Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাড়ছে লাশের মিছিল থামছেই না স্বজনদের কান্না

প্রকাশের সময় : ৩ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উমর ফারুক আলহাদী : বাড়ছে লাশের মিছিল। থামছেই না স্বজনদের কান্না। প্রতি দিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে খুন-গুমের ঘটনা। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, অপহরণের পর হত্যা, মুক্তিপণ আদায় এবং চাঁদাবাজি মাহামারী আকারে চলছে। পড়ছে লাশের পর লাশ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খুন-গুমের ঘটনা। বিশেষ করে একের পর এক শিশু খুনের ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকন্ঠা এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। আইনশৃংখলা পরিস্থিতির এই অবনতির কারণে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপত্তা নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তুলে নেয়ার পর কারো লাশ মিলছে আবার কারো কারো মিলছে না। নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার ও স্বজনেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় আবেদন-নিবেদন করেও কোনো সাড়া পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। নিখোঁজ ও গুম হওয়া মানুষের পরিবার এবং তাদের স্বজনদের অপেক্ষার শেষ কোথায়Ñ এ প্রশ্ন সমাজের বিবেকবান ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতানেত্রীদের।
গত ২০১৩ সালে ৬ ডিসেম্বর গুম হওয়া নিজাম উদ্দিন মুন্নার বাবা সামছুদ্দিন বলেন, ‘আমার একটাই পরিচয় গুম হওয়া সন্তানের পিতা। এই পরিচয় আর কারও হোক তা কামনা করি না। অনেক কেঁদেছি আর কাঁদতে চাই না। সরকারের কাছে একটা চাওয়া- আমাদের সন্তানকে মেরে যেখানে রাখা হয়েছে, সেই মাটিটা আমাকে দেখিয়ে দিন। যেন মাটিটা ছুঁয়ে দেখতে পেতে পারি।
তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, সন্তান হারানোর বেদনা আর বইতে পারছি না।
গত ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গুম হওয়া তেজগাঁও এলাকার সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন বলেন, আর কত দিন কাঁদতে হবে। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। আর যে পারছি না। এ কথা বলেই ডুকরে কেঁদে উঠেন। পরে আর তিনি কথা বলতে পারেননি। গত ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর গুম হওয়া খালিদ হাসান সোহেলের স্ত্রী শাম্মী সুলতানা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, জেলগেট থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে। এখনো ফেরত পাইনি। আমার দুই বছরের সন্তান পিতা ছাড়া শৈশব পার করেছে। আমার সন্তানের সেই শৈশব ফিরিয়ে দিন।
বিভিন্ন সূত্র মতে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন প্রতিদিনই খাল-বিল, নদী-নালা লাশ মিলছে। বনশ্রীতে শিশু ভাই-বোন হত্যা, কুল্লিায় দুই শিশু হত্যা, ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর যশোরে মিললো ঝিনাইদহের সেই মাদ্রাসা শিক্ষকের লাশ। গত সোমবার ঝিনাইদহের মাদ্রাসা শিক্ষক আবু হুরাইরা মালিথার (৫৫) লাশ মিলেছে যশোরে। শিক্ষক আবু হুরাইরার বড় ভাই আব্দুল কাদের জানান, গত ২৪ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার শৈলমারী বাজার সংলগ্ন কুঠিদুর্গাপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে আবু হুরাইরা মালিথকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। গত ৭ জানুয়ারি কালুহাটী গ্রামের বেলেখাল বাজারে ধর্মান্তরিত সমির নামে এক বয়োবৃদ্ধ হোমিও চিকিৎসক খুন হন। এ ঘটনার পর থেকে গান্না ইউনিয়নের অশ্বস্থলী ও কালুহাটীসহ বিভিন্ন গ্রামে পুলিশ পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকের লোকজনের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে শিশুর বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ গত মঙ্গলবার। উপজেলা সদরের মনোহরগঞ্জ বাজারের পূর্বপাশে অবস্থিত ‘রাজের গড়’ নামে পরিচিত একটি স্থানে থেকে ওই শিশুর লাশ দেখতে পেয়ে থানা পুলিশে খবর দেয় এলাকাবাসী।