বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হোসেন মাহমুদ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭ থেকে ১০ এপ্রিল চার দিন ভারত সফর করেন। তিন দফা ক্ষমতায় থাকাকালে এটাই ভারতে তাঁর দীর্ঘতম সফর। এবারের ভারত সফর ফলপ্রসূ হয়েছে, এ সফরে তিনি তৃপ্তি পেয়েছেন। সফরকালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদী প্রতিরক্ষা স্মারকসহ ৩৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। বর্তমানে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব উপনীত হয়েছে এক বিশেষ উচ্চতায়। এ উচ্চতার অবশ্য কোনো সীমা নেই। আকাশের পর যেমন আরেক আকাশ, আকাশের যেমন শেষ নেই, তেমনি সম্পর্কের এ উচ্চতায় পৌঁছারও কোনো শেষ নেই। বিশ্লেষকরা কেউ কেউ মনে করেন এ সফরে সামান্য অপ্রাপ্তি রয়ে গেছে, কেউ আবার হতাশা প্রকাশ করেছেন তিস্তার পানি চুক্তি না হওয়ায়। তবে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণের কাছে যত গুরুত্বপূর্ণই মনে হোক না কেন, সরকারের কাছে যে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আগেই পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। ৪ এপ্রিল তিনি বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরে আলোচনার টেবিলে অনেক ইস্যু রয়েছে, সেখানে তিস্তা চুক্তির মতো একটি বিষয় না হলে কিছু যায় আসে না।’ তার কথায় তখনি বোঝা গিয়েছিল যে তিস্তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না সরকার। তারা মাথা ঘামিয়েছেন প্রতিরক্ষা সমঝোতাসহ বাকি সব চুক্তির ব্যাপারে। যাহোক, মাত্র ক’দিন আগে বাংলাদেশকে চীনের বিপুল পরিমাণ ঋণ সহায়তা দেয়ার কথা ঘোষণার পর এ সফরে ৮ এপ্রিল ভারতও বাংলাদেশকে নতুন ৫শ’ কোটি ডলার ঋণদানের ঘোষণা দিয়েছে। এ ঋণ দু’দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে নিবিড়তম করবে ও আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব হঠাৎ করে বৃদ্ধি পাওয়াটা সাম্প্রতিক ব্যাপার। উল্লেখ্য, এ শতকের চলতি দশকের শুরুতে উদীয়মান বিশ^শক্তি হিসেবে চীনের ক্রমঃআত্মপ্রকাশের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারতের সাথে বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে চীনকে মোকাবেলার লক্ষ্যে ভারতের সাথে জোট বাঁধা তথা ভারতকে কাছে টানার নীতি গ্রহণ করেন। চীনের সামরিক শক্তিতে ভীত ভারত মার্কিন নৈকট্য অর্জনের এ সুযোগকে লুফে নেয়। অন্যদিকে উপর্যুপরি সন্ত্রাসী হামলা, কাশ্মীর পরিস্থিতি ও আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এদিকে যখন এ অবস্থা অন্যদিকে তখন রাশিয়া-চীন-পাকিস্তানের মধ্যে একটি আপাত মৈত্রী জোট দৃশ্যমান প্রায়। এরই মধ্যে বাংলাদেশের সাথে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে আরো জোরদার করতে চীন গত বছর ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে। সে সাথে সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করেছে দু’টি সাবমেরিন। বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। ভারত মহাসাগর থেকে চীনের উপর সম্ভাব্য হামলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন হতে পারে। চীন হয়তো চায় যে ভবিষ্যত সম্ভাব্য সংঘাতে বাংলাদেশ ভারতের পক্ষে যোগ না দিয়ে নিরপেক্ষ থাকুক। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে ভারত নিকট প্রতিবেশীদের একত্রিত করতে চায়। এক্ষেত্রে নেপাল-শ্রীলংকার অনীহার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব তার কাছে অনেক। তার চেয়েও বড় কথা, উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে ভারতে ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশকে দীর্ঘস্থায়ী ভাবে একান্ত ভারত-বান্ধব করে পাওয়ার বিকল্প নেই।
আগে বাংলাদেশকে এভাবে পাওয়ার কথা ভাবা না গেলেও ১৯৯৬ সালে সে পরিস্থিতি আসে। পরে ২০০৯ সাল থেকে তা নিশ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশ উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে ভারতের সকল দুশ্চিন্তার নিরসন করেছে। সব মিলিয়ে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে এই যে ভূ-রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর নিজের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও আঞ্চলিক প্রাধান্য বিস্তার তথা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্ব ভারতের কাছে অপরিসীম। এ দু’টি কারণে এমন এক বাংলাদেশ ভারতের প্রয়োজন যে বাংলাদেশ নিজের হয়ে থাকবে। সব কথা মেনে চলবে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বকে উচ্চ থেকে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যেতে ভারত যতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান বা মিয়ানমারের সাথে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সে গুরুত্ব দিচ্ছে না। বহু মানুষেরই প্রশ্ন যে, যেখানে প্রতিবেশী পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, চীন, শ্রীলংকা, মিয়ানমার কারো সাথেই ভারতের বন্ধুত্ব সাধারণ পর্যায়ের বেশি নয় অথবা কিছুটা টানাপোড়েনের পর্যায়ে রয়েছে, সেখানে শুধু বাংলাদেশের সাথে ভারত তার বন্ধুত্বকে বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে চলেছে কেন? আর কোনো প্রতিবেশী দেশের সাথে বন্ধুত্ব উচ্চতায় নেয়ার প্রয়োজন কি তার নেই?
