Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বিশ্ব পর্যটনের দুয়ার উন্মুক্ত

কক্সবাজার-টেকনাফ ৮০ কি.মি. মেরিন ড্রাইভ সড়ক

| প্রকাশের সময় : ৮ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের আশা


শামসুল হক শারেক, কক্সবাজার অফিস : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৬ মে কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ সড়কের উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন। এতে করে পর্যটন শহর কক্সবাজারের সাথে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হল সাগর-পাহাড় বেষ্টিত আরো ৮০ কিমি পর্যটন এলাকা। সেনাবাহিনীর তত্ত¡াধানে নির্মিত উন্নত এই সড়ক যেন খুলে দিল অপার সম্ভাবনার বিশ্ব পর্যটনের অবারিত দুয়ার। পর্যটনের বিকাশ ছাড়াও এই সড়কের কারণে হবে এলাকার মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন।
অভিজ্ঞ মহলের মতে বাংলাদেশের কক্সবাজারেই শুধু আছে দীর্ঘ ১২০ কিমি সমূদ্র সৈকত। এক পাশে সাগরের অথৈই পানি আর এক পাশে সুউচ্চ দীর্ঘ পাহাড় শৃঙ্গ। এর মাঝখানে যে সড়ক তারই নাম কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১২০ কিমি মেরিন ড্রাইভ সড়ক। এটি শুধু কক্সবাজারের নয়, গোটা বাংলাদেশের অহঙ্কার। এই সড়ক দিয়ে ভ্রমণের সময় পর্যটকরা মহান সৃষ্টিকর্তা অল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্যের কথা ভাবতে ভাবতে যেন আত্মভুলা হলে পড়ে। সেই গর্বের সড়ক উদ্বোধন করে বিশ্ব পর্যটনের দুয়ার খূলে দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিজেও এই সড়ক উদ্বোধন করে ইনানী সৈকতের পানিতে একাকি হেঁটে প্রটোকলবন্দী জীবনের এক ফাঁকে স্বস্তি বোধ করেছেন। ইনানীর বে ওয়াচ রিসোর্টের সামনে সৈকতের বেলাভূমিতে তৈরী মঞ্চ থেকে গত ৬ মে দুপুর ১২টায় কক্সবাজার-টেকনাফ ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৬২ এবং ১৯৬৪ সালে বাবা-মায়ের সঙ্গে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণ করতে এসেছিলাম। তখন আমার বাবা সৌর্ন্দযময় এ সমুদ্র সৈকতকে নিয়ে নানা পরিকল্পনার কথা বলতেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। তারপরও সমুদ্র সৈকতকে আরো বেশি আর্কষণীয় করতে আমার ভেতরে স্বপ্ন তৈরি হয়। এ স্বপ্ন আমি বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর। আজকের সুন্দর মেরিন ড্রাইভ সড়ক, কক্সবাজার বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নিত করণসহ কক্সবাজার উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা তারই অংশ।
তিনি এই সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে পাহাড় ধ্বসে নিহত ছয় সেনা সদস্যের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে তাদের পরিবারের প্রতি সমবদেনা জানান। মেরিন ড্রাইভ সড়কটি নির্মাণের জন্য সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী সকাল সোয়া ১০টার দিকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছেন। পরে মেরিন ড্রাইভ সড়ক হয়ে ইনানী যান। সেখানেই ৮০ কিলোমিটার সড়কের ফলক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে মেরিন ড্রাইভ সড়কের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় সড়ক পরিবহন ও  সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, গণপূর্তমন্ত্রী মোশারফ হোসেন, পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সেনাবাহিনীর প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল নিজাম উদ্দিন মোহাম্মদ, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল আবু এসরারসহ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এসময় প্রধানমন্ত্রী অরো বলেন, কক্সবাজারকে সুন্দর করার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আমার বাবা। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত তীরবর্তী শহর কক্সবাজারকে নিয়ে ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখেছেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জানিয়েছেন, তার মধ্যে এ স্বপ্ন সৃষ্টি করেছিলেন তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তাঁর বাবার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর বলেও জানান শেখ হাসিনা
মেরিন ড্রাই সড়ক উদ্বোধনকালে কক্সবাজার উন্নয়নে তার অন্তরিকতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে  দেখেছিলাম। তখন দেখেছি এই এলাকার জীবনমান কত খারাপ ছিল। দেখেছি যোগাযোগ ব্যবস্থার ভয়াবহতা। তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্বের দীর্ঘতম ১২০ কিলোমিটার বালুকাময় সৈকত এখানে। এর সৌর্ন্দয আরো আকর্ষণীয় করতে যা যা করার দরকার তাই করা হবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যেই চিন্তা যেন সেই কাজ। তিনি ইতোমধ্যেই কক্সবাজারকে ঘিরে গ্রহণ করেছেন অর্ধশতাধিক বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প। টাকার অঙ্কে বলায়ায় দেড় লাখ হাজার কোটি টাকারও বেশী কাজ চলছে এসব উন্নয়ন প্রকল্পে।
প্রধানমন্ত্রী রেজুখাল ব্রিজ নির্মাণ ও সৈকতের কলাতলী থেকে দুই কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণের ঘোষণাও দেন। তিনি বলেন, ‘মেরিন ড্রাইভ সড়ক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে কেবল পর্যটনের বিকাশ নয়, সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের জীবনমানের ও আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন হবে।’
