বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হারুন-আর-রশিদ
বাংলা ভাষা কি তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। প্রশ্নটি ইদানীং বহুল আলোচিত শব্দমালা। বইমেলায় দেখলাম বহু প্রকাশক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে গ্রন্থের নাম দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ হাউ টু বিল্ড আপ ইউর ক্যারিয়ার, ক্যারিয়ার গাইড, থিংকিং পাওয়ার, পজেটিব পাওয়ার, অপারেশন মুজিবনগর, সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা, দ্য জাংগল বুক, লিটল উইমেন, এ জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দি আর্থ ইত্যাদি। একজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী প্রফেসর যিনি বহুল পরিচিত, তার একটি গ্রন্থের নাম- ভুতের বাচ্চা সোলায়মান। এটা ভাষার বিকৃতি ধর্মীয় দৃষ্টিতে। সোলায়মান বাদশা সারা পৃথিবীর বাদশা ছিলেন এবং তিনি একজন পয়গম্বরও। আরো দেখলামÑ বাংলা একাডেমির মূল চত্বরে ভারতীয় প্রকাশকের একটি স্টল, যেখানে শুধু হিন্দু দেবতাদের কিচ্ছা কাহিনী এবং ভগবদ গীতা, রামায়ণ, দুর্গার আত্মজীবনী, শিব মা ল²ী কালিসহ হিন্দু দেবতাদের বই দ্বারা সুসজ্জিত করা। বিক্রেতারাও ভারতীয়। চটকদার শব্দ চয়ন করে বই বিক্রির মহরা চালাচ্ছে। আরেক বুক স্টলের সামনে দেখলামÑ মন্দির দ্বারা স্টলটি সুসজ্জিত করা হয়েছে। কলকাতায়ও এ ধরনের বিজাতীয় সংস্কৃতি বইমেলায় দৃশ্যমান নয়। আমরা কত যে অনুকরণপ্রিয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলা একাডেমির ফেব্রæয়ারি গ্রন্থমেলা এবং নববর্ষ উদযাপনকালীন তা লক্ষণীয়। বাংলা ভাষায় মুসলিম শব্দ আজকাল প্রায় উদাও। দখল করেছে সংস্কৃতি শব্দ, ইংরেজি শব্দ, ফারসি শব্দ। হিন্দি-শব্দে এখন প্রচুর বই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। হিন্দি-ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ভারতের দূতাবাসের আনুক‚ল্যে। ভারতীয় কালচারাল সেন্টার এখন ৭টি বিভাগীয় শহরে ভিসা অফিসের পাশাপাশি ভারতীয় সংস্কৃতি কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশে ভারতীয় ৪৬টি টিভি চ্যানেলে অর্ধনগ্ন ছবি এবং নৃত্যসহ যত রকম নস্টালিজম আছে তা আমাদের শিশু-কিশোরদের কোমল মনে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বাংলা ভাষায় যে সৌন্দর্য তার বিনাশ ঘটানো হচ্ছে। এখন হিন্দি ভাষা প্রায় প্রতি পরিবারের শিশুদের মুখে মুখে শোভা পাচ্ছে।
সম্প্রতি দেখলাম বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বললেনÑ ঈশ্বরের কৃপায় দুই বাংলার মানুষ এখন ভালো আছে। ইরানের কালচারাল সেন্টারেও অনুষ্ঠানে আরেক মন্ত্রী ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করলেন। তারা দুজনই মুসলমান নামধারী! পুরো দর্শক সমাজ হতভাগ হয়ে গেল। ইরানের রাষ্ট্রদূত ভ্রæ কুচকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন মাননীয় মন্ত্রীর দিকে। তাকানোর ভঙ্গিতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, শব্দদ্বয় তারও ভীষণ অপছন্দনীয় ছিল। ইসলামকে ছেঁটে তাড়িয়ে দিতে পারলেই মনে হয় সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তবে একটি কথা এখানে বলতে চাই, প্রধানমন্ত্রী অদ্যাবধি ইসলামের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক। এ জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু তার আশপাশের মানুষগুলো-বাম আর রামভক্ত বিধায় এসব কলহযুক্ত শব্দ উচ্চারণ করে দেশে জঙ্গিবাদের মদদ দিয়ে যাচ্ছেন অহরহ। চোখ-কান খোলা রাখলেই তা বোঝা যাবে।
সচেতন মানুষ এখন বুঝতে পারছেনÑ পাঠ্যপুস্তকে বাংলা ভাষায় যে রুচিবোধ ছিল তার বিকৃতি ঘটেছে। কারা ঘটাচ্ছে এসব বিবর্তন, তা নাম বলে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের মানুষ এসব বিদেশি ভাষার দালালদের খুব ভালো করেই চেনেন এবং জানেন।