অন্যদিকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের প্রশংসা করাসহ দু’দেশের একসাথে কাজ করার উপর নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যে কেউই বুঝতে পারবেন যে ভারতের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ আর বাংলাদেশের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের রূপ ও রকম এক নয়। ভারতে সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও জঙ্গিবাদী তৎপরতার পিছনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা পরিকল্পনা আছে। সেখানে একদিকে ভারত বিরোধী প্রতিবেশী দেশের সন্ত্রাসীদের হামলা হয়েছে, অন্যদিকে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী-স্বাধীনতাকামীরা লড়াইরত। সে তুলনায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতার পিছনে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য দেখা যায় না। সম্ভবত তাদের উদ্দেশ্য দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি, তবে তাতে তারা সফল হতে পারেনি। আশ্চর্য যে এ পর্যন্ত এসব জঙ্গিদের নেতৃস্থানীয় কাউকে আটক করে তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার ব্যাপক কোনো চেষ্টা হয়নি, বরং তাদের নির্মূল করার দিকেই বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
যাহোকএ সফরে যে সব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সামরিক সহায়তা বা সমঝোতা বা প্রতিরক্ষা বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর। এগুলো হলো ১. বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ফ্রেম ওয়ার্ক সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক, ২. কৌশলগত ও ব্যবহারিক শিক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে ঢাকার মিরপুরের ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ ও ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ওয়েলিংটনে (নীলগিরি) ডিফেন্স সার্ভিস স্টাফ কলেজের মধ্যে সমঝোতা স্মারক, ৩. জাতীয় নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও কৌশলগত শিক্ষার ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে ঢাকার ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের সঙ্গে নয়াদিল্লির ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের সমঝোতা স্মারক এবং ৪. ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ৫০ কোটি ডলারের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক। এ থেকে দেখা যাচ্ছে যে ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তি হয়নি বটে; কিন্তু সামরিক বিষয়গুলো নিয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। জানা যায়, ভারত পঁচিশ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ চুক্তিতে রাজি না হয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরে রাজি হয়। আরো জানা গেছে, পাঁচ বছর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ সমঝোতা স্মারক নবায়ন হয়ে যাবে। দু’দেশ ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত তা নবায়িত হতে থাকবে।
এ প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে ও হচ্ছে। অনেকেরই প্রশ্ন, ভারতের সাথে এ প্রতিরক্ষা চুক্তি কেন? কার প্রয়োজনে? যতদূর জানা যায়, এ প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিল ভারত এবং তা গত নভেম্বরে চীন থেকে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেনার পরই দৃশ্যমান হয়েছে। ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের তারিখ নির্ধারিত ছিল। সে সময় প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করতে ভারতে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। কিন্তু সম্ভবত তিস্তা চুক্তি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর পিছিয়ে যায়। পরে ফেব্রæয়ারিতে আবার সফরের তারিখ নির্ধারিত হয়। তাও পিছিয়ে যায় এবং চূড়ান্তভাবে ৭ থেকে ১০ এপ্রিল সফরের সময় নির্ধারিত হয়। যাহোক, সবার জানা যে বাংলাদেশ তিনদিকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত। সেই সীমান্তের দু’তৃতীয়াংশেরও বেশি ইতোমধ্যে ভারত কাঁটাতারের বেড়ায় ঘিরে ফেলেছে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধের অজুহাত তুলে। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ১শ’ মাইল সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশের যদি বন্ধু কেউ হয় ভারতই হবে, শত্রæ হলেও ভারতই হবে। কিন্তু প্রতিরক্ষা চুক্তি হয় বাইরের আক্রমণ মোকাবেলার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের যে সীমান্ত তাতে ভিন্ন কোনো দেশের পক্ষে বাংলাদেশে আক্রমণ চালানোর সুযোগ নেই। মিয়ানমারের সাথেও যুদ্ধের প্রশ্ন আসে না। তাহলে এ প্রতিরক্ষা চুক্তি কেন? কার স্বার্থে? এতে কার লাভ?
