দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
অধ্যাপক শাহ মোহাম্মদ আব্দুল মতিন
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মিরাজের তৃতীয় পর্যায় : সিদরাতুল মোন্তহায় পৌঁছে জিব্রাইল (আ.) নবী করিম (সা.) থেকে বিদায় নিলেন এবং বললেন, ‘সিদরাতুল মোন্তাহা থেকে এক আঙ্গুল- অন্য রেওয়ায়তে চুল পরিমাণ অগ্রসর হলে আমার ছয়শত নূরের পাখা নূরের তাজাল্লিতে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে’। সোবহানাল্লাহ! যেখানে নূরের ফেরেস্তা জিব্রাইল (আ.) জ্বলে যায়, সেখানে আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সশরীরে স্বচ্ছন্দে সামনে অগ্রসরমান। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থের প্রারম্ভে হযরত জাবের (রা.) কর্তৃক বর্ণিত নূরে মোহাম্মদী সৃষ্টির হাদিসখানা আর একবার পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিÑ ‘তিনি আল্লাহর যাতী নূরের জ্যোতি হতে পয়দা হয়েছেন’। বোঝা গেল- তিনি মাটি নন। মাটি হলে তথায় জ্বলেপুড়ে ভস্ম হয়ে যেতেন। জিব্রাইল (আ.) আমাদের নবীজীর (সা.) নূরে সামান্যতম অংশের তাজাল্লি দিয়ে সৃষ্টি। যেখানে জিব্রাইলের গতি শেষ, সেখানে থেকে আমাদের নবীজীর (সা.) যাত্রা শুরু। হাকিকতে মোহাম্মদী (সা.) সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হলে হযরত জিব্রাইল (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করতে হবে- সিদরাতুল মোন্তাহার পরে জিব্রাইল (আ.) নবীজীকে কেমন দেখেছিলেন। জিব্রাইলও বলতে পারবে নাÑ তার পরের ঘটনা কী ঘটেছিল। ফিরতি পথে হুজুর (সা.)-এর স্বরূপ কেমন ছিল, তা জানতে হবে মুসা (আ.)-এর কাছে। সেদিন তিনি প্রকৃতপক্ষে কাকে দেখেছিলেন? বিদায়ের সময় জিব্রাইল (আ.) নবী করিম (সা.)-এর কাছে একটি আরজ পেশ করেছিলেনÑ ‘আল্লাহ যেন হাশরের দিনে জিব্রাইলকে পুলসিরাতের ওপর তার ছয়শত নূরের পাখা বিছিয়ে দেয়ার অনুমতি দান করেন।’ উম্মতে মোহাম্মদী যেন উক্ত পাখার ওপর দিয়ে পুলসিরাত পার হয়ে যেতে পারে।
নবী করিম (সা.)-আল্লাহর দরবারে জিব্রাইলের এই ফরিয়াত পেশ করলে আল্লাহতায়ালা সাহাবায়ে কেরাম ও আহলে মহব্বতের লোকদের জন্য তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। আল্লাহপাক বলেছিলেনÑ (মাওয়াহেব লাদুন্নিয়া)। অর্থ- ‘জিব্রাইলের পাখার ওপর দিয়ে পুলসিরাত অতিক্রম করার আরজি মঞ্জুর করা হলোÑ আপনার সাহাবি এবং আশেকানদের জন্য।’ এই দুই শ্রেণীর লোক জিব্রাইলের পাখার ওপর দিয়ে পুলসিরাত পার হয়ে যাবে। জিব্রাইল (আ.) থেকে বিদায় হওয়ার পর রফরফ নামে এক বাহন এসে নবী করিম (সা.)-কে আরশে আযিমে পৌঁছিয়ে দেয়। এ পথে নবী করিম (সা.) সত্তরটি নূরের পর্দা ভেদ করেন। এক এক পর্দার ঘনত্ব ছিল পাঁচশত বছরের রাস্তা। এ হিসাবে ৩৬ হাজার বছরের রাস্তা অতিক্রম করে নবী করিম (সা.) আরশে মোয়াল্লায় পৌঁছলেন। এ পথে যখন তিনি একাকীত্ব অনুভব করেছিলেন, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর আওয়াজ শুনতে পেয়ে শান্ত হয়েছিলেন। আর একটি আওয়াজও তিনি শুনতে পেয়েছিলেন : ‘হে প্রিয় মোহাম্মদ (সা.), আপনি একটু থামুন, আপনার রব সালাত পাঠ করছেন।’ আল্লাহর সাথে দিদারের সময় নবী করিম (সা.) এ দুটি বিষয়ের রহস্য জানতে চাইলেন। আল্লাহতায়ালা বললেন, আমার সালাত অর্থ আপনার ওপর দরূদ পাঠ করা। আর আবু বকরের সুরতে এক ফেরেস্তা সৃষ্টি করে আবু বকরের আওয়াজ নকল করা হয়েছিলÑ যেন আপনি শান্ত হন। মহিউদ্দিন ইবনে আরবি (র.)