Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজনীতিতে বইছে ওয়ান-ইলেভেন ঝড় : চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫৭ পিএম, ৪ মার্চ, ২০১৬

তারেক সালমান : ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের বিচারের দাবিতে রাজনীতির মাঠ এখন উত্তপ্ত। ওই সময় রাজনীতিবিদদের চরিত্রহনন তথা বিরাজনীতিকরণের ষড়যন্ত্রে কারা জড়িত ছিল এ নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। দেশের দুই শীর্ষ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এক-এগারোর স্মৃতি নিয়ে মুখ খুলেছেন। এ ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে পরস্পর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ওয়ান-ইলেভেনের জন্য দুটি পত্রিকার সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অনেক প্রতিনিধি দায়ী বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট রাজনীতিবিদরাই তৈরি করেছেন বলে দাবি করছেন। আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ওয়ান-ইলেভেনের সুফল বর্তমান সরকার ভোগ করছে, তাই এ জন্য ক্ষমতাসীনরাই দায়ী বলে অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনার সঙ্গে তার দলের নেতা বর্তমান পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জড়িত বলে সরাসরি অভিযোগ করে তার বিচার দাবি করেছেন।
দীর্ঘ সাত বছর পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হঠাৎ করে ওয়ান-ইলেভেনকে কেন্দ্র করে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। এই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের সরল স্বীকারোক্তিকে কেন্দ্র করে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে টক শো’তে তিনি বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে ডিজিএফআই থেকে পাঠানো সংবাদ ডেইলি স্টারে প্রকাশের ক্ষেত্রে আরও যাচাই-বাছাই করা উচিত ছিল। যাচাই-বাছাই না করে ওইসব রিপোর্ট ছাপানোটা ছিল তার সম্পাদকীয় নীতির ভুল। এ ধরনের বক্তব্যের পরই প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তার ফেসবুক পেজে ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিচার দাবি করে স্ট্যাটাস দেন। এর পরই দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলা দায়ের হয়।
মাহফুজ আনামের বক্তব্যের পর জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনের সমাপনী দিবসে ও গত ২২ ফেব্রুয়ারি মহান একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাকে আর খালেদা জিয়াকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন দুই সম্পাদক।’
শেখ হাসিনা বলেন, এই দুটি পত্রিকা সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের সময় ডিজিএফআইয়ের লিখে দেয়া মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে রাজনীতি থেকে আমাকে এবং খালেদা জিয়াকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। আর ডেইলি স্টার সম্পাদক আমাকে দুর্নীতিবাজ বানানোর বহু চেষ্টা করেছেন। তিনি তা স্বীকারও করেছেন। কিন্তু তাদের পিতৃতুল্য বিশ্বব্যাংকও দুর্নীতিবাজ বানাতে পারেনি। আসলে সত্য কখনও চাপা থাকে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সংসদে দেয়া বক্তব্যে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূস, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, তারা এখনও ষড়যন্ত্র করছে। তারা বসে আছে গণতন্ত্রকে ধরাশায়ী করতে। তাদের ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। তারা আশায় আছে অসাংবিধানিক পন্থায় কেউ আসবে। কিন্তু বাংলাদেশে আল্লাহর রহমতে তা হবে না। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যে যতই ষড়যন্ত্র করুক বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কেউ রোধ করতে পারবে না।
ড. ইউনূসকে ইঙ্গিত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই ভদ্রলোককে আমিই মোবাইল ফোনের ব্যবসা করতে দিয়েছিলাম। ব্যাংকের এমডি পদ আইন লঙ্ঘন করে ১০ বছর পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন। আইন লঙ্ঘন করলেন, মামলায় হারলেন, আর সব দোষ শেখ হাসিনার। এমডি পদ হারানোর ক্ষোভ পড়ল গিয়ে পদ্মা সেতুর ওপর। আমেরিকার বন্ধুকে দিয়ে অর্থ বন্ধ করালেন।
মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনামকে ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জে. আমিন ও ব্রিগেডিয়ার বারীর স্টাফ আখ্যায়তি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাকে দুর্নীতিবাজ বানাতে তার পত্রিকা যতকিছু লিখেছে সেগুলো নাকি ডিজিএফআই সাপ্লাই দিয়েছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে লেখা থাকে নির্ভীক সাংবাদিকতা। আলোর কথা বলে অন্ধকারের কাজ করে। এই দুটো পত্রিকা হয় ডিজিএফআইয়ের এজেন্ট হয়ে কাজ করেছে নতুবা মাইনাস টু ফর্মুলার সঙ্গে জড়িত ছিল। ষড়যন্ত্রে লিপ্ত না থাকলে অসত্য সংবাদ ছাপাবে কেন? ব্রিগেডিয়ার আমিন ও বারীর চোখের আলো হয়ে ছিল ওই দুটি পত্রিকা। তাদের কাজই হলো দেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতায় আসুক। এরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না।
