বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আবুল কাসেম হায়দার : দেশের অর্থনীতি বিগত নয় মাসে অনেক ক্ষেত্রে বেশ অগ্রসরমান। কিন্তু রফতানিতে আমরা আমাদের টার্গট পূরণ করতে পারিনি। বিগত নয় মাসে রফতানির টার্গেট ছিল ২ হাজার ৭১১ কোটি ডলার। টার্গেট অর্জিত হলো মাত্র ২ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলার।
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। আয় কম হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এ আয় ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ কম। তবে প্রবৃদ্ধির বিবেচনায় এটি গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেশি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সর্বশেষ প্রকাশিত চলতি অর্থবছরের (জুলাই-মার্চ) পর্যন্ত আয়ের গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ সময়ে মাসওয়ারি আয় কমার পাশাপাশি প্রবৃদ্ধিও ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করেছে।
চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের (জুলাই-অক্টোবর) সময়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনের হার ছিল ৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এটি ৬ মাসের হিসাবে অর্থাৎ (জুলাই-ডিসেম্বর) কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। অর্থবছরের সাত মাসের হিসাবে (জুলাই-জানুয়ারি) কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশে। আট মাসের হিসাবে (জুলাই-ফেব্রæয়ারি) কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ০৮ শতাংশ। আর নয় মাসের হিসাবে (জুলাই-মার্চ) তা আরো কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৩০ শতাংশে।
এদিকে মাসওয়ারি আয় পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। এর থেকে অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২ হাজার ৭১১ কোটি ডলার। লক্ষ্য অর্জনের এ দৌড়ে নির্ধারিত সময় ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত আয় এসেছে ২ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলার। রফতানি আয় কম হয়েছে ১১৬ কোটি ডলারের বেশি। দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ৯ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। খাতভিত্তিক আয় পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পোশাক খাতে (নিটওয়্যার এবং ওভেন গার্মেন্ট) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম হয়েছে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এ খাতে ১২ মাসে আয় ধরা হয় ৩ হাজার ৩৭ কোটি ডলার। নয় মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ২২৫ কোটি ডলার। কিন্তু ফেব্রæয়ারি শেষে তা অর্জিত হয় মাত্র ২ হাজার ৯২ কোটি ডলার। তবে সার্বিক পোশাক খাত এ কম আয় নিয়েই প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এ খাতে আশঙ্কার বড় কারণ হচ্ছে ওভেন গার্মেন্টে হতাশাজনক রফতানি আয়। নিটওয়্যার তুলনামূলক ভালো করলেও কাক্সিক্ষত আয় অর্জন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে ওভেন গার্মেন্ট। এই উপখাতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কম হয়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ।
এর বাইরে অন্যান্য খাতেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চিত্র সন্তোষজনক নয়। তাজা মাছ রফতানি খাতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ৫৫ দশমিক ১২ ভাগ, কৃষিপণ্য খাতে ৮ দশমিক ১৯ ভাগ, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ৪ দশমিক ৩১ ভাগ, প্রিন্টেড ম্যাটেরিয়ালস খাতে ১৮ দশমিক ৫২ ভাগ এবং ম্যান মেড ফিলামেন্ট ও স্ট্যাপল ফাইবার পণ্যে ২২ দশমিক ৭২ ভাগ। বিশ্ববাজারে রফতানি পরিস্থিতি, ভোক্তার চাহিদা এবং রফতানিকারকদের সরবরাহ সক্ষমতা সবসময় এক তালে চলে না। ফলে বিভিন্ন খাতে রফতানি আয়ে বিভিন্ন সময়ে কম-বেশি বিচ্যুতি ঘটতে পারে। কিন্তু আমাদের রফতানি খাতে আশার খবর হচ্ছেÑ কয়েকটি খাত ছাড়া বাকি সব রফতানি খাত এবং পণ্যে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। এ প্রবৃদ্ধিই সামনে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে এটিই এখন আশঙ্কার বড় কারণ। এটি ভালো লক্ষণ নয়। কারণ আমাদের ন্যূনতম প্রবৃদ্ধি নিয়ে এগুলো চলবে না। মনে রাখা দরকার, সামনে ২০২১ সাল নাগাদ সার্বিক রফতানি খাত থেকে ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এককভাবে তৈরি পোশাক খাত থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন তা অর্জন করতে হলে প্রতি মাসেই রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি থাকতে হবে ১১-১২ শতাংশ হারে।
জলবায়ু খাতে বিশ্ব ব্যাংক বিনিয়োগ : জলবায়ু খাতে বাংলাদেশকে ১১ দশমিক ৩ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। প্রতি ডলার ৮০ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৯০৪ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক, আগাম পূর্বাভাস সক্ষমতা ও সতর্কবার্তা প্রদান ব্যবস্থা আধুনিক ও শক্তিশালী করবে সরকার। সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) এধরনের একটি চুক্তি সই হয়। অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের পক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত আবাসিক প্রতিনিধি চিমিয়াও ফান এবং সরকারের পক্ষে ইআরডির ভারপ্রাপ্ত সচিব কাজী শফিকুল আযম চুক্তিতে সই করেন।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) বিনা সুদে এ ঋণ প্রদান করছে। তবে বিশ্বব্যাংকের বিতরণকৃত এ ঋণের ওপর দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। ৬ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩৮ বছরে ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এই টাকা পেলে আবহাওয়া অফিসে আরো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে। এতে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম সংকেত পাওয়া আরও সহজ হয়ে যাবে। যার মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে সহজ হবে।
চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার এ ঋণের অর্থে ‘বাংলাদেশ আঞ্চলিক আবহাওয়া ও জলবায়ু সেবা’ (বিউবিউসিএসআরপি) প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এর আওতায় বাংলাদেশে আবহাওয়া, পানি, দুর্যোগ ঝুঁকি এবং জলবায়ু সম্পর্কিত তথ্যসেবা পদ্ধতি শক্তিশালী হবে। একই সঙ্গে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, রাজশাহী ও নওগাঁÑ এই ৪ জেলায় আকস্মিক বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং অনাবৃষ্টির বিষয়ে কমিউনিটি পর্যায়ে আগাম সতর্কবার্তা প্রদান ব্যবস্থা চালু করা হবে। এতে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ উপকৃত হবেন। প্রকল্পের আওতায় দেশব্যাপী এগ্রো-মেট্রোলজিক্যাল ইনফর্মেশন সিস্টেম পোর্টাল স্থাপনের পাশাপাশি ৪৮৭টি উপজেলায় এগ্রো-মেট ইনফর্মেশন কিওস্কস এবং ৪ হাজার ৫১টি ইউনিয়নে এগ্রো-মেট ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন করা হবে। এতে ৩০ হাজারেরও বেশি কৃষক পরিবার আবহাওয়া এবং পানি সম্পর্কিত তথ্য প্রাপ্তির প্রবেশাধিকার পাবেন এবং এর মাধ্যমে তারা আবহাওয়া অবস্থা হিসাবে রেখে সময়োপযোগী পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলা বা দুর্যোগ প্রস্তুতির জন্য বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। তাছাড়া আবহাওয়ার ধরন একটি (সিঙ্গল) দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এ বিষয়টি অনুধাবন করে এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বৃহত্তর সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে। একই সঙ্গে আবহাওয়া ও জলবায়ু মনিটরিং ফ্রেমওয়ার্ক আধুনিকায়নের সঙ্গে কমিউনিটি পর্যায়ে আগাম সতর্ক ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। চিমিয়াও ফান বলেন, বাংলাদেশ প্রায়ই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়। আবহাওয়ার নির্ভুল পূর্বাভাস এবং তথ্যাদির অভাবে অর্থনীতির প্রধান খাতগুলোর উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যেমনÑ কৃষি।
নতুন পদক্ষেপ নেয়া দরকার :
১. রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করতে না পারলেও প্রবৃদ্ধি কিন্তু বৃদ্ধি পেয়েছে। রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করতে হলে নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত রফতানি খাত বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। নতুন নতুন পণ্যের রফতানি হাট আমাদের খোঁজ করতে হবে। এই ক্ষেত্রে চীন ও ভারতকে রফতানি জন্য টার্গেট করে রফতানিকারক ও সরকারকে অগ্রসর হতে হবে। চীনের বৃহৎ বাজারের সামান্য অংশ যদি আমরা লাভ করতে পারি তাতে আমাদের রফতানি বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
২. ইউরোপের বাজার স¤প্রসারণের জন্য সরকার ও শিল্প উদ্যোক্তদের জন্য নতুন করে কৌশল অবলম্বন করতে হবে। বিদেশে ঘন ঘন রফতানি মেলার আয়োজন করতে হবে। ঘন ঘন রফতানি মেলার মাধ্যমে নতুন নতুন ক্রেতা সৃষ্টি সম্ভব। বেশি ক্রেতা সৃষ্টি হলে রফতানির পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে রফতানি বাড়াতে আলোচনা অবশ্যই শুরু করতে হবে। যুক্তরাজ্যে রফতানি বৃদ্ধি করতে পারলে দেশের মোট রফতানি বৃদ্ধি পাবে।
৩. আমাদের দেশে আরো বেশকিছু রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশে নতুন নতুন বৃহৎ আকারের তৈরি পোশাক শিল্প স্থাপিত হলে রফতানি বৃদ্ধি পাবে। রফতানি বৃদ্ধির জন্য চামড়া, চা ও পাটজাত দ্রব্যের প্রতি আমাদের নজর দেয়া দরকার। এই সকল পণ্যের আন্তর্জাতিক চাহিদা রয়েছে। আমাদেরকে রফতানি বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে।
৪. জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। দক্ষ জনশক্তি রফতানি আমাদের মূল টার্গেট হওয়া উচিত। অদক্ষ জনশক্তি রফতানিতে আয় কম হয়। রেমিটেন্স কম আসে। তাই প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে আমাদের দক্ষ জনশক্তি রফতানির জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে হবে। কিছু কিছু উপজেলায় তা রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ উপজেলায় ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা নেই।
৫. আমাদের শিক্ষা খাতের ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার। এখনো শিক্ষা কর্মমুখী হয়নি। আমাদের শিক্ষা এখনো সার্টিফিকেটনির্ভর। দেশে প্রচুর পরিমাণ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয়সংখ্যক ভোকেশনাল, পলিটেকনিকেল ইনস্টিটিউট নেই। দক্ষ জনশক্তি রফতানির জন্য এই সকল প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি পূরণ করা যাবে না। বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অসংখ্য বেকার উচ্চশিক্ষিত যুবক সৃষ্টি করছে।
৬. দেশে নিয়ম, নীতি ও আইনের সুশাসন কায়েম করা জরুরি। আইনের শাসন ব্যতীত দক্ষ জনশক্তি, নতুন নতুন কারখানা তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি হবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হলে আইনের সুশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি বিনিয়োগ ব্যতীত রফতানি আয় বৃদ্ধি করা যাবে না।
৭. রফতারি বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকের সুদের হার ৫ থেকে ৭ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশে ব্যাংকের সুদের হার ১১ থেকে ১৫ শতাংশ রয়েছে। উক্ত সুদেরে কারণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি হচ্ছে না। সুদের হার ও নানা চার্জ যৌক্তিক হারে হ্রাস করতে হবে।
য় লেখক : সাবেক সহসভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।