-এর তাফসিরে বলা হয়েছেÑ হযরত আবু বকর সিদ্দিকই (রা.) রুহানীভাবে ফিরিস্তার সুরতে তথায় উপস্থিত ছিলেন। এটা ছিল তার কারামত। কেননা, তিনি ছিলেন রাসূলে পাকের নিত্যসঙ্গী। তিনি দুনিয়াতে, মাযারে, হাশরের ময়দানে এবং জান্নাতেও নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গী থাকবেন। সুতরাং মিরাজে রূহানীভাবে উপস্থিত থাকা খুবই স্বাভাবিক (দেখুন ইরফানে শরিয়ত)। আরশে পৌঁছার পর লাওহে মাহফুজ অবলোকনকালে নবী করিম (সা.) দেখতে পেলেন, তথায় শেষ বাক্যটি লেখা ছিল এরূপ : অর্থÑ ‘আমার গযবের ওপর আমার রহমত প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে।’ উক্ত হাদিসে কুদসির মধ্যে উম্মতের জন্য একটি গোপন ইশারা নিহিত রয়েছে। তা হলোÑ কিছু শাস্তি ভোগ করার পর সমস্ত হকপন্থি উম্মতই আল্লাহর রহমতে নাজাত পাবে। নবী করিম (সা.) আরশকে জিজ্ঞেস করলেনÑ আমি সমগ্র জাহানের জন্য রহমতÑ তোমার জন্য কীরূপে রহমত? আরশ তখন আরজ করলÑ আল্লাহতায়ালা যখন আমার মধ্যে কলেমার প্রথম অংশ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ লিখলেন, তখন আল্লাহর জালালী শানে আমার মধ্যে কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল। মনে হয়েছিলÑ যেন আমি টুকরো টুকরো হয়ে যাব। তারপর যখন তার পাশে আপনার জামালী নামের অংশটুকু- ‘মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ লিখে দিলেন- তখন আমার কম্পন বন্ধ হয়ে গেল (শানে হাবীব)! সুতরাং আপনি আমার জন্য বিরাট রহমত।
লা মাকানের উদ্দেশ্যে রওনা :
আরশ মোয়াল্লা হতে এবার লা-মাকানের দিকে-অজানার পথে রওনা দিলেন নবী করিম (সঃ)-যেখানে স্থান, কাল বলতে কিছুই নেই। সমগ্র সৃষ্টিগজতই তখন নবীজীর কদমের নীচে। আসমান, জমিন, চন্দ্র-সূর্য্য আরশ কুর্ছি-সবকিছু, এমন কি-আলেমে খালক (সৃষ্টি জগত) ও আলমে আমর (নির্দেশ জগত) সবকিছুই তখন নবী করিম (দঃ)-এর পদতলে রয়ে গেল। তিনি সমস্ত কিছু অতিক্রম করে আল্লাহর এত নিকটবর্তী হলেন যে, দুই ধনুকের চার মাথার ব্যবধান তা তার চেয়েও কম ব্যবধান রয়ে গেল। এটা রহস্য জগত। এ অবস্থাকে মুতাশাবিহাত বা দুর্বোধ্য অবস্থা বলা হয়। কোরআন মজিদে এই মাকামকে কাবা কাউসাইন বলা হয়েছে।
শারিরীক সান্নিধ্য এখানে উদ্দেশ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য ও ঘনিষ্ট সান্নিধ্য বুঝানো। তাফনীরে রুহুল বয়ান ৩য় পারা প্রথম আয়াতের তাফনীরে বর্ণনা করা হয়েছে যে, “নবী করিম (দঃ)-এর নূরানী সুরতের বহিঃপ্রকাম হয়েছিল সে সময়। তাঁর বাশারিয়াত সে সময় উন্নত হতে হতে নূরে ওয়াহ্দানিয়াতের মধ্যে মিশে গিয়েছিল” যেমন মিশে যায় পানিতে চিনি। এই মকামকে তাছাওফের ভাষায় ‘ফানা’ বলা হয়। রুহুল বয়ানের এবারতটুকু নি¤েœ পাঠকদের জন্য উদ্ধৃত করা হল। অর্থÑ “নবী করিম (সঃ) লাইলাতুল মি’রাজে কোন স্থানে বা সৃষ্টি জগতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। কেননা, তখন তিনি তাঁর জড় অস্তিত্বের অন্ধকার ভেদ করে ফানা হয়ে আল্লাহর নূরের অস্তিত্বে অস্তিত্ববান হয়েছিলেন। এ কারণেই কোরআন মজিদে (সুরা মায়েদা-১৫ আয়াত) আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ‘নূর’ বলে আখ্যায়িত করে এরমাদ করেছেন, হে জগতবাসী, তোমাদের কাছে আরøাহর পক্ষ হতে প্রথমে এক মহান নূর ও পরে একটি স্পষ্ট কিতাব এসেছে।” বুঝা গেলÑ তিনি দুনিয়াতে আগমনকালেই নূর ছিলেনÑ মাটি নয়। যারা মাটি বলেÑ তারা ভ্রান্ত। (তাফসীরে রূহুল বয়ান পৃঃ ৩৯৫ তৃতীয় পারা ১ম আয়াত)। উক্ত আয়াতের পূর্ণ বিকাশ হয়েছিল “ক্বাবা কাওছাইন” মাকামে।
