বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
রেজা হাসান : ইংরেজি অমমৎবংংরড়হ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে আগ্রাসন। আগ্রাসন মূলত তিন ধরনের হতে পারে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও সামরিক আগ্রাসন। আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ও সচল। এ আগ্রাসনের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে শব্দ-সংস্কৃতি। জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় এ শব্দ-সংস্কৃতির আগ্রাসনের নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিবাবুরা এ আগ্রাসনের বীজ অংকুরিত করেই ক্ষান্ত হননি বরং মহীরুহে পরিণত করার সর্বাত্মক চেষ্টায় আজো লিপ্ত রয়েছেন।
শব্দ-সংস্কৃতির বহুমাত্রিকতা : সংস্কৃতির প্রধান বাহন ভাষা। আর এ ভাষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো শব্দ বা শব্দ-সংস্কৃতি। এ শব্দ-সংস্কৃতির উপর আঘাত হেনেই যে কোন জাতিকে পরাভূত করা যায়। সৈন্য পাঠিয়ে দেশ জয় করার পুরনো পদ্ধতি এখন বাতিল হয়ে গেছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে মুসলমানদের স্বাধীনতার স্পৃহা দমিয়ে দেয়া যায়, জিহাদী প্রাণশক্তি নিস্তেজ করে দেয়া যায়; সর্বোপরি অপসংস্কৃতির সয়লাবে ঈমান ও আকিদার শক্তিশালী ভিতকে মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া যায়। আর এ আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়েছেন আমাদের রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, ছাত্র, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মুসলমান। বহুমাত্রিক এ আগ্রাসনের কবলে পড়ে তারা তাদের অজ্ঞাতেই ঈমান হরানোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। নিম্নে এ ধরনের কিছু শব্দ-সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হলো:
অগ্নিকন্যা বা অগ্নিপুরুষের ব্যবহার : পবিত্র কোরআন ও হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি, মানুষ মাটির তৈরি এবং জিন জাতি আগুনের দ্বারা তৈরি। মাটির তৈরি মুসলমানদের মৃত্যুর পর তাকে মাটির কবরে দাফন করা হয়। মাটির দেহ মাটিতে মিশে যায়। কোনো মুসলমানের লাশকে আগুনে পোড়ানো হয় না। পক্ষান্তরে অগ্নিউপাসকরা অগ্নিকে পূজা করে একটি শক্তি জ্ঞান করে। অগ্নিপূজারীদের ধর্মবিশ্বাসে রয়েছে অগ্নিদেবতা বা অগ্নিঅবতার। তারা আগুনকে উপাসনার বস্তু জ্ঞান করে। আগুনের বৈশিষ্ট্যকে মানবচরিত্রে চরিত্রায়ন করে তারা হতে পারেন অগ্নিপুরুষ বা অগ্নিকন্যা।
হিন্দু শাস্ত্রমতে গোটা পৃথিবী একটি অগ্নিকুÐ। দেবতা বা ব্রাহ্মণের মুখকে বলা হয় অগ্নিমুখ। দশটি দিকের মধ্যে অগ্নিকোণ বলতে যে কোনটি আছে (পূর্ব ও দক্ষিণ দিকের মধ্যবর্তী কোণ) এই কোণের একজন অধিদেবতা আছেন, যার নাম বৈশ্বানর। হিন্দু শাস্ত্রের এই দর্শন অনুসরণ করে কোন মুসলমান কি অগ্নিপুরুষ বা অগ্নিকন্যা হতে পারেন?
মুসলমানরা আগুনকে ব্যবহার করেন প্রয়োজনে। আগুনকে তারা পূজা করেন না, আগুনের প্রতি নেই কোন তাদের মোহ। প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলিম সকাল-সন্ধ্যায় জাহান্নামের আগুন থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায়। তাই কোনো মুসলিম আগুনের স্বভাব ও গুণ গ্রহণ করে ‘অগ্নিপুরুষ’ বা ‘অগ্নিকন্যা’ হতে পারেন না। ‘ঈমানের পরীক্ষা’ যেখানে যথেষ্ট সেখানে কোনো লেখকের লেখায় ‘ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা’ আসা যেমন অবান্তর, তেমনি অযৌক্তিক ‘অগ্নিশর্মা’ও। অগ্নিকে শক্তি জ্ঞান করে ‘শিখা অনির্বাণ’ ও ‘শিখা চিরন্তন’ নাম দিয়ে গ্যাস পোড়ানো হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির বাংলাদেশী সংস্করণ।
আপামর জনতা : আপামর শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো, আ+পামর অর্থাৎ পামর পর্যন্ত। আপামর ক্রিয়া বিশেষণ আর পামর হচ্ছে বিশেষণ। পামর অর্থ হচ্ছে পাপিষ্ঠ, নরাধম, মূর্খ, নীচ, হীন। জনসাধারণকে বোঝানোর জন্য বর্তমানে লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরা আপামর শব্দ ব্যবহার করে থাকেন।
‘আর্যরা দক্ষিণ রাশিয়া ও তুর্কিস্তান থেকে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে এ উপমহাদেশে এসে একটি উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাক্ষাৎ পায়। কিন্তু আর্যরা তাদের আগমনের আগে এদেশে কোনো সভ্য জাতির আবাস ছিলো তা স্বীকার করে না। উপমহাদেশে অনুপ্রবেশকারী এ দলটি নিজেদের পরিচয় দিলো আর্য বা সভ্য বলে এবং তারা এসে এ উপমহাদেশে যাদের দেখলো তাদের নাম দিলো অনার্য বা অসভ্য। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, আর্য ধর্ম থেকেই হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি। হিন্দু ধর্ম আবার চতুর্বর্ণের সমষ্টি। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ব্রাহ্মণরা ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। ক্ষত্রিয়রা ছিলো সৈন্য আর বৈশ্যরা বণিক বা ব্যবসায়ী শ্রেণি। শূদ্ররা ছিলো নিম্নবর্ণের জনগণ’(আর্য ধর্ম ও ইসলাম, রেজা হাসান, মাসিক রহমত, নভেম্বর ২০০৭)।
আর্যদের জাতিভেদে শূদ্ররাই মূলত পামর। ব্রাহ্মণরা শূদ্রদের সরাসরি পামর বলে থাকে। পামরদের কোনো অধিকার ছিলো না ধর্মশাস্ত্র পাঠের, এমনকি শ্রবণেরও। ব্রাহ্মণ আরোপিত ধর্মীয় এই নিষেধ অমান্য করার কারণে কতো পামরদের যে জীবন দিতে হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কালক্রমে পামরদের অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্য, হরিজন, ¤েøচ্ছ ও যবন হিসেবে গণ্য করা হয়। আর হিন্দু শাস্ত্রমতে পামরদের বাস হচ্ছে রৌরব নরকে।
বঙ্গদেশে যখন ইসলাম বিজয়ী বেশে বখতিয়ারের তেজী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আসে তখন বর্ণহিন্দুরা মুসলমানদের ¤েøচ্ছ, পামর, যবন বলে চিহ্নিত করতো। হিন্দুদের কাছে মুসলমানরা ছিলো অস্পৃশ্য। মুসলমানদের ছায়া তাদের উপর পড়লে তারা সহ্য করতে পারতো না। পানিভর্তি মাটির কলসের উপর এ ছায়া পড়লে ভরা কলস ভেঙে ফেলা হতো। পিতলের কলসের উপর মুসলমানের ছায়া পড়লে তা ‘গঙ্গাজলে’ সাতবার ধৌত করে পবিত্র করা হতো।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পামর শব্দের অর্থ হচ্ছে পাপিষ্ঠ, নরাধম, মূর্খ, নীচ, হীন। আর উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা নিম্নবর্ণের শূদ্রদের অচ্ছুৎ বা নিচুজাত মনে করে ‘পামর’ বলতো। এজন্যই মুসলমানরা এমন একটি শব্দ তাদের লেখায় ও কথায় ব্যবহার করতে পারে না। ‘জনসাধারণ’ ‘আমজনতা’ ‘সব শ্রেণির লোক’ বললেই তো সর্বস্তরের লোককে বোঝায়। ‘পামর’ যোগ করার কোনো মানে হয় না।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা হয়েছে, ‘আমি বনী আদমকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি’ (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ৭০)। শাশ্বত ধর্ম ইসলাম ঘোষণা দিলো, সকল মানুষ আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। নেই কোনো বর্ণবাদের অবকাশ। আল্লাহর দৃষ্টি সে ব্যক্তিই সম্মানিত যার মধ্যে আল্লাহভীতি আছে। আর তাইতো হাবশী ক্রীতদাস বেলাল (রা.) ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর হয়ে গেলেন ইসলামের প্রথম মুআযযিন। এক সময়ের ক্রীতদাস যে জাতির গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন হয়েছিলেন সে জাতির নরনারী কথায় বা লেখায় ‘পামর’ শব্দ দিয়ে কি বোঝাতে চায়? ইসলামী সংস্কৃতিবিরোধী এই শব্দটি মুসলমানরা ঐতিহ্যগত কারণেও ব্যবহার করতে পারেন না। (চলবে)
য় লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।