Inqilab Logo

বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কাউন্সিলকে ঘিরে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা তৃণমূলে

চট্টগ্রাম বিএনপিতে প্রাণচাঞ্চল্য

প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : ‘দীর্ঘদিন পর বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে। সারাদেশে দলের লাখ লাখ কর্মী-সমর্থকদের মতো আমরাও খুশি। কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপি ফের ঘুরে দাঁড়াবে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন অবশ্যই সফল হবে।’ এক নিঃশ্বাসে এভাবে প্রতিক্রিয়া জানালেন বন্দরনগরী স্টিল মিল এলাকার বিএনপি কর্মী আবদুল মালেক ফারুকী। তার বিশ্বাস বিএনপি এখনও দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। আর দলগুছিয়ে মাঠে নামতে পারলে বিএনপিকে কেউ রুখতে পারবে না।
আগামী ১৯ মার্চ দলের জাতীয় কাউন্সিলকে ঘিরে মালেক ফারুকীর মতো বৃহত্তর চট্টগ্রামে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখন দারুণ উজ্জীবিত। দলের সহযোগী, সমমনা ও অঙ্গ সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, সমর্থক ও শুভাকাক্সিক্ষদের মাঝেও ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্য। বিএনপি সমর্থক পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও উদ্দীপ্ত। তৃণমূল থেকে শুরু করে দলের মহানগর ও জেলা পর্যায়ের নেতারা ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন কাউন্সিলকে ঘিরে। তৃণমূলের প্রত্যাশা কাউন্সিলের মধ্যদিয়ে বিপর্যয় কাটিয়ে উঠবে দল, আন্দোলনে আসবে নতুন রূপ।
কাউন্সিল নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন এই অঞ্চলের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতারা। কাউন্সিল সফল করার পাশপাশি কেন্দ্রে ‘ভাল পদ’ পেতে তারা তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছেন। উপজেলা, পৌরসভা ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছে এখন জাতীয় কাউন্সিলই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এতে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং আন্দোলন-সংগ্রাম, মামলা ও পুলিশি ধরপাকড়ে বিপর্যস্ত চট্টগ্রামের বিএনপি চাঙ্গা হয়ে উঠছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলকে জাতীয়তাবাদী শক্তির ঘাঁটি হিসাবে মনে করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। বিগত প্রায় সবক’টি জাতীয় নির্বাচনে এই অঞ্চলে ভাল ফল করে বিএনপি। এই অঞ্চল থেকে নির্বাচিতদের অনেকে বিএনপি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর পদে ছিলেন। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও আছেন এই অঞ্চলের নেতাদের অনেকে। মহানগরী জেলা, উপজেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত বিএনপির সংগঠন আছে, আছে ব্যাপক সমর্থনও। তবে এক এগারো পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে টানা প্রায় ৯ বছর কঠিন সময় পার করছে দলটি। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর দলটির নেতাকর্মীদের উপর রীতিমত রাজনৈতিক সিডর বয়ে যায়। ধরপাকড় আর মামলা, হুলিয়ার মুখে নেতাদের অনেকে দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন, অনেকে হন কারাবন্দি। বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলের উপর নতুন করে জুলুম নির্যাতন শুরু হয়। প্রধান বিরোধী দল হয়েও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে রাষ্ট্রীয় শক্তির বাধার মুখে পড়ে দলটি। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চলে পুলিশি অভিযান।
