Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দিক দর্শন : রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মিরাজ

| প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অধ্যাপক শাহ মোহাম্মদ আব্দুল মতিন
মিরাজ বা ঊর্ধ্বগমন :
নবী করিম (সা.)-এর ঊর্ধ্ব জগতের মোজেযাসমূহের মধ্যে মিরাজ গমন একটি বিস্ময়কর মোজেযা। এ জন্যই মিরাজের আয়াতের শুরুতেই আল্লাহপাক ‘সোবাহানাল্লাহ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যা কেবল আশ্চর্যজনক ঘটনার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সশরীরে মিরাজ গমনের প্রমাণস্বরূপ কোরআনের ‘বিআবদিহী’ শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ‘আবদুন’ শব্দটি দ্বারা রুহ ও দেহের সমষ্টিকে বোঝানো হয়েছে। তদুপরি বোরাক প্রেরণ ও বোরাক
কর্তৃক নবী করিম (সা.)-কে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেও সশরীরে মিরাজ গমনের প্রমাণ পাওয়া যায়। সর্বোপরি স্বপ্নে বা রুহানীভাবে মিরাজের দাবি করা হলে কোরাইশদের মধ্যে এত হৈচৈ হতো না। আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকল ইমামই সশরীরে মিরাজ গমনের কথা স্বীকার করেছেন। মিরাজের ঘটনাটি নবীজীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে, এর সাথে গতির সম্পর্ক এবং সময় ও স্থানের সঙ্কোচনের তত্ত¡ জড়িত রয়েছে। সূর্যের আলোর গতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। পৃথিবীতে সূর্যের আলো পৌঁছতে লাগে আট মিনিট বিশ সেকেন্ড। এ হিসাবে পৃথিবী হতে সূর্যের দূরত্ব নয় কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল। অথচ নবী করিম (সা.) মুহূর্তের মধ্যে চন্দ্র, সূর্য, সিদ্রাতলি মোন্তাহা, আরশ-কুরছি ভ্রমণ করে লা-মকানে আল্লাহর দিদার লাভ করে নব্বই হাজার কালাম করে পুনরায় মক্কা শরীফে ফিরে আসেন। এসে দেখেন, বিছানা এখনও গরম রয়েছে। এর চেয়ে আশ্চর্য আর কী হতে পারে? নবী করিম (সা.)-এর নূরের গতি কত ছিলÑ এ থেকেই অনুমান করা যায়। কেননা, তিনি ছিলেন নূর। যাওয়ার সময় বোরাক ছিল, কিন্তু ফেরার সময় বোরাক ছিল না (রুহুল বায়ান) মিরাজের মধ্যে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোÑ অন্যান্য নবীগণের সমস্ত মোজেযা নবী করিম (সা.)-এর মধ্যে একত্রিত হয়েছিল। হযরত মুসা (আ.) ত‚র পর্বতে আল্লাহর সাথে কালাম করেছেন। হযরত ঈসা (আ.) সশরীরে আকাশে অবস্থান করছেন এবং হযরত ইদ্রিস (আ.) সশরীরে বেহেস্তে অবস্থান করছেন। তাদের চেয়েও উন্নত মাকামে ও উচ্চমর্যাদায় আল্লাহপাক নবী করিম (সা.)-কে নিয়ে সবার উপরে তাঁকে মর্যাদা প্রদান করেছেন। মুসা (আ.) নিজে গিয়েছিলেন ত‚র পর্বতে। কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-কে আল্লাহতায়ালা দাওয়াত করে বোরাকে চড়িয়ে ফেরেস্তাদের মিছিলসহকারে প্রথমে বায়তুল মোকাদ্দাছে নিয়েছিলেন। সেখানে সব নবীগণকে সশরীরে উপস্থিত করে হুজুর করিম (সা.)-এর মোক্তাদী বানিয়েছিলেন। সেদিনই সমস্ত নবীগণের ইমাম হয়ে নবী করিম (সা.) ‘নবীগণেরও নবী’ রূপে বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছিলেন। সমস্ত নবীগণ অষ্টঅঙ্গ (দুই হাত, দুই পা, দুই হাঁটু, নাক ও কপাল) দিয়ে সশরীরে নামাজ আদায় করেছিলেন সেদিন। সমস্ত নবীগণ যে সশরীরে জীবিত, তারই বাস্তব প্রমাণ মিলেছিল মিরাজের রাত্রে। সমস্ত নবীগণ আপন আপন রওযায় জীবিত আছেন (হাদিস) মিরাজের রাতে নবী করিম (সা.)