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালির মিলিটারী সেতুর গার্ডার ধসে নিখোঁজ শ্রমিক আবুল হাশেম (২৮)-এর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে স্থানীয় লোকজন তার লাশ খালের পানিতে ভাসতে দেখে উদ্ধার করে। ঘটনার ৩ দিনের মাথায় খালের পানিতে নিখোঁজ এ শ্রমিকের লাশ পাওয়া গেলো। মুন্সীগঞ্জে গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ গত মঙ্গলবার উদ্ধার করেছে পুলিশ। উপজেলার পশ্চিম হরপাড়া এলাকা থেকে সোমবার সন্ধ্যায় স্বামীর বাড়ি থেকে পলি বিশ্বাস (২৩) নামের এ গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়।
সাতক্ষীরার আশাশুনি পল্লী থেকে অজ্ঞাতনামা যুবকের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বড়দল ইউনিয়নের পাঁচপোতা বিলে সোমবার সন্ধ্যা রাতে এলাকাবাসী চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পায়। প্রায় এক/দেড় কিলোমিটার দূরবর্তী গ্রামের লোকজন টর্চলাইট লাঠিসোঁটা নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে অজ্ঞাতনামা যুবকের ধারাল অস্ত্র দিয়ে কোপানো ক্ষতবিক্ষত যুবকের লাশ দেখতে পায়। এ সময় পুলিশে খবর দিলে সহকারী পুলিশ সুপার (কালিগঞ্জ) সার্কেল মীর মনির হোসেন, থানা অফিসার ইনচার্জ আছাদুজ্জামান মুন্সী, এসআই রাশিদুজ্জামান সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে গভীর রাতে লাশ উদ্ধার করে থানা হেফাজতে নেয়।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার রায়নগর ইউনিয়নের নাগরকান্দি গ্রামের বাবু মিয়ার ছেলে হাবিবুর রহমান কর্তৃক স্ত্রী আদরী বেগম (২১)-কে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে বিএনপি নেতা সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীসহ সারা দেশে গত তিন বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৩১২ জন গুম হয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র। অপহৃতদের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ থেকেই তারা এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান। তিনি জানান, গত চার বছরে নিখোঁজ ৩১২ জনের মধ্যে ১৮৮ জনের এখনও কোনো হদিস নেই। আর যাদের পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে ৩২ জনের লাশ পাওয়া গেছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আবার মহাজোট সরকার গঠনের পর থেকে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ বছরে সারা দেশে খুন হয়েছেন ২৬ হাজার ৭৯৪ জন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত খুন হয়েছে ১ হাজার ৮৭২ ব্যক্তি।
পুলিশের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছরে খুন হন ৪ হাজার ২১৯ ব্যক্তি। তার পরের বছর ২০১০ সালে খুন হন ৩ হাজার ৯৮৮ ব্যক্তি। ২০১১ সালে খুন হন ৩ হাজার ৯৬৬, ২০১২ সালে খুন হন ৪ হাজার ১১৪, ২০১৩ সালে খুন হন ৪ হাজার ৩৯৩ ও ২০১৪ সালে আগের বছরের চেয়ে বেড়ে হয় ৪ হাজার ৫১৮ জন। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ৩২৯ জন, ফেব্রুয়ারীতে ৩০৯, মার্চে বেড়ে ৩৩৭, এপ্রিলে কমে ৩২৭, মে মাসে বেড়ে ৩৭০, জুনে ৪২৩, জুলাই মাসে ৩৭৬, আগস্টে ৩২০, সেপ্টেম্বরে ৩৪২, অক্টোবরে ৪৬৫, নভেম্বরে ৩৬৫, ডিসেম্বরে ৬৩২ জন সারা দেশে খুন হয়েছেন। এছাড়া ২০১৬ সালের গত দুই মাসে ১ হাজার ৩৪৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। চলতি মাসের ২ দিনেই সারা দেশে ৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