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর নেমে আসে নির্যাতনের স্টীম রোলার। আন্দোলন করতে গিয়ে অনেকে প্রাণ হারান, জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে যায় অনেক নেতাকর্মী। শত শত মামলায় হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আসামী করা হয়। গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার নেতকর্মীকে। তাদের অনেকে এখনও কারাগারে। নাশকতার মামলায় আসামী বানিয়ে নেতাকর্মীদের ধরতে চলে গণগ্রেফতার অভিযান। অভিযানের মুখে এবং পুলিশি মামলায় হুলিয়া মাথায় নিয়ে শত শত নেতাকর্মী ঘর বাড়ি ছাড়া হয়। কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড এমনকি ইউনিট পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামেও একাধিক মামলা দেওয়া হয়। এতসব জুলুম নির্যাতনের মুখেও বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মাঠ ছাড়েনি। নেতাদের কেউ কেউ সরকারের সাথে আপোষ করে আন্দোলন সংগ্রাম থেকে নিজেকে ‘নিরাপদ দূরত্বে’ রাখলেও দল আর নিজ এলাকার মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে বিএনপির অগণিত কর্মী সমর্থক। দীর্ঘদিন রাজপথের আন্দোলনে নেই বিএনপি। তারপরেও থেমে নেই ধরপাকড়, গ্রেফতারি অভিযান। প্রতিদিনই নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে পুলিশ হানা দিচ্ছে। মামলা-মোকদ্দমা মোকাবেলা করতে গিয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে দলের কর্মী সমর্থকেরা। এরপরও দলের হাল ছাড়েনি তারা।  
জাতীয় সম্মেলন ও কাউন্সিলকে ঘিরে এসব তৃণমূলের কর্মী সমর্থকদের প্রত্যাশা অনেক। মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন নেতাকর্মীর সাথে কথা বলে জানা যায়, জাতীয় সম্মেলন ও কাউন্সিলকে ঘিরে তারা খুশি। তারা মনে করে এর মধ্যদিয়ে দল ফের ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। নগরীর সুপারিওয়ালা পাড়ার বাসিন্দা বিএনপি কর্মী বাদশা মিয়া বলেন, এদেশের সাধারণ মানুষ বিএনপির সমর্থক। বিএনপির কর্মীরও অভাব নেই। এই মুহূর্তে সৎ যোগ্য এবং আপোসহীন নেতাদের দিয়ে দলকে সুসংগঠিত করা হলে বিএনপি অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াবে। তিনি বলেন বিএনপি বিভিন্ন সময়ে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হলেও কখনো জনপ্রিয়তার দিক থেকে দুর্বল হয়নি। কর্মী, সমর্থকরাই এই দলের প্রাণশক্তি। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক নেতা কামরুল ইসলাম মনে করেন বিগত দিনের আন্দোলন সংগ্রামে যারা সাহসী ভূমিকা পালন করেছে, তাদের নেতৃত্বে দল পুনর্গঠন করা হলে আগামী দিনের যেকোন আন্দোলন সফল হবে। শত জুলুম নির্যাতনেও তৃণমূলের কর্মীরা মাঠ ছেড়ে যায়নি, সাহসী নেতৃত্ব আসলে তারা জীবনবাজি রেখে মাঠে থাকবে।
কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপির দল পুনর্গঠনের এ প্রক্রিয়াকে গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, সরকারের উচিত বিএনপির কাউন্সিলে সহযোগিতা দেওয়া। যে কোন রাজনৈতিক দলের কাউন্সিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ। কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব আসে, এতে করে দলগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা হয়। দেশে সত্যিকারের কোন বিরোধী দল নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনও মানুষ বিএনপিকে বিরোধী দল মনে করে। যদিও জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। এ বিরোধী দলকে অভিনব এক বিরোধী দল উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা সরকারেও আছে আবার বিরোধী দলেও আছে। বিশ্বের কোন গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের নজির নেই। বস্তুতপক্ষে তারা বিরোধী দলের কোন ভূমিকা রাখছে না। প্রফেসর ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে দেশে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়ানো উচিত। কাউন্সিলেল মাধ্যমে বিএনপি সুসংগঠিত হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও সুসংহত হবে।
