দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মুফতী মোহাম্মদ এনামুল হাসান
আলেম-উলামাগণ হলেন নবীগণদের ওয়ারিশ বা প্রতিনিধি। সে ধারাবাহিতায় আলেম-উলামাগণ যুগে যুগে মানবজাতির কাছে ইসলামের সুমহান আদর্শ ও সঠিক মর্মবাণী প্রচার-প্রসারে দায়িত্ব পালন করে আসছে।
পথহারা মানবজাতিকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে দিয়েছেন সঠিক দিকনির্দেশনা। বস্তুত আলেম উলামাদের সীমাহীন ত্যাগ তিতিক্ষার কারণেই মানবজাতি আজ ইসলামী আদর্শে আদর্শবান।
আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার-প্রসারে যে সকল আলেম-উলামা অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার কৃতী সন্তান আল্লামা তাজুল ইসলাম এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আল্লামা তাজুল ইসলাম ছিলেন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম ইসলামী ব্যক্তিত্ব, মুফাসসিরে কোরআন, মুহাদ্দিস, শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, জাতীয় আজাদী আন্দোলনের অন্যতম বীর সৈনিক। ইসলামী জ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল তার পাÐিত্য। বাংলাদেশে ইসলামী আদর্শ কৃষ্টি-কালচার শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনি যে উজ্জ্বলময় অবদান রেখে গেছেন তা সত্যিই এ দেশের ইসলামপ্রিয় জনতার জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়।
বহুমুখী প্রতিভা, মেধা ও কৃতিত্বের জন্য আল্লামা তাজুল ইসলাম ফখরে বাঙ্গাল উপাধিতে ভূষিত হন।
জন্ম : ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার ভুবন গ্রামে ১৩১৫ হিজরি মোতাবেক ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা আনোয়ার আলী (রহঃ) (যিনি সমকালীন যুগে প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন) এর সন্তান হিসেবে ভূমিষ্ঠ হন আল্লামা তাজুল ইসলাম (রহঃ)।
শিক্ষাজীবন : পিতা মাওলানা আনোয়ার আলী তার পুত্রের বয়ষ যখন ৮ কিংবা ৯ বৎসর হল তখন তিনি স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করেন। স্কুলে ভর্তি হওয়ার মাত্র ৯ মাসে বালক তাজুল ইসলাম ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত সকল ক্লাসের পাঠ্যবিষয় মুখস্থ করে ফেলে। স্কুল জীবন শেষে বালক তাজুল ইসলাম স্থানীয় জেঠাগ্রামে মাওলানা আব্দুল করীম এর নিকট প্রাথমিক কিতাবাদি অধ্যয়ন করেন। পরে তিনি শ্রীঘর মাদ্রাসায় ভর্তি হন।
শ্রীঘর মাদ্রাসার পর হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল মাদ্রাসায় ভর্তি হন। বাহুবল মাদ্রাসা থেকে অতি সুনামের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে সিলেটে মাদ্রাসায়ে আলিয়ায় ভর্তি হন। ১৩৩৭-৩৮ হিজরিতে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার সর্বশেষ পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৩৩৮ হিজরিতে আল্লামা তাজুল ইসলাম বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। দারুল উলুম দেওবন্দে ৪ বছরে তিনি উচ্চপর্যায়ে হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, আক্বায়েদ ও আরবি সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। দেওবন্দে শিক্ষাজীবনে প্রতিটি পরিক্ষায় তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেতেন।
দেওবন্দ মাদ্রাসায় তাজুল ইসলাম (রহঃ) এর উস্তাদবৃন্দ : দেওবন্দে আল্লামা তাজুল ইসলাম (রহঃ) এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও শিক্ষক ছিলেন সমকালীন বিশ্বের অন্যতম আলেমে দ্বীন আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশমিরী (রহঃ), শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী (রহঃ), শাইখুল আদব মাওলানা এজাজ আলী (রহঃ) ও মুফতী আজিজুর রহমান (রহঃ)। এ ছাড়া শাইখুল ইসলাম সৈয়দ হুসাইন আহমদ মদনী (রহঃ) এর নিকট তিনি এলমে মারিফত লাভ করেন।