তিনি বলেন, রাজনীতি করতে চাইলে, ক্ষমতায় যেতে চাইলে তারা রাস্তায় নামুক, জনগণের কাছে যাক। রাজনীতি করার এত শখ, ক্ষমতায় যাওয়ার এত শখ থাকলে মানুষের ভোট নিয়ে আসুক।
এদিকে, দীর্ঘদিন চুপ করে থাকার পর প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সম্প্রতি এ বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি দুর্যোগে পড়া দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। গত ১ মার্চ মঙ্গলবার গুলশানে নিজের কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে তিনি সেই ষড়যন্ত্রের বিচারের উদ্যোগ কেন নিচ্ছেন না Ñ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সেই প্রশ্ন রেখেছেন।
জরুরি অবস্থার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতোই কারাবন্দি ছিলেন তৎকালীন সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য ধরে খালেদা জিয়া বলেন, আমি বলব, তাদের (সরকার) যদি সততা থাকে, সত্যি যদি উনি (প্রধানমন্ত্রী) এটা মিন করে থাকেন, তাদের ধরে দেখিয়ে দেবেন, প্রমাণ করে দেবেন, উনি (প্রধানমন্ত্রী) এটা মিন করছেন, সত্যি বলছেন।
ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার একদিন হবে Ñ শেখ হাসিনার এ বক্তব্যে সন্দেহ প্রকাশ করে খালেদা জিয়া বলেন, উনি (প্রধানমন্ত্রী) নিজে বলেছেন, মাইনাস টু ফর্মুলা। আমরা যদি একসঙ্গে থাকতাম, তাহলে এক-এগারোওয়ালাদের কিচ্ছু করার সাহস ছিল না। এই কেইস-টেইস কারা করেছে, তিনি বলেছেন। মাহফুজ আনাম (ডেইলি স্টার সম্পাদক) না। মাহফুজ আনাম তো স্বীকার করেছেন। তাহলে এখন গুটিকয়েক তো দেশেই আছে। তারা কেন এখনও বহাল তবিয়তে আছে? তারা কেন বাইরে আছে?
তিনি বলেন, তখন ডিজিএফআইয়ের প্রধান ছিল রুমি (মেজর জেনারেল সৈয়দ ফাতেমী আহমেদ রুমি), এখন দেশেই আছে। মাসুদ (লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী) তো অস্ট্রেলিয়ায় ছিল। কতবার এক্সটেশন পেয়েছে। কার মাধ্যমে পেয়েছে? এই সরকারের মাধ্যমে। কেন তাকে ধরা হয় না? এখন তো দেশেই আছে। হাসান মাশহুদ চৌধুরী, যিনি অ্যান্টিকরাপশনে ছিল, দেশেই আছে শুনেছি। সে দুর্নীতি দমন কমিশন এসব মামলা করেছে। তাদের কেন ধরা হয় না?
ওয়ান-ইলেভেনে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ‘অবৈধ’ বলার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একমত হলেও ওই সরকারকে ‘সমর্থন’ দেয়ার জন্য শেখ হাসিনাকেও দায়ী করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, তাদের (ফখরুদ্দীন নেতৃত্বাধীন সরকার) শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উনি (শেখ হাসিনা) গিয়েছিলেন। সবাই সব দেখেছেন। উনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের ফসল’। তার মানে উনি এটা (ওয়ান-ইলেভেন) করিয়েছেন। উনি বাদ পড়তে পারেন না। তার অর্থ তিনি (শেখ হাসিনা) গণতন্ত্রকে শেষ করে দিয়ে অবৈধভাবে অগণতান্ত্রিক সরকারের হাত ধরে ক্ষমতায় আসতে চান। যদি অন্যায় না করে থাকি তাহলে কীসের ভয়? তিনি (শেখ হাসিনা) তাদের সঙ্গে কাকুতি-মিনতি করে ১১ মাসে বেরিয়েছেন।
এদিকে, মাহফুজ আনামের বক্তব্যের পর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সামরিক অভ্যুত্থানে উসকানি দিতে সাজানো ও মিথ্যা প্রচারণা চালানোর জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তার গ্রেপ্তার ও বিচার চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। ‘ডিজিএফআইয়ের দেয়া’ ভিত্তিহীন খবর ছাপার কথা স্বীকার মাহফুজ আনামের’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশের পর এর সূত্র ধরে গত ৫ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাত ২টা ১৯ মিনিটে তিনি ফেসবুক স্ট্যাটাসে এ দাবি জানান।
জয় লিখেন, মাহফুজ আনাম, দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক, স্বীকার করেছেন যে তিনি আমার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অপবাদ আরোপ করতেই তার বিরুদ্ধে মিথ্যা দুর্নীতির গল্প ছাপিয়েছিলেন। তিনি সামরিক স্বৈরশাসনের সমর্থনে আমার মাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে এই কাজ করেছিলেন। একটি প্রধান সংবাদপত্রের সম্পাদক সামরিক বিদ্রোহে উসকানি দিতে যে মিথ্যা সাজানো প্রচারণা চালায় তা রাষ্ট্রদ্রোহিতা।
