পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
রফিকুল ইসলাম সেলিম : মায়ের পরকীয়া প্রেমিককে খুনের পর লাশ দশ টুকরো করে গুম করার সেই চাঞ্চল্যকর ঘটনার রেশ না কাটতেই আবার চট্টগ্রামে অনৈতিক সম্পর্কের জেরে ঘটেছে নৃশংস জোড়া খুনের ঘটনা। মহানগরীর কোতোয়ালি থানার ফিরিঙ্গিবাজার এয়াকুব নগরে স্ত্রী আসমা বেগম (২২) ও তার খালু মাকসুদুর রহমানকে (৩২) খুন করে পালিয়ে যায় বিদেশ ফেরত রফিকুল ইসলাম হৃদয় (২৫)।
প্রতিবেশীদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার রাত ৯টায় প্রথমে নিজ বাসায় স্ত্রীকে গলাটিপে হত্যা করে হৃদয়। এর পাঁচ মিনিট পরই বাসার পাশে দোকানে বসা খালুশ্বশুর মাকসুদুর রহমানকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে পালায় হৃদয়। আসমার সাথে আপন খালু মাকসুদের দীর্ঘদিনের চলে আসা পরকীয়া সম্পর্কের জেরে এ নির্মম হত্যাকা- ঘটে বলে জানায় এলাকাবাসী। এর আগেও চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় পরকীয়া বা অনৈতিক সম্পর্কে বিষিয়ে ওঠা বেশক’টি পরিবারে খুনাখুনির নির্মম ঘটনা ঘটে, যা ভাবিয়ে তুলেছে সমাজের বিবেকবান সাধারণ মানুষকে। মূল্যবোধের এহেন চরম অবক্ষয় সমাজকে কোথায় ধাবিত করছে তা নিয়ে অভিভাবকরা চিন্তিত, উৎকণ্ঠিত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে পারিবারিক কাঠামো ভেঙে পড়ছে। সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়ে গেছে। আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা এবং পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা উঠে যাওয়ায় মানুষ হিংস্র হয়ে উঠছে। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়ে ওঠায় পারিবারিক শিক্ষা এবং বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ছে। এসব কারণে মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রকট হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল্যবোধ শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করতে হবে। প্রতিটি ধর্মই মূল্যবোধ এবং মানবিকতার শিক্ষা দিয়েছে। অথচ দেশে প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। সামাজিক বিশৃঙ্খলা, হানাহানি ও নৃশংসতা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা।
হৃদয়ের স্বজন ও প্রতিবেশীরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সময় স্ত্রীকে তার খালার বাসায় রেখে যান হৃদয়। বিদেশে থেকেই তিনি শুনতে পান খালুর সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক চলছে। দেশে ফিরে এসে এর প্রমাণ পেয়ে দু’জনকেই হত্যা করেন হৃদয়। অনৈতিক সম্পর্কের জেরে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে একের পর এক নৃশংস খুনের ঘটনায় স্তম্ভিত বিবেকবান মানুষ। উদ্বিগ্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে উল্লেখ করে পুলিশ কর্মকর্তা ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব, অপসংস্কৃতির আগ্রাসন ও মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব এবং পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ায় এ ধরনের ঘটনা বেড়েই চলেছে।
পরকীয়ার জেরে মহানগরী এবং জেলায় প্রতিনিয়তই নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটছে। প্রবাসী স্বামীকে খুন করে লাশ গুম করছে স্ত্রী। কোথাও আবার খুনি ভাড়া করে পরকীয়া প্রেমিকের সহযোগিতায় স্বামীকে হত্যা করা হচ্ছে। মহানগরীর ইপিজেড এলাকায় পরকীয়ার জেরে কয়েক মাসে একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি ওই এলাকায় লাইটারেজ জাহাজ চালক মোহাম্মদ মহসিনকে (৫১) শ্বাসরোধ করে হত্যার পর লাশ দশ টুকরো করার ঘটনায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আরিফুল ইসলাম (১৯) নামে এক যুবক। আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে খুনের দায় স্বীকার করে ওই যুবক জানায়, তার মা নাজমা বেগমের সাথে পরকীয়ার কারণে মহসিনকে খুন করে সে। এরপর লাশ দশ টুকরো করে কিছু কর্ণফুলী নদীতে এবং কিছু নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গুম করে সে। নাজমা বেগমের স্বামী ১২ বছর আগে মারা যান। ৩ বছর ধরে ওই জাহাজ চালকের সাথে তার অনৈতিক সম্পর্ক চলছিল। এ সম্পর্ক মেনে নিতে না পেরে জাহাজ চালককে খুন করে সে। অনৈতিক সম্পর্কের জেরে নগরীর অভিজাত সিডিএ আবাসিক এলাকায় দিনদুপুরে খুন হন মা-মেয়ে। মহানগরীর আমিরবাগে কথিত প্রেমিকের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মিদাত সুলতানা। অনৈতিক সম্পর্কের জেরে নগরীর হালিশহরের রঙ্গিপাড়ায় খুন হন একজন বিচারক। অনুরূপ এক ঘটনায় মহানগরীর খাজা রোডে কিশোর গৃহশিক্ষকের হাতে খুন হন গৃহকর্ত্রী। অনৈতিক সম্পর্কের জেরে একের পর এক নৃশংস এসব হত্যাকা-ের ঘটনা সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের ফসল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রাম মহানগরী এবং জেলায় গত এক বছরে ১০ হাজার সংসার ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। এসব বিবাহ বিচ্ছেদের উল্লেখযোগ্য অংশের নেপথ্যে ছিল পরকীয়া।