কর্মজীবন : ১৩৪২ হিজরিতে দেওবন্দ থেকে ফিরে এসে আল্লামা তাজুল ইসলাম (রহঃ) সর্ব প্রথম ঢাকা এবং পরে কুমিল্লা জামিয়া মিল্লিয়্যাহয় শাইখুল হাদিস হিসেবে যোগদান করেন। ১৩৪৫ হিজরিতে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসায় প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত দীর্ঘ ৪২ বছর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন যুগে আল্লামা তাজুল ইসলাম ফখরে বাঙ্গাল (রহঃ) এর সাথে যারা দ্বীনে ইসলামের কাজ করেছেন তারা হলেন মাওলানা আতহার আলী (রহঃ), মাওলানা আব্দুল করীম শায়খে কৌড়িয়া, মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (রহঃ), মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিন (রহঃ), মাওলানা আশরাফ আলী ধরমন্ডলী (রহঃ), মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহঃ), মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ), মাওলানা ছফি উল্লাহ চাদপুরী (রহঃ), মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব পীরজী হুজুর (রহঃ) ও মাওলানা সিরাজুল ইসলাম বড় হুজুর (রহঃ) অন্যতম।
রাজনীতি : ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম (রহঃ) ছিলেন শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। এ দেশের মানুষ যখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে তাদের চারিত্রিক অধঃপতনের কারণে সঠিক পথ ভুলে গিয়ে ইসলামী তাহজিব তামাদ্দুনকে বিসর্জন দিয়ে বৃটিশদের কৃষ্টি কালচারের প্রতি ঝুঁকে গিয়েছিল তখন পথভ্রষ্ট জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিল সর্বাপেক্ষা বেশী।
দেওবন্দে অধ্যয়নকালে স্বাধীনতা আন্দোলনে হজরত মাদানী (রহঃ) এর একান্ত সহচর হিসেবে কাজ করেছেন ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম (রহঃ)। ফখরে বাঙ্গাল (রহঃ) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলাদেশের অগ্রগামী নেতা। তিনি পর্ব পাক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টির সহ-সভাপতি এবং তৎকালীন কুমিল্লা জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
মহানবী (সাঃ) আল কোরআনের আলোকে যে ইসলামী রাজনীতি পৃথিবীতে চালু করে গেছেন সেই ইসলামী রাজনীতির মাধ্যমে এ দেশের জনগণকে বৃটিশবেনিয়াদের হাত থেকে মুক্ত করতে ছাত্র জীবন থেকেই তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
যাদের সান্নিধ্য থেকে তিনি রাজনীতির দিক্ষা লাভ করেন ঐ সকল মহামনীষীগণ হলেন মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহঃ), আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ), শাখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রহঃ), মাওলানা হুসাইন আহমদ মদনী (রহঃ) প্রমুখ।
ফখরে বাঙ্গাল উপাধি লাভ : আলামা তাজুল ইসলাম (রহঃ) দেওবন্দ মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবনের শেষ পর্যায়ে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে এক বাহাসে (তর্কযুদ্ধ) অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি কোরআন ও হাদিসের আলোকে তথ্যভিত্তিক দলিল এবং অকাট্য যুক্তির দ্বারা কাদিয়ানীদের কাফের প্রমাণ করার পর উপস্থিত জনতা তাকে ফখরে বাঙ্গাল বা বাংলার গৌরব উপাধিতে ভূষিত করেন।
বিশ্ব উলামা সম্মেলনে যোগদান : ১৯৬৪ সালে পূর্বেকার মাজহাব সমূহ ও আয়েম্মায়ে মুজতাহিদীনের পরিবর্তে নতুন মাজহাব ও মুজতাহিদীন গঠন করা প্রসঙ্গে মিশরের রাজধানী কায়রোতে বিশ্ব উলামা সম্মেলনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হতে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়ে নতুন মাজহাব এবং মুজতাহিদীন নির্বাচনের প্রস্তাবে যুক্তির মাধ্যমে প্রবল বিরোধিতা করেন। তার তথ্যভিত্তিক ও যুক্তির মাধ্যমে নতুন মাজহাব গঠনের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। ফখরে বাঙ্গাল (রহঃ) কায়রোতে বিশ্ব উলামা সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়ে বিশ্বের দরবারে এ দেশের এবং দেশের জনগণের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন।
উক্ত সম্মেলনে তিনি ফখরুল উলামা বা উলামাদের গৌরব ও হাফিজুল হাদিস উপাধিতে ভূষিত হন।
ইন্তেকাল : ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম (রহঃ) ১৯৬৭ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭১ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
তিনি ছিলেন এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী, সারাটি জীবন দ্বীনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন মুসলিম সমাজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাক্তিত্ব। তার বর্ণাঢ্য জীবনটাই ছিল ইসলামের এক ইতিহাস।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।