দেশে প্রতিদিন গড়ে ৯টি খুনের ঘটনা ঘটছে। প্রতি মাসে ধর্ষিত হচ্ছেন ৪০ জন নারী। তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা। প্রতিদিন গড়ে ৩৮ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হচ্ছে পুলিশ সদর দপ্তরের সিকিউরিটি সেলে।
অন্যদিকে ২০১৫ সালের জানুয়ারী থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ৯৮৭টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর আগের ৪ মাসে (সেপ্টেম্বর-১৪ থেকে ডিসেম্বর-১৪) সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটে ১ হাজার ৪৫৩টি। এই পরিসংখ্যান খোদ পুলিশ সদর দপ্তরের। পুলিশের ১৩টি ইউনিটের মধ্যে ঢাকা রেঞ্জে খুনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। এ রেঞ্জে চার মাসে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৪১৫টি। আর পরের অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম রেঞ্জে এই সংখ্যা ২১৯টি। আর ঢাকা মহানগরে প্রথম চার মাসে হত্যাকা- ঘটেছে ৮০টি।
আর বেসকারি সংগঠন ‘অধিকার’-এর হিসাবমতে, ২০১৫ বছরের সারা দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে ৯৮টি। ক্রসফায়ার ৭০টি। গুমের ঘটনা ৩৮টি। রাজনৈতিক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে ১৬৩টি। আর ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ১৭৮টি।
২০১৩ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে রাজধানীতে গুম হওয়া ১৯ সদস্য হলেনÑ সাজেদুল ইসলাম সুমন, জাহিদুল করিম তানভীর, আবদুল কাদের ভুঁইয়া মাসুম, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, আসাদুজ্জামান রানা, আল আমিন, এম এ আদনান, কাউসার, সেলিম রেজা পিন্টু, খালিদ হাসান সোহেল, সম্রাট মোল্লা, জহিরুল ইসলাম, পারভেজ হোসেন, মো. সোহেল, মো. সোহেল চঞ্চল, নিজাম উদ্দিন মুন্না, তরিকুল ইসলাম ঝন্টু, মাহবুব হাসান সুজন ও কাজী ফরহাদ। তারা সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
আসক-এর হিসাব অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে ২০১৩ সালে ৫৩ জন অপহৃত হয়েছেন। তাদের মধ্যে পরে পাঁচজনের লাশ পাওয়া গেছে, গ্রেপ্তার দেখান হয়েছে পাঁচজনকে। এছাড়া আরো দু’জন উদ্ধার হয়েছেন। তবে ৪১ জনের কোনো খোঁজ আজও মেলেনি।
২০১৪ সালে একইভাবে অপহৃত হয়েছেন ৮৮ জন। তাদের মধ্যে ২৩ জনের লাশ পাওয়া গেছে এবং ১১ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এছাড়া উদ্ধার হয়েছেন ১২ জন আর ৪২ জনের কোনো হদিস নেই।
আসক-এর পরিচালক নূর খান জানান, অপহৃত বা নিখোঁজদের পরিবার অভিযোগ করেছেন যে, তাদের র‌্যাব পুলিশ বা ডিবি’র সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমরাও দেখেছি, এ সব অপহরণের বড় একটি অংশের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় যদি লাশ ভেসে না উঠতো, তাহলে তাদেরও আর খোঁজ পাওয়া যেত না। এখন তো জানা যাচ্ছে যে, কতিপয় র‌্যাব সদস্য তাদের টাকার বিনিময়ে হত্যা করেছে। এ রকম টাকার বিনিময়ে আরো অপহরণ বা ক্রসফায়ারের অভিযোগও আমার পেয়েছি। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে সরকার বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা বারবার কথা বলেছি। কিন্তু তারা এ নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তাই বাধ্য হয়ে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও অভিযোগ করেছেন।
সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুর বোন মুন্নি বলেন, প্রধানমন্ত্রী তো আমাদের কান্না শুনবেন না। আমরা আমাদের ভাইকে ফেরত চাই না। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, আমাদের পরিবারের সবাইকে মেরে যান। আমরা আর কাঁদতে চাই না। কাঁদতে কাঁদতে আমাদের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাড়ছে লাশের মিছিল থামছেই না স্বজনদের কান্না
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