বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
রাজু আহমেদ
জনগণকে অনেকটা ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেই প্রধানমন্ত্রীর চার দিনের ভারত সফরে দিল্লীর সাথে সম্পাদিত হলো ২২টি সমঝোতা স্মারক ও ছয়টি চুক্তি। মোদির জমানায় শেখ হাসিনার প্রথম ভারত সফরে কী কী বিষয়ে সমঝোতা ও চুক্তি হতে যাচ্ছে তা সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের সামনে পূর্ব থেকে স্পষ্ট করা হয়নি, এমনকি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরেও তার বিস্তারিত বিবরণ এখন অবধি আলোর মুখ দেখেনি। সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক ও চুক্তির সংখ্যার বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিজ্ঞাসিত হলে, তিনি বলেছেন, কতগুলো সমঝোতা ও চুক্তি হয়েছে তা গুনে দেখা হয়নি! বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ভারত সফর শেষে প্রদত্ত সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট হয়েছে, এবারের ভারত সফর ছিলো দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ককে অন্য মাত্রায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে। কাজেই সে লক্ষ্যে সফলতা এসেছে। এ সফরের মাধ্যমে ঢাকা-দিল্লীর সম্পর্ক অনন্য স্তরে উন্নীত হয়েছে। যদিও ভারত সফরের প্রাক্কালে ভারতের সাথে সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়ে দেশের অভ্যন্তরে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, বিশ্লেষকগণ এবং সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকেই ভারতের সাথে সামরিক চুক্তির বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছিলো। অবশ্য প্রতিরক্ষার ব্যাপারে ঢাকা-দিল্লী চুক্তি না হলেও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তির ব্যাপারে তা পালনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকের নীতি পালনে কোন পক্ষই বাধ্য নয় বরং তা সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে যে চুক্তিগুলো সম্পাদিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার, পরমাণু বিদ্যুৎ, সাইবার সিকিউরিটি, অডিও ভিজুয়াল প্রডাকশন এবং খুলন-কলকাতা রুট ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়। এছাড়া প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশকে অনধিক ৩০ বছর মেয়াদে পরিশোধের শর্তে ১% সুদের বিনিময়ে ভারত থেকে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ ক্রয়ের জন্য ৫০ কোটি ডলার অর্থ সহায়তা এবং চার বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সাথেই ভারতের অবদান জড়িয়ে। কাজেই ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরের মাধ্যমে বন্ধুত্বের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে এসেছেন। দিল্লী বিমানবন্দরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র দামোদার দাস মোদি প্রটোকল ভেঙে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং মোগল আমলের ইতিহাসের ধারক দিল্লীর পার্ক স্ট্রিটের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে। বন্ধুত্বের মানদন্ডে বিচার করলে ভারতের এ অকৃত্রিমতা ও উদারতার প্রকাশ কিন্তু যদি বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণে বিচার করা হয় তবে এর কোন বস্তুগত মূল্য নেই।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে শুধু বন্ধুত্বের সফর হিসেবে মূল্যায়ণ করা চলে না। কেননা ভারতের সাথে বাংলাদেশের যতোগুলো সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তার সিংহভাগ ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে বাংলাদেশ বস্তুগত মূল্যে মূল্যবান কি পেল তাও বিবেচনা করতে হবে। ভারত তার স্বার্থে বাংলাদেশকে অনেকগুলো চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করিয়ে নিলো অথচ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি দাবি তথা তিস্তার পানি চুক্তির ব্যাপারে দৃশ্যমান কোন ফল আসেনি। ভারত যা দাবি করলো তা বাস্তবে বুঝে পেল অথচ বাংলাদেশের পক্ষের দাবিটি আশ্বাসের বাণীতে মুড়ে রইলো।
তিস্তার পানি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ হতে বাংলাদেশের প্রতি কোন অনুগ্রহের বিষয় নয় বরং আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা স্বীকৃতভাবে এটা এদেশের মানুষের ন্যায্য পাওনা। শুধু পাওনার দৃষ্টিকোণ থেকে নয় বরং বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, কৃষি, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় তিস্তার পানি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে। অথচ ২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং থেকে তিস্তা চুক্তির বাস্তবায়নের ব্যাপারে যেভাবে আশ্বাস নিয়ে ফিরেছিলেন ২০১৭-তে এসেও ঠিক সেই আশ্বাস নিয়েই ফিরতে হলো। বাস্তবতায় তিস্তার জলের এক ফোঁটাও এলো না; আসবে গোলা-বারুদ! তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরে ভারতকে সম্মত করতে যতোটা কৌশলী ও দৃঢ় হওয়া দরকার তা ঢাকার কর্তৃপক্ষ থেকে লক্ষ করা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরেই যদি শর্ত দেয়া হতো তিস্তা চুক্তি হলেই কেবল অন্যান্য চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হবে তবে বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তির সংবাদ পেতো নিশ্চয়ই।