জয় তার স্ট্যাটাসে আরও লেখেন, আমার ব্যক্তিগত মত, তার মিথ্যা গল্পের উসকানি আমার মাকে গ্রেপ্তার করিয়েছে এবং ১১ মাস তিনি জেলে কাটিয়েছেন। আমি বিচার চাই। আমি চাই মাহফুজ আনাম আটক হোক এবং তার রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচার হোক।
এদিকে, সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা ওয়ান-ইলেভেনের সময় কে কী করেছে তা খুঁজে বের করতে একদিকে যেমন তদন্ত কমিশন গঠন করার দাবি জানাচ্ছেন, অন্যদিকে সেই সময়ের ভূমিকা নিয়ে একে অপরের দিকে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের আঙ্গুলও তুলছেন। ওয়ান-ইলেভেনের পটভূমি সৃষ্টির জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, আবার এজন্য সুশীল সমাজও দায়ী বলে অভিযোগ তুলছেন।
এর আগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ওসমানী মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সরকারকে আমরা এক ইঞ্চিও ছাড় দিইনি। আমরা তথাকথিত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসিনি। আমাদের লক্ষ্য ছিল জননেত্রী জেল থেকে বেরিয়ে আসবে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করব এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করব।
সৈয়দ আশরাফ আরও বলেন, অনেকেই আমাদের কাছে এসেছিলেন। বলেছিলেন, আসেন আমরা বিএনপি-আওয়ামী লীগ মিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে উৎখাত করি। আমরা ভয়ংকর এই প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমাদের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনা।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় গ্রন্থাগার মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করেছেন, ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনায় দেশের সুশীল সমাজ জড়িত ছিল। তিনি বলেন, ‘১/১১‘র পেছনে সুশীল সমাজের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। তাদের কারণে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনীতিবিরোধী কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পেরেছিল। রাজনীতিকদের অনেকে সুবিধা নিতেই ওই বিতর্কিত কর্মকা-ে প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছিলেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, এখান (ওয়ান-ইলেভেন) থেকে অনেক কিছু শেখার ছিল। শিক্ষা নিয়েছিল বলেই আওয়ামী লীগ এখন অধিক সংগঠিত। আর বিএনপি এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি বলেই তাদের এই করুণ দশা। আর যেন ১/১১’র মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, তার জন্য শিক্ষা নেয়ার পাশাপাশি সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।
আবার ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত বিশেষ সরকারের সময়ের সুবিধাভোগী সাবেক সেনা শাসক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি গত রবিবার জামালপুরে নিজের দলের কর্মী সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যে বলেন তার দলের নেতা বর্তমান সরকারের মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদও ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনায় জড়িত। মাহমুদ তাকেও সেনা সমর্থিত সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। একই সঙ্গে জোর করে জাতীয় পার্টিও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তিনি তার (মাহমুদের) বিচার দাবি করেন।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রোববার সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম  সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার ঘটনা তদন্তে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে কমিশন গঠনের দাবি তোলেন।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি মেনন বলেন, মাহফুজ আনামের স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে এক-এগারোর শাসনে রাজনীতিবিদদের ওপর কী ধরনের অপপ্রচার চালানো হয়েছিল তা বেরিয়ে এসেছে। আমি বলব কেবল একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নয়, ওয়ান-ইলেভেনের সমস্ত ঘটনা বোঝার জন্য তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এক-এগারোতে কী হয়েছিল, তার তদন্ত হওয়া উচিত। রাশেদ খান মেনন কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। যারা বড় বড় কথা বলেন তাদের মুখোশ উন্মোচন হওয়া উচিত। কারণ নাগিন এখনও নিঃশ্বাস ফেলছে।
জরুরি অবস্থার সময় কারাবন্দি নাসিম সংসদে বলেন, মাহফুজ আনাম এক সাংবাদিক। রাজনীতিবিদ ভুল করলে জেল হয়, সরকারি কর্মচারী ভুল করলে জেল হয়। উনি ভুল করে বললেন, ‘আই অ্যাম সরি’। সরি বলে সব ভুলে গেলেন? যারা নির্যাতিত হয়েছে, তারা সুস্থ হয়ে যাবে? রাজনীতিবিদদের চরিত্র হরণ করা হল। ছাত্রদের হত্যা করা হল। আর উনি সরি বললেন!
