Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কমছে বাংলাদেশী সমুদ্রগামী জাহাজ

শিপিং খাতে বিদেশ নির্ভরতা বাড়ছে : সঙ্কুচিত হচ্ছে কর্মসংস্থান

প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫১ পিএম, ১ মার্চ, ২০১৬

রফিকুল ইসলাম সেলিম : বাংলাদেশী পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা দ্রুত কমে এসেছে। বিগত ২০১৪ সালে যেখানে বাংলাদেশী জাহাজের সংখ্যা ছিল ৬৩টি, বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৪৭টিতে। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা ১৬টি কমেছে। পুরনো জাহাজ স্ক্র্যাপ হিসেবে একের পর এক বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। জাহাজ বহরে যোগ হচ্ছে না নতুন বাংলাদেশী জাহাজ। বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ বহর ক্রমাগত ছোট হয়ে আসার সুবাদে এর শূন্যস্থান পূরণ করছে বিভিন্ন বিদেশী জাহাজ বহর। দেশী জাহাজের সংখ্যা কমে যাওয়ায় আমদানি-রফতানি পণ্যপরিবহনে বিদেশী জাহাজের উপর নির্ভরতা সেই সাথে ব্যয়ও বাড়ছে। অন্যদিকে মেরিন একাডেমীসহ বিভিন্ন একাডেমি থেকে পাস করা ক্যাডেট ও নাবিকদের ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয়েছে। সংকুচিত হচ্ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। আন্তর্জাতিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের লাইফলাইন খ্যাত শিপিং শিল্পের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কেননা বিশ্বের বন্দর ও সমুদ্রপথ রয়েছে এমন সব দেশে পণ্য পরিবহনে ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ায় মার্চেন্ট জাহাজের চলাচল বা চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সার্বিকভাবে সামুদ্রিক-বাণিজ্যে (ব্লু-ইকোনমি) সমুদ্রগামী জাহাজ বিরাট ভূমিকা পালন করছে এবং তা প্রসারিত হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে নিজস্ব জাহাজ বহর সংকুচিত হচ্ছে।
আমদানি-রফতানি বাণিজ্য দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আর এই বাণিজ্যকে ত্বরান্বিত করে শিপিং খাত। বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ পণ্যই সমুদ্রপথে পরিবাহিত হয়। সময়ের সাথে জনসংখ্যা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে বিশ্বব্যাপী আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বাড়ছে। এ ধারাবাহিকতায় শিপিং শিল্পের ব্যাপক প্রসার হচ্ছে। পণ্য পরিবহনে সাশ্রয়ী হওয়ায় বিশ্বে জাহাজের সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। নতুন নতুন সমুদ্র রুটে জাহাজ চলাচলের ব্যাপ্তি ঘটছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যও দ্রুত বাড়ছে।
দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরেও বাড়ছে জাহাজ আসা-যাওয়ার সংখ্যা। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে রফতানি ৬ শতাংশ কমলেও আমদানির পরিমাণ ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে সমানুপাতে বন্দরে জাহাজের সংখ্যাও বাড়ছে। আলোচ্য সময়ে গত বছরের এ সময়ের তুলনায় জাহাজের আগমনের সংখ্যা ১৮৩টি বেড়ে ১ হাজার ৫৯৬টিতে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিপিং খাতে প্রতিবছর গড়ে ৬০০ কোটি ডলারের বেশি ব্যবসা হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায় জাহাজের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। তবে বাংলাদেশে জাহাজের সংখ্যা দিনে দিনে কমে যাওয়ায় শিপিং বাণিজ্যের এ অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিশাল ব্যবসার প্রায় পুরোটাই বিদেশীদের হাতে চলে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, নিকটতম প্রতিবেশী চীন, ভারতের মতো উদীয়মান শিল্পোন্নত দেশসমূহে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে সমুদ্র বাণিজ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়াসহ অন্যান্য উন্নয়শীল দেশ ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা- হাতে নিয়েছে। এতে বিশ্বের বিভিন্ন জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ এই অঞ্চলের নৌ-বাণিজ্যে বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠছে। এসব বিবেচনায় এখাতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। যথাযথ সরকারি সহযোগিতার অভাবসহ নানা কারণে জাহাজের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ওই সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা কমতে কমতে ৪৭-এ এসে দাঁড়িয়েছে। এক বছর আগেও জাহাজের সংখ্যা ছিল ৬৩টি। এক বছরে স্ক্র্যাপ হয়েছে ১৬টি জাহাজ। বিগত ২০১৩ সালে জাহাজের সংখ্যা ছিল ৭২টি। সমুদ্রগামী জাহাজ কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে অধিদপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার (পিও-এমএমডি) মো. সফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে জানান, বিগত ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে শিপিং ব্যবসায় যে স্থবিরতা নেমে আসে তা এখনও অনেক ক্ষেত্রে কাটিয়ে উঠা যায়নি। এই কারণে জাহাজ ব্যবসায় মন্দা চলছে। বাংলাদেশে যারা জাহাজ কিনেছেন তাদের অনেকের এ খাতে ব্যবসার তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। আর যেসব লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয় তারাও তেমন দক্ষ নয়। এই কারণে অনেকে এই ব্যবসায় লাভ করতে পারেননি। এতে অনেকে জাহাজ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। জাহাজ পরিচালনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল উল্লেখ করে তিনি বলেন, লোকসান দিয়ে বেশিদিন জাহাজ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। জাহাজ পুরাতন হওয়ার পর তা স্ক্র্যাপ হিসাবে বিক্রি করে দেয়ার পর অনেকে নতুন জাহাজ কিনছেন না। এরফলে জাহাজের সংখ্যা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। তবে এই খাতে অপার সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসআর শিপিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভাল ব্যবসা করছে। এসব প্রতিষ্ঠান নতুন নতুন জাহাজ পরিচালনা করছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন-বিএসসিও এখন প্রায় জাহাজশূন্য। ১৯৯১ সালের পর বিএসসি’র বহরে আর কোন নতুন জাহাজ যোগ হয়নি। এক সময় জাহাজ বহরে ২৮টি জাহাজ থাকলেও এখন ওই সংখ্যা তিনটিতে নেমে এসেছে। বিএসসি’র একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে বিএসসি’র ৫টি জাহাজ রয়েছে। এগুলো হলো, এমভি বাংলার কাকলী, এমভি বাংলার কল্লোল, এমটি বাংলার জ্যোতি, এমটি বাংলার সৌরভ ও এমভি বাংলার শিখা। এরমধ্যে দুটি জাহাজ স্ক্র্যাপ হিসাবে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসসি। গত দুই বছর আটটি জাহাজ স্ক্র্যাপ হিসাবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিগত ২০০৯ সালে ৬টি জাহাজ ক্রয়ের পরিকল্পনা নেয়া হলেও এখনও নতুন কোন জাহাজ বিএসসি’র বহরে যোগ হয়নি।
সরকারের রূপকল্প ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নে বিভিন্ন প্রকারের ২১টি জাহাজ অর্জনের পরিকল্পনা রয়েছে বিএসসি’র। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোন গতি নেই। চীন সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় ৬টি নতুন জাহাজ ক্রয়ের লক্ষ্যে একটি চুক্তি হয় ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল। তবে এখনও কোন জাহাজ কেনা হয়নি। বিএসসি জাহাজ শূন্য হয়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে মেরিন একাডেমি থেকে পাস করার ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণে সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। সম্ভাবনাময় খাত নাবিকদের জন্যও বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এক্স মেরিন ক্যাডেটদের একটি সূত্র জানায়, সরকারি মেরিন একাডেমির প্রায় ৫৭২ জন ক্যাডেট পাস করার জাহাজে চাকরি পাচ্ছে না। বেসরকারি একাডেমির প্রায় ৪৫০ জন ক্যাডেট বেকার বসে আছে। একইভাবে ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা বেকার নাবিকের সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। এসব ক্যাডেট পাস করার পরই বিএসসির জাহাজ ও দেশী জাহাজে চাকরির সুযোগ পেত। এর পর অনেকে বিদেশী জাহাজে চাকরি নিয়ে যেত। এখন সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ক্যাডেটরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশী কোম্পানির নতুন জাহাজের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে লোকসানের মুখে এক পর্যায়ে জাহাজ বিক্রি করে দিচ্ছেন বাংলাদেশী মালিকেরা। একটি জাহাজ চালু রাখতে ফিক্সড অপারেটিং কস্ট বাবদ দৈনিক ৮-১০ হাজার ডলার খরচ হয়। পুরানো জাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ আরো বেশি। এতে করে নিয়মিত ট্রিপ না থাকলে বড় ধরনের ক্ষতিতে পড়তে হয় জাহাজ মালিকদের। গত দুই বছরে দেশের শিপিং কোম্পানিগুলো জাহাজ বিক্রি করে লোকসান কমানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। অনেকে একটি-দুটি করে জাহাজ বিক্রি করে দিয়েছেন। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনও জাহাজ বিক্রি করে বহর ছোট করেছে। লোকসান কমাতে পুরানো জাহাজ বিক্রি করা হয়।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কমছে বাংলাদেশী সমুদ্রগামী জাহাজ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