-কে প্রথম সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল জিব্রাইল, মিকাইল ও ই¯্রাফিল ফেরেস্তাসহ তাদের অধীনে সত্তর হাজার ফেরেস্তা দ্বারা। দ্বিতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল বাইতুল মোকাদ্দছে নবীগণের (আ.) দ্বারা। তৃতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল আকাশের ফেরেস্তা, হুর ও নবীগণের দ্বারা এবং চতুর্থ ও শেষ সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন স¦য়ং আল্লাহতায়ালা। সিদরাতুল মোন্তাহা এবং আরস মোয়াল্লা অতিক্রম করার পর স্বয়ং আল্লাহতায়ালা একশতবার সম্বর্ধনামূলক বাক্য অর্থাৎ ‘হে প্রিয় বন্ধু মোহাম্মদ, আপনি আমার অতি নিকটে আসুন’Ñ এ কথা বলে নবী করিম (সা.)-কে সম্মানিত করেছিলেন। কোরআন মজিদের আয়াত ও এদিকেই ইঙ্গিতবহ বলে ‘তাফসীরে মুগনী ও মিরছাদুল ইবাদ’ নামক গ্রন্থদ্বয়ের বরাত দিয়ে ‘রিয়াজুন্নাছেহীন’ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত কিতাবখানা সাতশত বৎসর পূর্বে ফারসি ভাষায় লিখিত। মিরাজের ঘটনা ঘটেছিল নবুয়্যত প্রকাশের ১১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিনের মাথায়। অর্থাৎ প্রকাশ্য নব্যুয়তের ১৩ বৎসরের দায়িত্ব পালনের মাঝামাঝি সময়ে। সে সময় হুজুর (সা.)Ñএর বয়স হয়েছিল ৫১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিন। সন ছিল নবুয়তের দ্বাদশ সাল। তিনটি পর্যায়ে মিরাজকে ভাগ করা হয়েছে। মক্কা শরীফ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাছ পর্যন্ত মিরাজের অংশকে বলা ইসরা বা রাত্রি ভ্রমণ। বায়তুল মোকাদ্দাছ থেকে সিদরাতুল মোন্তাহা পর্যন্ত অংশকে বলা হয় মিরাজ। সিদরাতুল মোন্তাহা থেকে আরশ ও লা-মকান পর্যন্ত অংশকে বলা হয় ইরাজ। কিন্তু সাধারণভাবে পূর্ণ ভ্রমণকেই এক নামে মিরাজ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কোরআন, হাদিসে মোতাওয়াতির এবং খবরে ওয়াহেদ দ্বারা যথাক্রমে এই তিনটি পর্যায়ের মিরাজ প্রমাণিত।
মিরাজের প্রথম পর্যায় :
রজব চাঁদের ২৭ তারিখ সোমবার পূর্ব রাতের শেষাংশে নবী করিম (সা.) বায়তুল্লায় অবস্থিত বিবি উম্মেহানী (রা.)- এর ঘরে অবস্থান করেছিলেন। বিবি উম্মেহানী (রা.) ছিলেন আবু তালেবের কন্যা এবং নবী করিম (সা.) দুধবোন। উক্ত গৃহটি ছিল বর্তমান হেরেম শরীফের ভিতরে পশ্চিম দিকে। হযরত জিব্রাইল (আ.) ঘরের ছাদ দিয়ে প্রবেশ করে নূরের পাখা দিয়ে, অন্য রেওয়ায়াত মোতাবেক গÐাদেশ দিয়ে নবী করিম (সা.)-এর কদম মোবারকের তালুতে স্পর্শ করতেই হুজুরের তন্দ্রা টুটে যায়। জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ হতে দাওয়াত জানালেন এবং নবীজীকে যমযমের কাছে নিয়ে গেলেন। সিনা মোবারক বিদীর্ণ করে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করে নূর এবং হেকমত দিয়ে পরিপূর্ণ করলেন। এভাবে মহাশূন্যে ভ্রমণের প্রস্তুতিপর্ব শেষ করলেন। নিকটেই বোরাক দÐায়মান ছিল। বোরাকের আকৃতি ছিল অদ্ভুত ধরনের; গাধার চেয়ে উঁচু, খচ্চরের চেয়ে নিচু, মুখমÐল মানুষের চেহারাসদৃশ, পা উটের পায়ের মতো এবং পিঠের কেশর ঘোড়ার মত (রহুল বয়ান-সুরা ইসরা)। মূলত বোরাক ছিল বেহেস্তী বাহনÑ যার গতি ছিল দৃষ্টি সীমান্তে মাত্র এক কদম। নবী করিম (সা.) বোরাকে সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করতেই বোরাক নড়াচড়া শুরু করলো। জিব্রাইল (আ.) বললেনÑ “তোমার পিঠে সৃষ্টির সেরা মহামানব সওয়ার হচ্ছেনÑ সুতরাং তুমি স্থির হয়ে যাও”। বোরাক বলল, কাল হাশরের দিনে নবী করিম (সা.) আমার জন্য আল্লাহর দরবারে শাফাআত করবেন বলে ওয়াদা করলে আমি স্থির হব। নবী করিম (সা.) ওয়াদা করলেন। বোরাক স্থির হলো। তিনি বোরাকে সওয়ার হলেন। জিব্রাইল (আ.) লাগাম ধরে, মিকাইল (আ.) রিকাব ধরে এবং ইস্রাফিল (আ.) পেছনে পেছনে অগ্রসর হলেন। পেছনে সত্তর হাজার ফেরেস্তার মিছিল। এ যেন দুলহার সাথে বরযাত্রী। প্রকৃতপক্ষে নবী করিম (সা.) ছিলেন আরশের দুল্হা (তাফসিরে রুহুল বয়ান)।