একজন সচেতন মানুষ আমাকে বললেনÑ ‘ভাই, প্রধানমন্ত্রীকে ভালো থাকতে দেবে না, যেমন বঙ্গবন্ধুকেও ভালো থাকতে দেয়নি এসব রাম ও বামভক্ত মন্ত্রী ও সচিববৃন্দ।’ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একজন উচ্চপদস্থ কমকর্তা আমাকে বললেন, ‘প্লানিং কমিশন ও সচিব পর্যায়ে বহু রাম ও বামভক্ত মানুষ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এক বাক্যে তাদের নাস্তিক উপাধিতে ভূষিত করা যায়।’ ওই কর্মকর্তা আরও বললেনÑ ‘আমরা আদর্শিক বই ক্রয় কমিটিতে উপস্থাপন করতে পারছি না। নারীদের উদ্দাম শরীরের বইও এখন বাছাই কমিটিতে অনুমোদনের সুপারিশের আবেদন আসছে প্লানিং কমিশন ও সচিবালয় থেকে।’ প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয় জানেন না বলে ওই কর্মকর্তা বললেন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নষ্টালিজমের পথে কারা নিয়ে যাচ্ছে সে কথা এখন আর আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদকে কারা উসকে দিচ্ছেÑ সেটা অনুসন্ধান করলেই বেরিয়ে আসবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একা ভালো থাকলে পুরো দেশ ভালো থাকবেÑ এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমি সব সময় একটি কথা লেখায় উদ্ধৃতি হিসেবে তুলে ধরিÑ আমরা না বদলালে দেশ বদলাবে না।
দেশের মানুষ প্রত্যাশা করছেÑ বাংলা ভাষায় বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলা ভাষাকে দূষণের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার যে চক্রান্ত চলছে তা রোধ করতে না পারলে আমাদের শিশু সন্তানরা আলোকিত মনের মানুষ হতে পারবে না। চিন্তা-চেতনায় আদর্শিক ও নৈতিকতার উচ্ছেদ ঘটানো হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নগ্নবাদী সভ্যতার পথে হাঁটবে। ইদানীং মোবাইলে ইন্টারনেটে ভারত থেকে নগ্নবাদী কালচারের চ্যাটিং এমনভাবে অনুপ্রবেশ করছে যেমন বন্যার সময় পানি ঘরবাড়ি-গৃহপালিত পশু ও মানুষদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেকটা সেরকম অবস্থা দেশে বিরাজমান। শিশু ধর্ষণ, মাদকাসক্তি, ইভটিজিং, নারী ধর্ষণ, স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ এসব নষ্টালিজমের কারণেই ঘটছে। আমাদের অবহেলায় আমরাই আক্রান্ত হচ্ছি। রাস্তার প্রতিটি দোকানের সাইনবোর্ডে ইংরেজি নাম বাংলায় লেখা হচ্ছে। আবার ইংলিশ শব্দমালায়ও লেখা হচ্ছে উদাহরণস্বরূপ- প্যারাডাইস সুইটমিটস, স্টার কাবাব, স্টার বেকারি, কে এফ সি, অ্যাপেক্স, ইউনাইটেড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, ল্যাবএইড হাসপাতাল এরকম বহু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামও ইংরেজি শব্দে লেখা হচ্ছে। আবার কিছু কিছু বাংলা যা মূলত হিন্দি ভাষা বা সংস্কৃতি ভাষা থেকে উৎপত্তি (পলি ভাষা) যা সাইনবোর্ডে বাংলায় শোভা পাচ্ছে। এই শব্দগুলো বা বাক্যগুলো মূলত ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেল থেকে পুরোপুরি কপি করে সাইনবোর্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে।
অথচ, আমাদের নিজস্বতা বা স্বকীয়তার জন্যই দুটো বড় সংগ্রাম ১৯৪৭ সাল এবং ১৯৭১ সালে করেছিলামÑ তা এখন বিসর্জন দেয়ার অন্তিম মুহূর্তে আমরা পৌঁছে গেছি। এ কথা বললে মোটেও ভুল হবে না। গোটা নারী সমাজ ভারতীয় চ্যানেলে যেভাবে কিরনমালা, কটকটি, বধূবরণ দেখে সময় নষ্ট করে সেভাবে যদি নিজের সন্তানদের প্রতি একটু সময় ব্যয় করতেনÑ তাহলে কিশোর ও যুবক সমাজে এত ধস নামত না। পত্রিকা খুললেই শুধু খুন আর খুন আর ধর্ষণের আদিম যুগের বর্বর চিত্র। আমাদের দেশের আলেম সমাজ এখন রাজনীতি নিয়ে চরম ব্যস্ত। দুটো বড় দলের সদস্য এসব আলেম সমাজ। ১৫ দল ও ২০ দলের মধ্যে ঢুকে এরাও নিজস্ব আদর্শ হারিয়ে দলীয় আদর্শে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন। এতে শুধু পকেট ভারী করার সুযোগ আছে, পদ-পদবি পাওয়ার সুযোগ আছে, কিন্তু আখেরাতের খাতায় থাকবে বড় আকারের অশ্বডিম্ব।