এদিকে গত বুধবার রাজধানীর পল্টনে এক আলোচনা সেই সময়ের ষড়যন্ত্রে জড়িত রাজনীতিবিদদের বিচার দাবি করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ। তিনি বলেন, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের তথাকথিত সংস্কারপন্থিরা তখন মনে করেছিল, এই দুই মহিলাকে (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া) সরাতে পারলে তাদের জন্য পোয়াবারো। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন সফল হয়নি। জনগণ ও গণমাধ্যম থেকে তথ্য নিয়ে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে সেই ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার করতে হবে।
এদিকে, ওয়ান-ইলেভেনের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে বর্তমান সরকারের দুই মন্ত্রীও জড়িত অভিযোগ করে তাদেরও বিচার দাবি করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি জাতীয়  প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের দুই নেতা তোফায়েল আহমেদ ও আমির হোসেন আমুর নাম উল্লেখ করে এ অভিযোগ করেন।
অপরদিকে, গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ‘সমসাময়িক গণমাধ্যম’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের’ বিচারে কমিশন গঠনের যে দাবি বিভিন্ন মহল থেকে  উঠেছে, সরকার তা ‘ভেবে’ দেখবে। ইনু বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে যে কমিশনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, এটা সরকার শুনেছে। সরকার পরে এটা ভেবেচিন্তে দেখবে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপি বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা যে চরিত্রেরই হোক না কেন, তারা যে পেশারই হোক না কেন-এই দুষ্টচক্রকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এজন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের নেতৃত্বে একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
তিনি বলেন, মাহফুজ আনাম গংদের বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলার মানুষ আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রাখার জন্য আরও যারা এই দুষ্টচক্রের সদস্য তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। এজন্য একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। এ কমিশনের মধ্য দিয়ে সব অপকর্মকারীদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের বিচারেরও আওতায় এনে দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থকে রক্ষা করতে হবে।
এ ছাড়া এখন প্রায় প্রতিদিন রাতেই বেসরকারী বিভিন্ন চ্যানেলের টকশোতে ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনা নিয়ে চলছে আলোচনা। এসব আলোচনায় অংশ নিয়ে ওই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এ নিয়ে আলোচনা করছেন। ওই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট তৈরীর জন্য রাজনীতিবিদরাই দায়ী বলেছেন। এ ছাড়া সাবেক সেনা কর্মকর্ত ও নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন এ জন্য তদন্ত কমিশন গটনের দাবী করেছেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, অধ্যাপক আসিফ নজরুলসহ আরও অনেকে এর সঙ্গে করা জড়িত তা বের করতে তদন্ত কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। তবে তাদের মতে রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার জন্য ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনা ঘটে ছিল।  
প্রসঙ্গত: ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা গ্রহণ করে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ফখরুদ্দীন আহমেদের সরকার। ২০০৬ সালের শেষভাগে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতা-হানাহানির আপাত অবসান ঘটে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের জরুরি অবস্থা জারির মধ্যে দিয়ে। একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দেন তিনি। বাতিল করা হয় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন। ওই বিশেষ সরকারের প্রধান হিসেবে ফখরুদ্দীন দায়িত্বপালন করলেও পেছন থেকে সকল কলকাঠি তৎকালীন সেনাপ্রধান বর্তমানে নির্বাসিত জীবনযাপনকারী জেনারেল মঈনুদ্দিন আহমেদের হাতে ছিল বলে রাজনীতিবিদদের অভিযোগ।
দেশজুড়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও অর্থনীতির স্বার্থে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই জরুরি অবস্থা কার্যকর হয়। রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকাসহ সব মহানগরী ও জেলা শহরে ঘোষণা করা হয় কারফিউ।
গভীর রাতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ সুগম করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পরদিন সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে নতুন প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ফখরুদ্দীন আহমদ। ‘ওয়ান-ইলেভেনে’র পটপরিবর্তন নানান অস্বস্তির জন্ম দেয় শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। দল ভাঙা-দল গড়ার ‘খেলা’ও ওই সময়ে দেখে জনগণ। ১১ জানুয়ারি ক্ষমতার পালাবদলের পর জরুরি ক্ষমতার আওতায় রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ হয়েছিল। দুর্নীতির মামলায় বহু রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। একপর্যায়ে গ্রেফতার হন শীর্ষ দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া।



 

Show all comments
  • Babu ৫ মার্চ, ২০১৬, ১০:৪৩ এএম says : 0
    হঠাৎ করে কেন ১/১১ নিয়ে এতো হৈচৈ শুরু করলেন তাও আবার যারা কিনা এটার বেনিফিশিয়ারি
    Total Reply(0) Reply
  • ম।আব্দুল ওয়াদুদ ভুইয়া ৫ মার্চ, ২০১৬, ১১:১৩ এএম says : 0
    সকল অপরাদের সুস্থ বিচার সকল সময়ের দাবি ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজনীতিতে বইছে ওয়ান-ইলেভেন ঝড় : চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