আল্লাহর সাথে কালামঃ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে নবী করিম (দঃ)-এর কি কি কথোপকথন হয়েছিল, তা কোরআনে গোপন রাখা হয়েছে। শুধু ইরশাদ হয়েছেঃ অর্থÑ ‘যা গোপনে বলার- আল্লাহ তায়ালা তা আপন প্রিয় বান্দার কাছে গোপনেই বলে দিয়েছেন’। নবী করিম (দঃ) এরশাদ করেছেনঃ অর্থÑ “আমাকে অনেক প্রকারের গুপ্ত-সুপ্ত এলেম দান করা হয়েছে এবং সাথে সাথে ঐ এলেমের কোন কোন বিষয় গোপন রাকতেও আমাকে নির্দেশ করা হয়েছে”। কাসাসুল আম্বিয়া নামক উর্দ্দূ কিতাবে নব্বই হাজার কারামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে ত্রিশ হাজার কারাম হাদীসের আকারে সকলের জন্য এবং ত্রিশ হাজার কালাম খাছ খাছ লোকদের নিকট প্রকাশ করার জন্য এবং অবশিষ্ট ত্রিশ হাজার সম্পূর্ণ নিজের কাছে গোপন রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। (তাফসীরে ছাভী দেখুন সূরা নিছা-১১৩ আয়াত) তাফসীরে রুহুল বয়ানে বর্ণনা করা হয়েছে যে, নবী করিম (দঃ) এক পর্যায়ে আরøাহর দরবারে আরয করেছিলেনÑ “আমার উম্মতকে সর্বশেষে এবং কিয়ামতের নিকটবর্তী করে কেন পাঠান হলো এবং তাদের হায়াত পূর্বে তুলনায় কম রাখা হলো কেন”? উত্তরে আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন, “আপনার উম্মতগণ যেন গুনাহ্ করার সময় কম পায়, সেজন্য তাদের হায়াত সংকীর্ণ করেছি এবং আপনার উম্মত যেন কম সময় কবরে থাকেÑ তাই তাদেরকে কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে সর্বশেষে প্রেরণ করেছি”। সুবহানাল্লাহ! এই সময়ের সদ্ব্যবহার করা প্রত্যেক জ্ঞানী লোকেরই উচিত। নবীজীর উম্মত হওয়ার কারণেই আমাদেরকে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে।
প্রত্যক্ষ দর্শন ঃ
আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁচার পর প্রথমে নবী করিম (দঃ) আল্লাহর প্রশংসা করলেন এভাবে “আমার জবান, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও ধন-সম্পদ দ্বারা যাবতীয় প্রশংসা আরøাহর জন্য হাদিয়া স্বরূপ পেশ করছি”। এর উত্তরে আল্লাহ তায়ালা নবীজীকে ছারাম দিয়ে বললেন “হে আমার প্রিয় নবী, আপনার প্রতি আমার ছালাম, রহমত ও বরকমসমূহ বর্ষিত হোক”। উক্ত ছালামের জবাবে নবী করিম (দঃ) আরয করলেন “হে আরøাহ! তোমার ছালাম আমি এবং আমার গুনাহ্গার উম্মতের উপর এবং তোমার অন্যান্য নেককার বান্দাদের উপরও বর্ষিত হোক”! আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের এই ছালাম বিনিময়ের কৌশলপূর্ণ উক্তি ও ভালবাসার নমুনা এবং উম্মতের প্রতি নবীজীর ¯েœহ মমতা দেখে ও শুনে জিব্রাইল সহ আকাশের মোকাররাবীন ফেরেস্তাগণ সমস্বরে বলে উঠলেন “আমি (প্রত্যেক) সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মোহাম্মদ মোস্তফা (দঃ) আল্লাহর অতি প্রিয় বান্দা এবং তাঁর প্রিয় রাসুল”। “আল্লাহর কাছে তিনি প্রিয় বান্দাÑ কিন্তু বিশ্ব জগতের কাছে তিনি প্রিয় রাসুল”। কি যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক এখানে বর্ণনা করা হয়েছেÑ তা কেবল মহাজ্ঞানীরাই অনুধাবন করতে পারবেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।