আলেম সমাজ মিলেমিশে একত্রিত হয়ে একটি ব্যানারে বা প্লাটফর্মে যদি শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারতেন তা হলে বাংলাদেশ থেকেও শুভ সূচনার সূত্রপাত আলেম সমাজ ঘটাতে পারতেন। এটা মহান আল্লাহতায়ালা কোরআন শরিফে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কোরআনে আছেÑ ‘হে মানুষ, আমি তোমাদের জন্য আজ একটি চমৎকার ব্যবসার কথা বলবÑ সেটি হলো ইসলাম। এই ব্যবসাটি নিয়ে যদি তোমরা ব্যস্ত থাক তাহলে ইহকাল ও পরকাল দুটো স্থানেই তোমাদের শান্তি অবধারিত। এ ওয়াদা আমার তরফ থেকে থাকল।’ আলেম সমাজকে বিষয়টি অনুধাবন করার অনুরোধ করছি। ইসলাম শুধু একটি ধর্মের নাম নয়, একটি জীবন ও সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার নাম। সকল ধর্মের-বর্ণের ভাষার মানুষদের সমভাবে সহঅবস্থানের নাম ইসলাম। সাড়ে ১৪ শত বছর আগে ৩০ বছরের শাসনামলকে বলা হয় বিশ্বের এযাবৎকালের সোনালী যুগ। মুসলিম এবং অমুসলিম সকল মানব সম্প্রদায় এ কথা একবাক্যে স্বীকারও করেছেন।
বাংলা ভাষার দূষণ নিয়ে পরিশেষে যে কথাটি বলব তা হলো হাইকোর্ট থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় সেক্রেটারিয়েট, দোকানপাট, শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামফলক বাংলায় রূপান্তরিত করার সবিনয়ে অনুরোধ করছি প্রশাসনকি দপ্তরের কাছে। এটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্থায়ী রূপ দেওয়ার এ সময়ের দাবি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার হাল ধরতে হবে বাংলাদেশকেই। সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন ঘটুক এটা গণমানুষের দাবি। একুশ থেকে জাতি এ শিক্ষা পেয়েছে। বাংলা ভাষাকে নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা ও গবেষণা এখন সময়েরও দাবি। ভাষা এবং ধর্ম ‘সংস্কৃতির উপজীব্য’ বিষয়। একে অবহেলা করলে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। এটা কোনোভাবেই হতে দেয়া যায় না। আমরা বাংলা ভাষাকে আদৌ সমৃদ্ধ করতে পারেনি। এখনো আমরা কথায় কথায় সরি বলি, দুঃখিত বলি না। থ্যাংক ইউ বলি, ধন্যবাদ বলি না। আল্লাহ ভরসা, আল্লাহ হাফেজ না বলে ঞযধহশং মড়ফ, ইুব ইুব ইত্যাদি শব্দ চয়ন করি। এগুলো হলো বাংলা শব্দ ও সংস্কৃতিকে অপমান করা। ’৭১-এর পূর্বেও এরকম আচরণ আমরা করিনি। হিন্দি ছবি দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে চ্যানেলের সামনে বসি, একই অবস্থা সিরিয়াল নাটকের ক্ষেত্রেও।
সবই ভারতের কার্বন কপি বাংলাদেশে চালান দেয়া হচ্ছে মস্তিষ্ককে হিন্দি মস্তিষ্কতে পরিণত করার জন্য। এক কথায় আমরা পরাজিত হচ্ছি। ’৭১-এর পূর্বে যেমনি অবুঝ মন, বেহুলা, আবির্ভাব, সুতরাং, ক খ গ ঘ ঙ ছবি দেখার জন্য বলাকা ও মধুমিতা এবং চট্টগ্রামের জলসা, আলমাস ও উজলা সিনেমা হলে লম্বা লাইনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতাম টিকিট কেনার জন্য। কোথায় গেল আমাদের সেই পরিচ্ছন্ন মানসিকতা এবং নির্মার্তারা কেন আজ ভারতের ছবি হুবহু নকল করে ছবি বানাচ্ছে। আত্মমর্যাদার একটি জাতি স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য ’৭১ এর যুদ্ধের কথা কীভাবে ভুলে গেলাম। উর্দুর জায়গায় হিন্দিকে বরণ করে নেওয়ার অর্থ হলো আত্মমর্যাদার বিনাশ ঘটানো। এ জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। ইতিহাসের চাকা কেন আমরা পেছন দিকে ঘুরাচ্ছি। এতকাল পরও কেন ইতিহাসের পশ্চাৎগতি পরিবর্তন হয়নি। এসব নিয়ে চিন্তাশীল মানুষরা একটুও ভাবছেন কি। তারা সড়ক পথে চলতে গিয়ে দুই পাশে কী দেখছেনÑ বিজাতীয় শব্দ নাকি দেশীয় শব্দমালাÑ একবার ভাবুন এসব কথা। অন্যথায় বাংলা ভাষা হারিয়ে যাবে গভীর খাদে বা অতলতলে তলিয়ে যাবে আমাদের সংস্কৃতি।
য় লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।