প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারের অপার সম্ভাবনা তুল ধরে বলেন, কক্সবাজার হবে উন্নত একটি জেলা, উন্নত পর্যটন এলাকা, খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। তিনি বলেছেন, ইতোমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন হয়ে গেছে। এখন কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কও চার লেন হবে অতি দ্রæত। কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বোয়িং চলাচলের উপযোগী হয়েছে বলে উল্লেখ করে , এখানে প্রতি সপ্তাহে ঢাকা থেকে সরাসরি ফ্লাইট আসার ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, কক্সবাজার হবে বিশ্বের অন্যতম উন্নত অঞ্চল, এখানে হবে টার্মিনাল। এটি পর্যটন কেন্দ্রই শুধু নয়, খেলাধুলার কেন্দ্রও। আন্তর্জাতিক খেলা হবে এখানে, সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পাশাপাশি ফুটবল খেলার ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে।
এদিকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক উন্মুক্ত করণের মাধ্যমে আরও একধাপ এগিয়ে গেল সীমান্তবর্তী টেকনাফ উপজেলার সাবরাংয়ে প্রস্তাবিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নাফ নদীর বক্ষে ‘জালিয়ার দ্বীপ’কে ঘিরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) র ‘নাফ ট্যুরিজম পার্ক’ নামের বিশেষ পর্যটন অঞ্চল স্থাপনের কাজ।
কক্সবাজার সড়ক ও জনপদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সরকারের সময়ে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়কটির ৪৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প গৃহীত হয়েছিল। তখন প্রকল্পের প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০৩ কোটি ২১ লক্ষ টাকা। ওই সময় সড়ক ও জনপদ বিভাগ কক্সবাজার কলাতলী পয়েন্ট থেকে সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু করে। সওজ বিভাগের ঠিকাদার কর্তৃক নির্মিত কলাতলী মোড় থেকে পাইওনিয়ার হ্যাচারী পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার সড়ক সাগরের প্রবল ঢেউয়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে সাগরে বিলীন হয়ে যায়।
পরবর্তীতে মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর প্রকৗশল নির্মাণ ব্যাটালিয়নকে। বর্তমানে সড়কটি ৪৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য থেকে বেড়ে ৮০ কিলোমিটারে উন্নীত করা হয়েছে। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে নব উদ্যোমে কাজ শুরু করেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। কাজের গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগের সদস্যরা মূল সড়ককে তিন ধাপে ভাগ করে প্রথম ধাপে কলাতলী থেকে ইনানী পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাপে ইনানী থেকে শিলখালী পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার ও তৃতীয় ধাপে শীলখালী থেকে টেকনাফের সাবরাং পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে জুন মাসের মধ্যে শেষ হচ্ছে।
সওজ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ৪৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দে নির্মাণাধীন মেরিন ড্রাইভ সড়কের দুইপার্শ্বে থাকবে ওয়াক ওয়ে, পর্যটকদের সুবিধার্থে থাকবে সড়ক জুড়ে ফ্রেক্সিবল পেভম্যান, শেড, বিভিন্ন স্থানে গাড়ি পার্কিং ও মহিলা পর্যটকদের চেঞ্জিং রুম। ৮০ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে তিনটি বড় আরসিসি সেতু, ৪২টি কালভার্ট, ৩ হাজার মিটার সসার ড্রেন ও ৫০ হাজার মিটার সিসি বøক ও জিও ট্যাক্সটাইল থাকবে। কক্সবাজার সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রানা প্রিয় বড়ুয়া জানান, মূল প্রকল্পের কাজ প্রায় সম্পন্ন হওয়ার পথে। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সড়কটি এখন দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হল।
এদিকে মেরিন ড্রাইভ সড়ককে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই চাঙ্গা হয়ে উঠেছে কক্সবাজার থেকে শুরু করে উখিয়া-টেকনাফের অর্থনৈতিক কার্যক্রম। মেরিন ড্রাইভ সড়ক ঘেসেঁই গড়ে উঠেছে ৫/৬টি পাঁচ তারকা হোটেল। এছাড়াও গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক সরকারী বেসরকারী অর্থনৈতিক স্থাপনা।
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ আসনের এমপি আব্দুর রহমান বদি বলেন ‘কক্সবাজারবাসীর স্বপ্নের মেরীণ ড্রাইভ সড়কটি প্রথমে জেলা শহর থেকে উখিয়া উপজেলার ইনানী পর্যন্ত নির্মাণ করার পরিকল্পনা ছিল। আমি নবম জাতীয় সংসদে প্রস্তাব দিই, সড়কটি টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত স¤প্রসারনের জন্য। এর পরিপেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক ইচ্ছায় এটি স¤প্রসারনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এখন সড়কটি শুধু কক্সবাজার বা গোটা দেশের নয় বরং বিশ্বের অন্যতম দর্শনীয় ও নান্দনিক একটি সড়কে পরিনত হয়েছে। সড়কটি উখিয়া-টেকনাফের মানুষের জীবন যাত্রার মান বদলে দেবে। পিছিয়ে থাকা এই জনপদ সমৃদ্ধ হবে অর্থনৈতিকভাবে। পুরো দেশের পর্যটনের বিকাশে এই সড়ক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এড. সিরাজুল মোস্তফা বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারবাসীর উন্নয়নের দুয়ার খুলে দিয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান (চেয়ারম্যান) বলেন, কক্বাজার উন্নয়নে মহা পরিকল্পনার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কক্সবাজারবাসী কৃতজ্ঞ।
উখিয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বঙ্গমাতা ফতিলতুন্নেসা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে বিশ্ব পর্যটনের সাথে যুক্ত হল কক্সবাজার। #



 

Show all comments
  • জায়েদ ৮ মে, ২০১৭, ১১:৫৫ এএম says : 0
    কক্সবাজার-টেকনাফ ৮০ কি.মি. মেরিন ড্রাইভ সড়ক করায় প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান সরকারের সকলকে মোবারকবাদ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