কর্তৃপক্ষ উদ্ধারের পরিকল্পনা করেছিল। তা হলো দেশীয় ছোট ছোট স্যালভেজ প্রতিষ্ঠানগুলোকে একযোগে কাজে লাগিয়ে উদ্ধার কাজ ভাগাভাগির ভিত্তিতে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়। এক পর্যায়ে স্থানীয় নৌযান উদ্ধারকারী (স্যালভেজ) বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছ থেকে আবেদনপত্র গ্রহণ শুরু হলেও এ প্রক্রিয়া মাঝপথে থমকে যায়। এর আগে নিমজ্জিত জাহাজগুলো অধিগ্রহণ করে দরপত্রের মাধ্যমেও অপসারনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তাও বেশিদূর অগ্রসর হয়নি।  
চট্টগ্রাম বন্দরের নেভিগেশন চ্যানেল, রিভার মাউথ ও বহির্নোঙরের কাছাকাছি স্বাভাবিক জাহাজ চলাচলের পথে বাধা হয়ে আছে ছোট ও মাঝারি আকারের অন্তত ৪৬টি কার্গোজাহাজ, কোস্টার, ট্রলার, নৌযান ও জাহাজের ভাঙ্গা র‌্যাক। এরমধ্যে ৩৬টি নিমজ্জিত হয় গত দেড় দশকের মধ্যে। এর কোনো কোনোটি জোয়ারের সময় অধিকাংশ কিংবা পুরোপুরি ডুবে থাকে, ফের ভাটার সময় জেগে উঠে। মেরিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব জাহাজ, নৌযানের কারণে সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচলে সবসময়ই সতর্কতা অনুসরণ করা হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আপত্তি আসতে পারে আন্তর্জাতিক শিপিং সংগঠন-সমিতির কাছ থেকেও। এতে করে দেশের প্রধান বন্দরের সুনাম ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। এরজন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বা পরিকল্পনা নিয়ে নিমজ্জিত জাহাজ, নৌযান, র‌্যাকগুলো উদ্ধার করা অপরিহার্য। তাছাড়া আর নতুন করে কোনো জাহাজ যাতে ডুবতে না পারে সে বিষয়ে চুড়ান্ত সতর্কতার পাশাপাশি কোনো জাহাজ দুর্ঘটনা কবলিত হওয়ার সাথে সাথেই উদ্ধার প্রক্রিয়ার জন্য যুগোপযোগী আধুনিক প্রযুক্তির টাগ-জাহাজ বন্দরের সংগ্রহ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ চলাচল জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভরশীল। বন্দরের মূল চ্যানেল ও এর ধারেকাছে বহির্নোঙর ও উপকূলভাগে কোস্টার, কার্গোজাহাজ, ট্যাংকার, ট্রলারসহ বিভিন্ন নৌযান ডুবির ঘটনায় সেসব জাহাজ-নৌযানের চারপাশে স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘিœত হচ্ছে। ধীরে ধীরে পলি-বালি পাতন, সঞ্চয়ন বাড়ছে। সংকুচিত হচ্ছে নাব্যতা। এরজন্য সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচলে কম-বেশি ঝুঁকি পোহাতে হচ্ছে।
নৌ প্রকৌশলীরা জানান, বিভিন্ন পয়েন্টে তলদেশে পড়ে থাকা এসব জাহাজ নৌযানের ফুয়েল ট্যাংকারে ভর্তি রয়েছে জ্বালানি তেল। যা পর্যায়ক্রমে গ্যাসীয় তীব্র চাপ সৃষ্টি করছে। তলদেশে এসব ডেড ভেসেলে ঘটছে বিক্রিয়া। এরফলে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য দুর্ঘটনার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। অন্যদিকে বন্দর কিংবা বন্দরের কাছাকাছি স্পর্শকাতর এলাকায় জাহাজ ডুবে গেলে জাহাজের মালিকের মাধ্যমে তা সম্ভাব্য দ্রুত সময়ে অপসারন নিশ্চিত করার বিষয়ে দেশে কঠোর কোন আইনি বিধি-বিধান অনুপস্থিত। অথচ প্রতিবেশী দেশসহ উন্নত বিশ্বের সমুদ্র বন্দরগুলোতে জাহাজ, নৌযান নিমজ্জিত হওয়ার সাথে সাথেই উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করে নৌ চ্যানেল কিংবা আউটার চ্যানেল পরিস্কার করে দেয়া হয়। এটি সবসময়ই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। কিন্তু দেশে বন্দর ও শিপিং বিভাগ নোটিশ জারি করেই দায়িত্ব শেষ। অনায়াসে পার পেয়ে যাচ্ছে মালিকরা। নিমজ্জিত জাহাজ উদ্ধারে যে পরিমান খরচ পড়ে সেই তুলনায় উদ্ধারের পর আর্থিক মূল্য কম হওয়ার কারণেই মূলত মালিক পক্ষ উদ্ধার কাজে অনীহা দেখায়।



 

Show all comments
  • মোঃ আব্দুল গাফফার ১৭ মে, ২০১৭, ১১:৩৭ এএম says : 0
    জাহাজ ডুবে চ্যানেল বন্ধই বা কেন হবে আর জাহাজ মালিকরাই বা জাহাজ উদ্ধারে কেন অমনোযোগী হবেন? নিশ্চয় আর্থিক হিসাব নিকাশটাই এখানে মূখ্য ব্যাপার, কিন্তু তার জন্য তো ইন্সুরেন্স আছে, তাই না? জাহাজগুলো ইন্সুরেন্স ছাড়া নিশ্চয় চলে না? আর যে সব ইন্সুরেন্স কোম্পানীর ইন্সুরেন্সে এসব চলে তারা তো আর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়নি? ডুবে যাওয়া জাহাজগুলোর যদি ইন্সুরেন্স থেকে থাকে তাহলে তাদের সহায়তায় বা দাবী অনুযায়ী মালিকরা এসব অনায়াসে তুলতে পারেন। আর যদি ইন্সুরেন্স ছাড়াই ওসব চলাচল করে থাকে তাহলে তো আর কারো কিছু বলার নেই
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাহাজ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