বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
এ কে এম শাহাবুদ্দিন জহর
বাংলাদেশ জেগে ওঠো। জেগে ওঠো উজানের দেশটির পানি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে। জেগে ওঠো তার আধিপত্যবাদ ও জুলুমের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রীর লেটেস্ট ভারত সফর থেকে ভারত কার্যত বাংলাদেশকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে, সে তিস্তার এক ফোঁটা পানিও বাংলাদেশকে দেবে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বক্তব্য, তিস্তায় পানি নেই এবং তিস্তার বদলে অখ্যাত তিনটি ছোট নদী তোর্সা, ধানসিঁড়ি ও মানসিঁড়ির পানি গ্রহণ করা। বলাবাহুল্য, উপরে উল্লিখিত তিন নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকেই না। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশকে দেওয়া ভারতের আশ্বাসের মূল্য আরও বেশি নাগালের বাইরে নিয়ে গিয়ে বললেন, একমাত্র তার ও শেখ হাসিনার সরকারই তিস্তার পানি ভাগাভাগির সমাধান করতে পারবে। অর্ধযুগ আগে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন, তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার শীঘ্রই সমাধান হবে। নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
তিস্তার পানি না দেয়ার কারণে বাংলাদেশের মানুষ যাতে সরকার পরিবর্তন না করে সে জন্যই নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপমূলক বক্তব্যটি দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক কোনো চুক্তির এখতিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের, রাজ্য সরকারের নয়। রাজ্যের ও কেন্দ্রের দ্ব›দ্ব দেখিয়ে ভারত সব সময়ই বাংলাদেশকে ঠকিয়ে থাকে। এদিকে গঙ্গা নদী থেকে যে সীমিত পানি বাংলাদেশ পাচ্ছে তা আটকানোর ফন্দিও মমতা ব্যানার্জি ও নরেন্দ্র মোদির ভারত ভাবছে। শুধু তিস্তা বা গঙ্গা নয়, পুরো ৫৪টি অভিন্ন নদনদীর পানি এককভাবে ব্যবহার করতেই ভারত একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করে চলছে। তারপর তার হাতে রয়েছে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য হলো শুষ্ক মৌসুম তো বটেই বাংলাদেশকে স্বাভাবিক সেচ মৌসুমের পানি থেকে বঞ্চিত করা এবং বন্যার পানি দিয়ে বর্ষায় বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দেওয়া।
এ তো গেল নদনদীর পানি গ্রাস। এর পরেও রয়েছে ভারতের রাজনৈতিক আগ্রাসন। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা বলেছিল যে, বস্তা বস্তা টাকা ও পরামর্শ দিয়ে ভারত বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে তার চাওয়া-পাওয়া নিবৃত্তি করছে। ’৭১ সালে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করেছিল তার বৈরী একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রকে দুর্বল করে কাশ্মীরের ওপরে তার অবৈধ দখলকে বাধামুক্ত রাখতে। এ কাজে সে সফল হয়েছে। তারপরেও কথায় কথায় ভারতকে ‘দক্ষিণা’ দিতে এত আগ্রহ কেন?
তিস্তাকে পাশ কাটিয়ে অন্যান্য নদ-নদীকেও হিসাবের বাইরে রেখে ভারতের সাথে দফায় দফায় চুক্তি আর সমঝোতা করা হচ্ছে। এগুলো এমন ফলাও করে প্রচার করা হয় যে, এতে উভয় দেশই উপকৃত হচ্ছে, যদিও উপকারের পাল্লা সব সময়ই ভারতের দিকে ভারী থাকে। একটি শক্তিশালী দেশ কর্তৃক একটি দুর্বল দেশের ওপর জুলুম চাপালে দুর্বল দেশটির প্রতিবাদের ভাষা হয় উক্ত জুলুমকারী দেশের সাথে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। ভারত তিস্তাসহ প্রায় সবকটি নদ-নদীর পানি আটকিয়ে দিয়ে আমাদের তৃষ্ণার্ত করে রাখছে। অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রটোকল ভেঙে সম্বর্ধনার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যও বুঝতে পারলেন না!