হঠাৎ করে ভারত বাংলাদেশকে তার অত্যন্ত কাছের বন্ধু হিসেবে পাওয়ার যে তৎপরতা দেখাচ্ছে তার কারণ মূলত চীন। গত বছর চীনা প্রেসিডেন্ট শিং জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরে ২৪ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সুবিধা দিয়ে ঢাকার সাথে চুক্তি এবং সম্প্রতি চীন থেকে দু’টো সাবমেরিন ক্রয়ের খবরেই দিল্লী উতলা হয়ে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে সর্বোচ্চ ইচ্ছা দেখিয়েছে। তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে এটা বাংলাদেশ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারতো অথচ সে সম্ভাবনার প্রত্যয়টি ঢাকার কর্তৃপক্ষ কাজে লাগায়নি। ভারতের সাথে যতোই বন্ধুত্ব নির্মাণের কথা বলা হোক না কেন, বর্তমান সময়ে ঢাকা-দিল্লীর সম্পর্ককে দেখতে হবে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির আয়নায়।
তিস্তা চুক্তির কথা উঠলেই বারবার পশ্চিমবঙ্গ এবং মমতা বন্দোপাধ্যায়কে টেনে এনে একটা বাহানা দাঁড় করানো হয়। এটা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননাও বটে। বাংলাদেশ স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে কোনভাবেই ভারতের কোন পরাধীন অঙ্গরাজ্যের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে যাবে না বরং বাংলাদেশের চুক্তি হবে আরেকটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের সাথে। তিস্তার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রীর মত কি, তাকে রাজী করানোর ব্যাপার দিল্লী দেখবে- এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কোন সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে না। ঢাকার যা কিছু কথা হবে তা অবশ্যই দিল্লীর সাথে। অবশ্য আলামত দেখলে মনে হয়, মমতা নয় বরং দিল্লী-ই তিস্তার ব্যাপারে মমতাকে ব্যবহার করছে। কেননা ভারতের বর্তমান ক্ষমতাশীল বিজেপীর উদ্দেশ্য হচ্ছে, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির নেতৃত্বে সরকার গঠন করবে। তাই তারা পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দোপাধ্যায়কে তিস্তার ব্যাপারে চাপ দিয়ে রাজী করাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গবাসীর ভোট নষ্ট করতে চাচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি বেঁচে থাকতে বাংলাদেশ কারো সাথেই তার স্বার্থ বিপর্যস্ত হয় এমন কোন সন্ধিতে জড়াবেন না। এটা এদেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য ভরসা ও স্বস্তির সংবাদ। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দেশাত্মবোধের প্রতি এদেশের সকল মানুষের আস্থা থাকতে হবে এবং আস্থা যাতে রাখা যায়, প্রধানমন্ত্রী থেকেও তেমন আচরণ কাম্য। কিন্তু দুঃখিত হতে হয়, যখন ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তির গুঞ্জন ও সমাঝোতা স্মারকের প্রশ্নে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তখন সে প্রশ্নের জবাবে বিএনপি সরকারের আমলে চীনের সাথে গোপনে সামরিক চুক্তির বিষয়টি নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করা হয়। বিএনপি ভুল করেছে বলে অন্য কেউ ভুল করবে, বিএনপি দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আওয়ামীলীগও সে পথে হাঁটবে কিংবা হাঁটতে পারবে- এমন পাল্টা ক্ষোভই এদেশের মানুষের শঙ্কা জাগ্রত করায়। আওয়ামীলীগ-বিএনপির দ্ব›েদ্বর কারণে দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থহানী যদি ঘটে থাকে কিংবা ঘটার আশঙ্কা জাগে তবে ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করবে না। আজ যদি শুধু মমতার দোহাই দিয়ে দিল্লী তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না দিতে পারে তবে দেশের বিশিষ্টজনের দাবি, রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্লেষণের কারণে তিস্তা ছাড়া অন্যকোন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে না বলেও ঢাকা দিল্লীকে জানিয়ে দিতো পারতো। পাকিস্তান ও চীনের সাথে ভারতের যুদ্ধাংদেহী অবস্থা বিরাজিত থাকায় দিল্লীর পাশে ঢাকাকে এখন খুব বেশি প্রয়োজন। চীন যেভাবে ২৪ বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য ঢাকাকে দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে সেভাবে এমন বিপুল অঙ্ক অর্থসাহায্য দেয়ার সঙ্গতি দিল্লীর আপাতত নেই। কাজেই তারা অন্য কোন পথ অনুসরণ করে ঢাকাকে পাশে রাখাবে এবং তারা তাতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশিদের পানির দাবিটি অধরাই থেকে গেল।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বন্ধুপ্রতীম সম্পর্ক নির্ধারিত হয় সমস্বার্থের বিবেচনায় অথচ বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক স্থির হচ্ছে একমুখী স্বার্থ পূরণের লক্ষ্যে। যেখানে ঢাকা দাতা আর দিল্লী শুধু গ্রহীতার ভূমিকায়। বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্ব কোন দল নির্ভর না হয়ে যেনো গণমানুষের স্বার্থ পূরণার্থে ব্যবহৃত হয় সে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক। স্ব স্ব দাবি আদায় ও পূরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বের সম্পর্কে নতুন গতি আসুক। শুধু একপক্ষের স্বার্থ হাসিলের বিষয়কে বন্ধুত্ব বলা চলে না। তিস্তার পানি আসবে, সীমান্ত হত্যা বন্ধ হওয়াসহ এদেশের মানুষের সকল ন্যায্য দাবি ও অধিকার আদায় এবং নিশ্চিত হলে তবেই প্রমাণিত হবে ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু।
লেখক : কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।