মক্কা শরীফ থেকে রওনা দিয়ে পথিমধ্যে মদিনার রওজা মোবারকের স্থানে গিয়ে বোরাক থামল। জিব্রাইলের ইশারায় তথায় তিনি দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। এভাবে ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মস্থান বাইতুল লাহাম এবং মাদইয়ান নামক স্থানে হযরত শুয়াইব (আ.)-এর গৃহের কাছে বোরাক থেকে নেমে নবী করিম (সা.) দুই রাকাত করে নামাজ আদায় করলেন। এ জন্যই বরকতময় স্থানে নামাজ করা ছুন্নত। এই শিক্ষাই এখানে রয়েছে। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, আমি বোরাক থেকে দেখতে পেলামÑ হযরত মুসা (আ.) তার মাযারে (জর্দানে) দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন। অতঃপর জিব্রাইল (আ.) বায়তুল মোকাদ্দাছ মসজিদের সামনে বোরাক থামালেন। সমস্ত নবীগণ পূর্ব হতেই সেখানে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন। জিব্রাইল (আ.) বোরাককে রশি দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাছের ছাখ্রা নামক পবিত্র পাথরের সাথে বাঁধলেন এবং আজান দিলেন। সমস্ত নবীগণ (আ.) নামাজের জন্য দাঁড়ালেন। হযরত জিব্রাইল (আ.) নবী করিম (সা.)-কে মোসাল্লাতে দাঁড় করিয়ে ইমামতি করার জন্য অনুরোধ করলেন। হুজুর (সা.) সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সত্তর হাজার ফেরেস্তাকে নিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। তখন কিন্তু নামাজ ফরজ হয়নি। প্রশ্ন জাগেÑ নামাজের আদেশ নাজিল হওয়ার পূর্বে হুজুর (সা.) কীভাবে ইমামতি করলেন? বোঝা গেলÑ তিনি নামাজের নিয়মকানুন পূর্বেই জানতেন।
নামাজের তা’লীম তিনি পূর্বেই পেয়েছিলেনÑ তানযীল বা নাজিল হয়েছে পরে। আজকে প্রমাণিত হলোÑ নবী করিম (সা.) হলেন ইমামুল মোরছালীন ও নবীউল আম্বিয়া (আ.)। নামাজ শেষে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সভায় নবীগণ নিজেদের পরিচয় দিয়ে বক্তব্য পেশ করলেন। সর্বশেষ সভাপতি (মীর মজলিস) হিসেবে ভাষণ রাখলেন নবী করিম (সা.)। তার ভাষণে আল্লাহতায়ালার প্রশংসা করে তিনি বললেনÑ “আল্লাহপাক আমাকে আদম সন্তানগণের মধ্যে সর্দার, আখেরি নবীও রাহমাতুল্লিল আলামিন বানিয়ে প্রেরণ করেছেন”। [এখানে একটি আক্বিদার প্রশ্ন জড়িত আছে। তা হলোÑ আম্বিয়ায়ে কেরামগণের মধ্যে চারজন ব্যতীত আর সকলেই ইতিপূর্বে ইনতিকাল করেছেন এবং তাদের রওজা মোবারকও বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত। যে চারজন নবী জীবিত, তারা হচ্ছেনÑ হযরত ইদ্রিস (আ.) বেহেশতে, হযরত ইছা (আ.) আকাশে, হযরত খিযির (আ.) জলভাগের দায়িত্বে এবং হযরত ইলিয়াছ (আ.) স্থলভাগের দায়িত্বে। জীবিত ও ইনতিকালপ্রাপ্ত সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) বিভিন্ন স্থান থেকে মুহূর্তের মধ্যে কীভাবে সশরীরে বায়তুল মোকাদ্দাছে উপস্থিত হলেন? (চলবে)

 



 

Show all comments
  • Abu Yousuf ২২ এপ্রিল, ২০১৭, ২:০৪ পিএম says : 0
    পোস্ট টি আমার বিষন ভাল লাগছে, ভবিষ্যতে আর ভাল ভাল পোস্ট দিবেন, যেমন হযরত মুহাম্মদ ( সা:) এর জিবনী, নামাজ সম্পর্কে বিভিন্ন পোষ্ট,
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