বাংলাদেশের তিনদিকে ভারত এবং একদিকে আছে বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণে রয়েছে ভারত শাসিত শক্তিশালী নৌ-ঘাঁটি আন্দামান ও নিকোবর নামের দুটি দ্বীপপুঞ্জ। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্বল্প একটি সীমান্ত রেখার ওপারে আছে মিয়ানমার। তবে মিয়ানমার বাংলাদেশকে আক্রমণ করার মতো অবস্থায় নেই। বাংলাদেশকে যদি কেউ আক্রমণ করে সে রাষ্ট্রটি চীন, পাকিস্তান বা যুক্তরাষ্ট্র হবে না, হবে একমাত্র ভারত। তার পরেও এই ভারতের সাথেই প্রতিরক্ষা সহযোগিতার এটি কি শৃগালের নিকটে মুরগি বর্গা দেবার মতো নয়? প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের জন্য ভারতের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার মানে তো ভারত থেকেই অস্ত্র কেনা। অথচ ভারত নিজেই বিশ্বের বৃহত্তম সমরাস্ত্র আমদানিকারক দেশ। ভারত ইসরাইলের কাছ থেকে পর্যন্ত যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করে।
নদ-নদীর পানি বণ্টন মানে গজলডোবা, টিপাইমুখ, ফারাক্কা প্রভৃতি ভারতীয় বাঁধগুলোর কাছে যে পানি পাওয়া যায় তার বণ্টন নয়। পানি বণ্টনের মানে হলো নদ-নদীর শুরুতে যে পানি আছে তার বণ্টন অথবা বাঁধ ও পানি সেচের যুগের পূর্বে বাংলাদেশের বুকের উপরে সে পানি প্রবাহ ছিল তার বণ্টন। কিন্তু আমরা শুধু চেয়ে বেড়াচ্ছি ফারাক্কা ও গজলডোবার কাছে যে পানি আছে তারই হিস্যা। উজানে পানি আটকানোর ফলে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সার্বিক যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার পূরণও চাহিদা নয়। হঠাৎ বাঁধ খুলে দেওয়ার ফলে অর্থনীতির যে বিপর্যয় ঘটছে তার প্রতিকারও চাইছি না। আমরা পানি বণ্টন মীমাংসার দাবিতে জাতিসংঘের শরণাপন্ন হতেও চাই না।
পানির অপর নাম জীবন। একটি দেশ আমাদের এই জীবনকে কেড়ে নিচ্ছে। তাই জীবন রক্ষার্থে দেশবাসীকে লড়তে হবে। কুমিল্লা সিটি নির্বাচন ও তার পূর্বের পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং পৌরসভাগুলোর নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে, যখনই জনগণ ভোট দেওয়ার ন্যূনতম সুযোগ পাচ্ছে তখনই তারা জিতিয়ে দিচ্ছে দেশপ্রেমিক শক্তিকে। জনরায়ে ভীত হয়ে একটি অশুভ শক্তি জনগণকে ভোটই দিতে দিচ্ছে না। তাই জনগণকে আরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দুর্বার সংগ্রাম ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কোন যুদ্ধে কোন পক্ষ কোন সম্প্রদায়ের মানুষকে কত হতাহত করেছে সে হিসাবের সময় এখন নয়। এখন দরকার কীভাবে আমাদের জীবন রক্ষা পাবে, কোন উপায়ে আমরা গণতন্ত্রকে ফিরে পাব এবং ফিরে পাব আমাদের বহমান নদ-নদী তারই হিসাব-কিতাব। উপমহাদেশের অন্যান্য জাতি যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে, মুসলমানরা কেন পারবে না? কোনো মারণাস্ত্রের হুমকিতেই ভীত হওয়া যাবে না। কিয়ামতের মতো ঘটনা ঘটলে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত মুসলমানরা নিশ্চিহ্ন হবে না, নিঃশেষ হবে বিজাতিরাই। আবারও বলি, জেগে ওঠো বাংলাদেশ। জেগে ওঠো জনগণ।
য় লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।