সর্বশেষ মঙ্গলবার রাতে ওই জোড়া খুনের ঘটনার পর মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিষয়টি ফের আলোচনায় এসেছে। গতকাল দিনভর বিষয়টি ছিল মানুষের মুখে মুখে। নৃশংস খুনের ঘটনায় নিহত দু’জনের পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। স্বজন হারানোর বেদনায় কাঁদছে সবাই। নিহত আসমার গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং এলাকায়। তার বাবার নাম আবদুল হাফিজ। মর্গের সামনে মেয়ে হারানোর বেদনায় অঝোরে কাঁদছিলেন তিনি। সাথে ছিল তার দুই ছেলে। গভীর রাতে মেয়ে খুনের খবর পেয়ে কর্মস্থল ফেনী শহরের একাডেমি এলাকা থেকে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে ছুটে আসেন হাসপাতালের মর্গে। আবদুল হাফিজ জানান, সাড়ে ৩ বছর আগে তার সপ্তম শ্রেণীপড়–য়া কিশোরী মেয়েকে বিয়ে করেন রফিকুল ইসলাম হৃদয়। তিনি বলেন, সামাজিকভাবে বিয়ে হলেও এ বিয়েতে আমাদের তেমন মত ছিল না। হৃদয়ের আগ্রহে মেয়েকে পড়ালেখা বাদ দিয়ে বিয়ে দেন তিনি। তিনি জানান, তখন তার মেয়ের বয়স ১৮ হয়নি, এ কারণে স্থানীয় কাজী বিয়ে পড়াতে রাজি হচ্ছিলেন না। হৃদয় কাজীকে ৫ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে বিয়ে পড়াতে রাজি করান। হৃদয়ের বাড়ি তাদের পাশের গ্রামে। আবদুল হাফিজ জানান, বিয়ের ৭ মাস পর হৃদয় মালয়েশিয়ায় চলে যান। তার মেয়ে আসমাকে চট্টগ্রাম নগরীর ইয়াকুব নগরে তার খালার বাসার পাশে আলাদা বাসা নিয়ে রেখে যান। তিনি জানান, বিয়ের পর মেয়ে এবং তার জামাই তাদের সাথে তেমন যোগাযোগ রাখত না। খালুর সাথে পরকীয়ার কারণে আসমাকে খুন করা হয়েছে Ñ হৃদয়ের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমন কিছু আমার জানা নেই। তিনি দাবি করেন, তার মেয়ে ৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
একই ঘটনায় নিহত মাকসুদুর রহমানের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগরে। গতকাল সকালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মর্গের সামনে আহাজারি করছিল তার স্বজনেরা। স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ের জনক মাকসুদুর রহমান ইয়াকুব নগর এলাকায় একটি মোবাইল ফোনের দোকান পরিচালনা করতেন। নিজের মেয়ে সাবিহার নামে মোবাইল ফোনের দোকানের নাম দেওয়া হয়। ওই দোকানের উল্টো দিকে একটি চায়ের দোকান পরিচালনা করেন বড় ভাই আলী হোসেন। ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনিও ছুটে আসেন হাসপাতালে। তিনি জানান, ওই সময় দোকান বন্ধ করে তিনি বাসায় চলে যান। আর এ ফাঁকে হৃদয় এসে তার ভাইকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হৃদয়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে আলী হোসেন বলেন, এ ধরনের কোনো সম্পর্কের কথা আমরা জানি না। আমি আমার ভাইয়ের খুনি হৃদয়ের ফাঁসি চাই। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ৪ ছেলে-মেয়ে এবং স্ত্রী নিয়ে তার সুখের সংসার ছিল। এখন ছেলেসন্তান নিয়ে আমার ভাইয়ের বউ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
চাঞ্চল্যকর এ জোড়া খুনের ঘটনায় মামলার তদন্তভার পেয়েছেন এসআই মোঃ নুরুজ্জামান। তিনি ইনকিলাবকে জানান, প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী খালুর সাথে পরকীয়ার বিষয়টি জানতে পেরে স্বামী রফিকুল ইসলাম হৃদয় এ জোড়া খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তবে এর নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত হৃদয়কে পাওয়া যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, তাকে ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। নিহত আসমা অন্তঃসত্ত্বা কিনা তা ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর নিশ্চিত হবে বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা।
এদিকে মহানগরী এবং জেলায় অনৈতিক সম্পর্কের জেরে একের পর এক নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনায় উদ্বিগ্ন পুলিশ প্রশাসন। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম শহীদুর রহমান বলেন, এ ধরনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। অনৈতিক সম্পর্কের জেরে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। মূল্যবোধের অবক্ষয়, মিডিয়ায় প্রচারিত বিভিন্ন সিরিয়ালের নেতিবাচক প্রভাব ও পারিবারিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার কারণে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, অপরাধ সংগঠনের পর পুলিশ অপরাধীদের ধরে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু সমাজের এ অসঙ্গতি দূর করা কিংবা সংশোধন করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব না। সমাজবিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোকে এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে হবে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি মাওলানা ফারুক সিদ্দিকী বলেন, ইসলামী শিক্ষা তথা নৈতিক শিক্ষার অভাবে সমাজে অনাচার, ব্যভিচার এবং খুন-খারাবির মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিকীকরণের নামে মূল্যবোধ ও ইসলামী শিক্ষা বাদ দেওয়া হচ্ছে। আগে ইসলামী শিক্ষার সিলেবাসে যতটুকু ছিল এখন তাও নেই। এতে করে শিক্ষার্থীরা মূল্যবোধের শিক্ষা পাচ্ছে না। নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ কখনও বিপথগামী হতে পারে না। এ ধরনের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে সমাজের বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সমাজে মিডিয়ায় প্রচারিত অশ্লীলতা, বেহায়াপনা এবং ধর্মহীনতা ব্যাপক প্রভাব পড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব অপসংস্কৃতি বন্ধ হওয়া দরকার।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।