আগামী ১৯ মার্চ ঢাকায় বিএনপির জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য  রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট হল ভেন্যু হিসাবে ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে দলটি। সম্মেলনের বাকি আর মাত্র দুই সপ্তাহ। চট্টগ্রামের নেতাদের  অনেকে সম্মেলন উপ-কমিটির বিভিন্ন দায়িত্ব পেয়েছে। তারা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। তাদের মতো এখানকার বাকি নেতাদের দৃষ্টিও এখন ঢাকায়।  সম্মেলনের আগে মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা জমা এবং চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলা, এক থানা এবং ১৪ পৌরসভায় সম্মেলনের তোড়জোড় চালাচ্ছে বিএনপি। মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা কমিটির মাধ্যমে চট্টগ্রামে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ তিন সাংগঠনিক কমিটির মধ্যে মহানগরের অধীনে রয়েছে ১৪ থানা ও ৪১ ওয়ার্ড কমিটি। উত্তর ও দক্ষিণ জেলার আওতাধীন রয়েছে ১৪ উপজেলা, এক থানা এবং ১৪ পৌরসভা। উত্তর ও দক্ষিণ জেলার সবগুলো উপজেলা ও পৌরসভায় নতুন কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্র। এ নিয়ে জেলা নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ঢাকায় বৈঠক করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। বৈঠকের পর থেকে কমিটি গঠনের তোড়জোড় শুরু করেছেন জেলা নেতারা। জাতীয় কাউন্সিলের আগে পরে এসব কমিটি গঠন করে তৃণমূলে দলকে সুসংগঠিত করা হবে  বলে জানান দলের নেতারা।
নগর বিএনপির একজন নেতা জানান, মহানগরীতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকলেও থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। মহানগরীতে খুব শিগগির পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে। একই সাথে থানা ও ওয়ার্ড কমিটি পুনর্গঠন করা হবে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ৫ সদস্যের মহানগর কমিটি ঘোষণা দেয়া হয়। কমিটির নেতারা হলেন, সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন সাধারণ সম্পাদক, সিনিয়র সহ-সভাপতি দস্তগীর চৌধুরী, সহ-সভাপতি সামশুল আলম ও আবু সুফিয়ান। ওই বছরে ইন্তেকাল করেন দস্তগীর চৌধুরী। ফলে বিগত ৬ বছর ধরে ৪ সদস্যের কমিটি দিয়ে মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম চলে আসছে।
সাত উপজেলা ও ৯ পৌরসভা নিয়ে উত্তর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কমিটি গঠিত। উপজেলাগুলো হচ্ছে, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, সীতাকুন্ড, মিরসরাই ও সন্দ্বীপ। এ ছাড়া সাংগঠনিক ৯ পৌরসভা হচ্ছে, সন্দ্বীপ, মিরসরাই, বারইয়াহাট, সীতাকুন্ড, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, নাজিরহাট, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া পৌরসভা। বর্তমানে উত্তর জেলা বিএনপি কমিটির দায়িত্বে রয়েছেন আসলাম চৌধুরী আহ্বায়ক ও কাজী আবদুল্লাহ আল হাছান সদস্য সচিব। দুইজনের মধ্যে বিরোধের কারণে অধিকাংশ উপজেলা ও পৌরসভায় বিএনপির দুইটি করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্র থেকে এসব কমিটিকে সমন্বয় করতে  বলা হয়েছে। এদিকে ঢাকায় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের এক বৈঠক থেকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সকল উপজেলা ও পৌরসভা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বৈঠকে আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে এসব উপজেলা ও পৌরসভায় নতুন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
বিএনপি নেতারা জানান, ৭ উপজেলা, এক থানা ও ৫ পৌরসভা নিয়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কমিটি গঠিত। জেলার আওতাধীন উপজেলাগুলো হচ্ছে, বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও বাঁশখালী। একই সাংগঠনিক কমিটির আওতাধীন রয়েছে কর্ণফুলী থানাও। পৌরসভাগুলো হচ্ছে, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, চন্দনাইশ, পটিয়া ও বোয়ালখালী। শুধুমাত্র সাতকানিয়া উপজেলা ছাড়া দক্ষিণ জেলার অন্যান্য উপজেলা, থানা ও পৌরসভা বিএনপির সর্বশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল ২০০৯ সালের আগে। সাতকানিয়া উপজেলার কমিটি হয়েছিল ২০১৪ সালে। খুব শিগগির উপজেলা ও পৌরসভায় কাউন্সিল করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কাউন্সিলকে ঘিরে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা তৃণমূলে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