উল্লেখ্য, ভারত প্রতিরক্ষা সহায়তা হিসেবে ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে; যা দিয়ে ভারত থেকেই অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম কিনতে হবে। এ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ তার পছন্দমত অন্য কোথাও থেকে অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম কিনতে পারবে না। আসলে, ভারত চায় না বাংলাদেশ সামরিক ক্ষেত্রে আর কারো উপর নির্ভরশীল থাকুক। ভারত আরো অনেক কিছুই চায় না। যেমন ২০১৬ সালে সার্ক শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। ভারত চায়নি যে পাকিস্তান এ বৈঠক আয়োজন করুক। তার অনিচ্ছার সাথে সুর মেলায় আফগানিস্তান, শ্রীলংকা, ভুটান ও বাংলাদেশ। আট সদস্যের মধ্যে পাঁচজনই যোগদানে অসম্মতি জানানোর পর সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আর হয়নি। ভবিষ্যতেও ভারত না চাইলে সার্ক বৈঠক আর হবে কিনা বলা মুশকিল। হয়তো বিকল্প কোনো আঞ্চলিক সংস্থা গড়ে তোলা হতে পারে এবং অবশ্যই তা পাকিস্তানকে ছাড়া। ভারতে সে বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া হচ্ছে বলেও জানা যায়।
তিস্তা চুক্তি এখন বাংলাদেশের মানুষের আবেগে পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সফরে তিস্তার পানি আনতে পারেননি। একটি দৈনিকে এ নিয়ে শিরোনাম করা হয়েছিলÑ জলতৃষ্ণা মিটল না। কিন্তু সেটা কোনো বিষয় বলে সরকারের কারো কথায় বা ভাবে-ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে না অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেমন এ বিষয়ে কোনো গুরুত্ব দেননি, এখনো তাই। তবে প্রধানমন্ত্রী তিস্তার পানি না পেলেও ভারত থেকে বহু কিছু পেয়েছেন। তাঁর কথায় সে রকমই বোঝা যায়। দেশে বহু মানুষ এ সফরে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় হতাশ হয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সমালোচনা করেছে যে তিনি দেশকে ভারতের কাছে বেচে দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সোমবার নয়া দিল্লীতে বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যবসায়ী সম্মেলনে তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, দেশ বেচে দিলাম নাকি নিয়ে ফিরলাম তা আপনারাই বলবেন। হয়তো তাঁর এ কথার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সহজ শর্তে ৫শ’ কোটি ডলারের ঋণ ঘোষণার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা। ক’মাস আগে চীনের ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ ঘোষণার পর আবার ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে ৫শ’ কোটি ডলারের ঋণ লাভ নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন সাফল্য এবং এ সাফল্যের কৃতিত্ব তাঁর উপরই বর্তায়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জোর দিয়ে বলেছেন তার সরকার ও শেখ হাসিনা সরকারের মেয়াদেই তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। মোদি ক্ষমতায় আছেন ২০১৯ সালের মে পর্যন্ত। নতুন নির্বাচনে তিনিই ফিরে আসবেন বলে বেশিরভাগ বিশ্লেষকের ধারণা। অন্যদিকে শেখ হাসিনাও ২০১৮ পর্যন্ত ক্ষমতায় আছেন। চলমান ব্যবস্থা বলবত থাকলে ২০১৯ সালের নির্বাচনেও তাঁরই বিজয় লাভের বিপুল সম্ভাবনা। সে যাহোক, মোদির কথা মতো ২০১৮ সালের মধ্যেই তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা। আর তিস্তার পানির বদলে তোরসা ও অন্যান্য নদীর পানি দেয়ার যে প্রস্তাব মমতা করেছিলেন তা ভারত ও বাংলাদেশ কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে বরং মোদির উপরই আস্থা রেখেছেন। যাই হোক, কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন ধরা যাক, তিস্তা চুক্তি হল। কারণ মোদি তা চান। আর বাংলাদেশে আগামীতে শেখ হাসিনার সরকারই তাদের কাম্য। তাকে জিতিয়ে আনতে হলে তিস্তা চুক্তি এক বিরাট ইতিবাচক ঘটনা হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে যে চুক্তির পরও তিস্তায় যদি পানি না মেলে? তিস্তার অবস্থা যদি পদ্মার মতো হয়? কে না জানে, ভারতের সাথে পানি চুক্তির আগেও পদ্মা শুকিয়ে যাচ্ছিল, পানি চুক্তির পরও তা শুকিয়েই চলেছে। অথচ চুক্তি মোতাবেক পানি পেলে পদ্মা এভাবে শুকিয়ে যাওয়ার কথা নয়। পদ্মা এখন দিন দিন পরিণত হচ্ছে এক মুমূর্ষু নদীতে। সেক্ষেত্রে অবস্থা কী দাঁড়াবে?
ভারতের ৫শ’কোটি ডলার ঋণের ঘোষণায় সরকার ও সরকার সমর্থকরা খুশি। অন্যরা খুশি কি খুশি না সেটা কোনো বিষয় নয়। এ ঋণ সরকার পক্ষের সকলের জন্য বন্ধু ভারতের সপক্ষে আরো জোর গলায় কথা বলার এক বিরাট অস্ত্র হয়ে দাঁড়াল যে ভারত কি না করছে বন্ধুদেশ বাংলাদেশের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় সার্বিক-সাহায্য সহযোগিতা দিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে প্রায় এক কোটি মানুষকে আশ্রয় ও খাদ্য প্রদান, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র প্রদানসহ যুদ্ধে সহায়তা, বিদেশে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা ইত্যাদি। এমনকি সর্বশেষ ভারতীয় সৈন্যরা এ দেশকে মুক্ত করার জন্য জীবনও দিয়েছে। শুধু কি তাই? ভারতের জন্যই পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। ভারত গঙ্গার পানি-বন্টন চুক্তি করেছে, সীমান্ত সমস্যা-ছিটমহল সমস্যার সমাধান করেছে। তারা কেউই এ কথা বলেন না যে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে কী নিয়েছে আর কতটা পেয়েছে। গঙ্গার পানি চুক্তি করে ভারত ভালো কাজ করেছে। কিন্তু তারা বলেন না যে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা ফারাক্কা বাঁধের সমস্যা ভারতেরই তৈরি। আবার চুক্তি মাফিক পানি না দেয়ার বিস্তর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে যে কারণে পদ্মার মরণ দশা। অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশ ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তি কার্যকর থাকা কালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর আশ্রয়-অস্ত্র-পৃষ্ঠপোষকতা কারা দিয়েছিল, কেন দিয়েছিল সে সম্পর্কেও তারা নীরবতা পালন করেন। অন্যদিকে ছিটমহল সমস্যার সমাধান এতদিন কেন করা হলো না তারও কোনো জবাব মেলে না। মনে হয়, জনগণের দুর্ভোগ-কষ্টের মানবিক বিবেচনা নয়, পছন্দসই সরকারেরই অপেক্ষা করছিল ভারত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর ১১ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে তিনি তাঁর সফরের বিরূপ সমালোচনার জবাব দিয়ে বলেন, হতাশ হবার কিছু নেই। হতাশ হবার মতো কোন কিছু ঘটেনি। তিস্তার পানি আসবেই, পানি কেউ আটকে রাখতে পারবে না। তিনি ভারত সফরকে ফলপ্রসূ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। সম্পূর্ণ তৃপ্তি আছে। তৃপ্তিতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, আমার এই সফরের ফলে দুই দেশের সম্পর্ক বিশেষ উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, তিনি বেঁচে থাকতে দেশের স্বার্থ বিরোধী কিছু হবে না।
বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ সে আশাই করে।
লেখক : সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।